প্রকৃতির চেয়ে কড়া হেডমাস্টারমশাই সম্ভবত আর কেউ নেই। প্রথমে একটু আধটু বেয়াদবি সহ্য করবে, তারপর বকুনি-কানমলা। সে সব না শুনলে বিতাড়ন করে দেবে!
১৭৯৮ সালে ম্যালথাস নামে এক পাদ্রি ‘অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপল অব পপুলেশন’ বইটিতে তাঁর জনসংখ্যা তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন। ম্যালথাস খাদ্য সরবরাহের প্রকৃতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনামূলক আলোচনা করে বলেছিলেন— জনসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিত হলে বৃদ্ধির হার হয় জ্যামিতিক। কিন্তু জীবনধারণের জন্য দরকারি সামগ্রীর (যেমন খাদ্যশস্য) বৃদ্ধির হার হয় গাণিতিক ভাবে।
এই তত্ত্বের মূল কথাই হল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার খাদ্যের জোগানের হারের চেয়ে হবে দ্রুততর। এই প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব একসময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে কমিয়ে দেবে। তার দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল, জনসংখ্যা কমানোর জন্য মানুষ যদি প্রতিরোধমূলক কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তা হলে মহামারী, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের মতো দুর্যোগে মৃত্যুর হার বাড়িয়ে জনসংখ্যার হার কমাবে।
ম্যালথাস প্রশ্নাতীত নন। বস্তুত কোনও মতবাদ বা তত্ত্বই পৃথিবীতে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু ইতিহাসের কিছু ঘটনা ম্যালথাসের তত্ত্বকে পরোক্ষে সমর্থন জানাচ্ছে। ১৩২০ সালে ইউরোপ ও এশিয়ায় মহামারীর আকার ধারণ করেছিল ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ অফ বুবনিক’। ইঁদুর ও কালোমাছি থেকে ছড়িয়ে পড়া এই রোগে মারা গিয়েছিলেন ২০০ মিলিয়ন মানুষ। ১৪২০ সালে রোমে হয়েছিল ‘ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ’। ১৫২০ সালে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ‘স্মল পক্স’। ১৬২০-তে মহামারী ‘মে ফ্লাওয়ার’। ওই শতকেই ১৬২৯-এ দেড় কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন ‘গ্রেট প্লেগ অফ লন্ডনে’। ১৭২০-এ ফ্রান্সের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ অফ মার্সেই’ প্রচুর মানুষের প্রাণ কেড়েছিল।
১৮২০ সালে ভারতে ‘কলেরা’ ও ‘ইয়োলো ফিভারে’ প্রচুর মানুষ গিয়েছিল। ১৯২০-তে স্পেনের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ প্রকৃতির উপর বিরাট আকারে নেমে আসা সর্বশেষ অভিশাপ। এর মাঝে দু’টো বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
পৃথিবী এখন ‘রাস্টিকেট’ পর্ব চালাতে শুরু করেছে! মানুষের সংখ্যা লাগাম ছাড়া বেড়েছে। তাই মানুষ নিজের প্রয়োজনে এমন অনেক কাজই করছে যা প্রকৃতি অনুমোদন করে না। বনাঞ্চল কেটে বসতি হল, কৃষিজমি হল। মানুষ তাঁর প্রয়োজনীয়তার সীমাকে সীমিত করতে পারল না। স্লোগান হয়ে পড়ল মানুষের ‘গিভ-মি-মোর’। কলকারখানা, যানবাহনের ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে গেল। কত পাখি, কত প্রাণ হারিয়ে গেল, মানুষ খোঁজও রাখল না। বরফ গলে জল কত দূর গড়িয়ে গেল, খেয়ালও করল না।
তার প্রতিফলন? প্রকৃতি তো খামখেয়ালি হবেই। এই জনসংখ্যার ভার পৃথিবীর বুকে পাথরের মতো চেপে আসতে চাইলে পৃথিবী তো চাইবেই সেটা সরিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে!
এই মহামারীর সাত-আট সপ্তাহ শিখিয়ে দিল যার হাতে পরমানু অস্ত্র, যুদ্ধাস্ত্র আছে সে শক্তিধর নয়। যার হাতে হাসপাতাল আছে, চিকিৎসা আছে, চিকিৎসক, গবেষণাগার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সে-ই প্রকৃত শক্তিশালী। প্রকৃতির চেয়ে শক্তিশালী কেউ নয়। মানবিকতা ও মানবিক বিজ্ঞানের চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কিছুই হতে পারে না। ক্ষমতার গর্ব করতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে শক্তিধর দেশগুলোকে নভেল করোনাভাইরাসের কাছে। অদেখা এক শত্রু! দেশ ও সীমার বাছবিচার করছে না। সব জাতির মানুষকে সঙ্কটের এক আকাশের নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধাস্ত্র নয়, মাত্র একটা ভ্যাকসিন যে দেশের গবেষণাগার দিতে পারবে সেই দেশের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করবে বাকি বিশ্ব।
প্রকৃতির বার্তাকে আমল না দেওয়ায় আজ মানুষ অস্তিত্বের সঙ্কটের সীমান্তে দাঁড়িয়ে। মৃত্যু চোখ রাঙাচ্ছে আর মানুষ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করছে।
কলকারখানা ও যানবাহনের ব্যবহার কয়েক সপ্তাহে এতটাই কমে গিয়েছে যে পরিবেশ তাঁর শুদ্ধতা ফিরে পেতে শুরু করেছে। শহরের গাছে অনেক নাম না জানা পাখি আসছে। যে কাকলি বহুবছর শোনা যায়নি বদ্ধ ঘরের জানালা থেকে মানুষ শুনতে পাচ্ছে সে সব। দলে দলে প্রজাপতি আসছে। নীল আকাশের বিশুদ্ধতায় এই রোগ জরার পৃথিবীতেও মানুষের মন ভাল করে দিচ্ছে। সমুদ্রতটে মানুষের খোঁজ নিতে দলবেঁধে আসছে ডলফিনেরা। যাঁরা তাদের দেখতে পাচ্ছেন, তাঁরা মনে মনে জিজ্ঞেস করছেন— ‘এতদিন কোথায় ছিলে?’
মানুষকে শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখতেই হবে প্রকৃতির উপর। ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন করে মরিয়া হওয়া মানুষকে প্রকৃতি নিরাশ করবে না। এখনই দ্রুততায় পাতালপুরী থেকে করোনার ভ্যাকসিন না পাওয়া গেলে হয়তো মৃত্যুর মিছিল চলতে থাকবে। কিন্তু একদিন এই আক্রান্ত মানুষের শরীরেই জন্ম নেবে অ্যান্টিবডি। তাদের শ্বাস ছড়িয়ে পড়বে প্রকৃতির আশীর্বাদের মতো। মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি মানুষের হাতে তুলে দেবে প্রকৃতি। কেননা প্রকৃতি তাঁর কোনও সন্তানকেই হারাতে চায় না।
(লেখক বালুরঘাটের মহাদেববাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ঐমতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy