তিলাবনীর জঙ্গল। ছবি: লেখক
আজ থেকে আট বছর আগে যখন বন ও বন্যপ্রাণ চর্চার প্রথাগত পাঠ শুরু করি তখনও জঙ্গল বলতে যা বোঝায় তার কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। ছবি তুলতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছি শাল, শিশু, পলাশ আর ইউক্যালিপটাসের বন। পাখি আর পোকামাকড়ের খোঁজে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। অনেক সময় শিল্পশহর দুর্গাপুর ঘেঁষা জঙ্গলের কাছে গিয়েছি দুধরাজ আর বর্ণালীর খোঁজে। বনের গভীরে গিয়ে দেখেছি সার দিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে। লরি বোঝাই হয়ে চলে যাচ্ছে জীবন্ত লাশগুলি। মাঠে অহেতুক আগুন লাগানো দেখেছি। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিয়েছে বহু সজীব প্রাণ। আসলে মানুষ সে দিন প্রকৃতি থেকে সরে এসেছিল, যে দিন তাঁর গায়ে লেগেছিল সভ্যতার ছোঁয়া। নিজের জ্বলানো আগুনের আঁচে যে দিন সে তাঁর নিজের ঘর (বন) জ্বলেছে সে দিনও ভাবেনি আর আজও ভাবে না যখন নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বনে আগুন লাগায়।
প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে আজ ঋতুচক্রও বদলে গিয়েছে। আমাদের লোভের বলি হয়েছে শত, সহস্র বন্যপ্রাণ। আমরা নিজেদের সুখের সীমাকে গগনচুম্বী করতে গিয়ে কেড়ে নিয়েছি বহু জীবের আবাস। ছোট পোকা-মাকড় থেকে বড় প্রাণী আজ সবার বাসস্থান সঙ্কটে। প্রতিটি বছর বনের পর বন সাফ হয়ে যাচ্ছে। যে সব জায়গায় হাতির উপদ্রব হয়, সেখানের ইতিহাস আর ভূগোল ঘাঁটলে জানতে পারব কী ভাবে আশপাশের বন, মানুষ দখল করতে করতে আজ হাতি-সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীদের থাকার জায়গা দখল করে নিয়েছে, আর তাই খাবারের খোঁজে বাসস্থানের তাগিদে তাদেরও আসতে হয় সভ্য সমাজে। আর তাতেই ঘটে সংঘাত। জঙ্গলের নিয়ম ভেঙে আমরা বানিয়েছি জঙ্গলের মাঝে রেল ও সড়ক পথ। তাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু যে দিন থেকে নিজের গতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা যন্ত্রের হাতে সঁপে দিয়েছি সে দিন থেকেই বিপন্ন হল জঙ্গল। গতির মোহে অন্ধ হয়ে বার বার গাড়ি চাপা দিয়েছি শেয়াল, ভাম, খটাস, বেঁজি, চিতল হরিণ বা অন্য বড় জন্তু। প্রায় প্রত্যেক বছর রেলে কাটা পড়ে বহু হাতি। দু’-এক দিন শোক, সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন আর তার পরে আবার চুপ, যতক্ষণ অবধি না নতুন কোনও ‘খুনের’ ঘটনা সামনে আসে।
বিভিন্ন অঞ্চলের ভু-প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাদের পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল সে দিক থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অজয় ও দামোদরের বিস্তীর্ণ অববাহিকা অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই এলাকার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক রূপ সামনে আসে। একটানা বিশাল বনাঞ্চল না থাকলেও, এর বিভন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই অগভীর অথচ প্রাচীন বনাঞ্চল রয়েছে। আর প্রতিটি এলাকার বিভিন্নতার কারণে এখানে আছে অসংখ্য জীবের সমাহার আর তাই দিয়ে এই অঞ্চলের সামগ্রিক জীব-বৈচিত্র্য বেশ নজর কাড়ার মতো।
এই অঞ্চলটি প্রাচীনত্বের দিক থেকে কোনও সন্দেহের অবকাশ রাখে না। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই বিভিন্ন স্থপতির নজর পড়ে এই এলাকার উপরে। জলপথ ও সড়কপথের পর যখন রেলপথের সূচনা হয়, সেই সময় থেকেই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীটি বেশ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখনও এখানকার বিভিন্ন এলাকায় প্রাচীন শিল্পকেন্দ্রগুলির অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে। কয়লা শিল্পের পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখানে বহু বনাঞ্চলের নিধন হয়। এর পরে বিভিন্ন কারখানা আর এয়ারস্ট্রিপ তৈরির পরে এক দিকে, যেমন এই অঞ্চলের শিল্প ও বাণিজ্যের খ্যাতি বাড়ে, অন্য দিকে, হারিয়ে যায় বহু অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। বর্তমান পরিস্থিতি আরও ভয়ানক। স্থানে স্থানে স্পঞ্জ আয়রণ কারখানা, ডিভিসির অনিয়ন্ত্রিত ধোঁয়া নির্গমন বা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় না রেখে কল কারখানা তৈরির ফলে এখানকার দূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে দ্রুত হারে। কারখানা বসলেও গাছ বসানোর কাজ হয়নি নিয়মমাফিক। এ ছাড়া যে কথার উল্লেখ করতেই হয়, ফাঁকা জমি বা পুকুর থাকলেই এখন তা প্রমোটারের হাতে পড়ছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকুরির সুযোগের ফলে বহু মানুষের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে এই সুবিশাল অঞ্চলটি। আর তাই ফ্ল্যাট, বাড়ির চাহিদা মেটাতে তৈরি হচ্ছে একের পর এক কমপ্লেক্স আর তাতেই জটিলতর হচ্ছে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য। তবে এই সমস্যা শুধুমাত্র এখানকার নয়। বিভিন্ন এলাকার এই একই সমস্যা। গাছ লাগানো হলেও গাছগুলি আদৌ কতটা বেড়ে উঠছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
আর তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে সাধারণের মধ্যে অরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা প্রচার করা হচ্ছে। জনসাধারণে এর প্রভাব লক্ষণীয়। আজকাল বিবাহবাসরে বা অন্নপ্রাশনে বীজকলম বা চারাগাছ তুলে দেওয়া হচ্ছে অতিথিদের হাতে। এ ছাড়াও, বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগেও হয়েছে বৃক্ষরোপণ। বিশ্বব্যাপী অরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেই, ‘আন্তর্জাতিক অরণ্য দিবস’ পালনের সূচনা। ২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় বিশ্বব্যাপী অরণ্য সম্পদকে ও বন্যপ্রাণকে মানব উন্নয়নের স্বার্থে রক্ষার জন্য যে সনদ পেশ করা হয় তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রতি বছর ২১ মার্চ বিভিন্ন প্রকৃতি বান্ধব কর্মসূচীর মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক অরণ্য দিবস’ পালন করার। ২০১৩ সাল থেকে এই বিশেষ দিনটির পালন শুরু হয়। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার সহযোগীতায় গাছ, বন ও বনজ সম্পদের গুরুত্ব এবং বর্তমানে দ্রুত হারে অরণ্য হ্রাস ও সেই সংক্রান্ত সমস্যাগুলি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে এই বিশেষ দিন বা সমগ্র সপ্তাহ জুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ২০১৯ সালের মূল ভাবনা ছিল ‘অরণ্য ও শিক্ষা’ যার মূল উদ্দেশ্য ছিল অরণ্য সম্পদের সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষার প্রয়োগ এবং অরণ্য সংরক্ষণ বার্তার ব্যাপক প্রসার। ২০২০ সালের মূল ভাবনা ‘অরণ্য ও জীববৈচিত্র’কে সামনে রেখে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অরণ্য ও জীববৈচিত্র একে অপরের পরিপূরক। আমাদের পৃথিবীর প্রায় ৮০% প্রাণীর আবাস প্রাচীন অরণ্যগুলি। আর তাই অরণ্যের হ্রাসের ফলে প্রাণীকূলের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটেছে। বিশ্বের মোট আয়তনের ৩০% অরণ্যে ঢাকা। অরণ্য থেকে মানুষ খাবার, ওষুধ, জ্বালানি ছাড়াও আর যা পেয়ে আসছে তা মূল্য দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। অরণ্যই পারে পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে। বিশ্ব জুড়ে চলা উষ্ণায়নের নিয়ন্ত্রণ অরণ্যের হাতে। বর্তমানে প্রতি বছর ৩২ মিলিয়ন একর হারে অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। আর এর সঙ্গেই হারিয়ে যাচ্ছে বহু উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতি। অরণ্য নিধনের প্রভাবে খাদ্য ও বাসস্থান জনিত সমস্যায় ভুগছে প্রাণীকূল।
আমরা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখেছি যা আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়। আমাজন ও অস্ট্রেলিয়ার ভয়াভয় দাবানল বুঝিয়ে দেয় প্রকৃতি আমাদের আচরণে খুশি নয়। তাই শুধু এক দিন বন সৃজনের মাধ্যমে যে সার্থকতা লাভ করা সম্ভব তা বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগাতে প্রত্যেক দিন অরণ্য রক্ষার ভাবনাকে মনে রেখে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। অরণ্য রক্ষার ভাবনার পাঠ শুরু হোক শৈশব থেকে, তা হলে আজকের কিশলয় কালের নিয়মে মহীরুহ হয়ে অরণ্য ও আরণ্যকদের ছায়াদান করে বাঁচিয়ে রাখবে আগামীর জন্য।
শিক্ষক, সিহারশোল নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়, রানিগঞ্জ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy