অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত একখানি শব্দভেদী বাণ ছুড়িয়াছেন। তাঁহার নিশানা: লিঞ্চিং। গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জমানায় এই শব্দটি ভারতে বহুলপ্রচলিত। বস্তুত, বিশ্বদুনিয়াও এখন মোদীর ভারতে লিঞ্চিংয়ের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে অবহিত এবং সন্ত্রস্ত। এমন একটি শব্দ সঙ্ঘ পরিবারের নায়ক ও নিয়ামকদের পক্ষে প্রীতিকর হইবে না, তাহা স্বাভাবিক। অনুমান করা যায়, সরসঙ্ঘচালকের অন্তরে (বি)রাগ জমিতেছিল। অনুমান করা যায়, তিনি পূর্বেই এই শব্দাসুরকে বিদ্ধ করিবার অস্ত্রটি সন্ধান করিয়া রাখিয়াছিলেন। অবশেষে বিজয়া দশমীর লগ্নে, আরএসএসের প্রতিষ্ঠাদিবসে প্রদত্ত বক্তৃতায় সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করিয়াছেন। বলিয়াছেন, লিঞ্চিং ব্যাপারটাই পশ্চিমি, ভারতের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এই নাম প্রয়োগ করিলে দেশের এবং হিন্দু সমাজের অবমাননা করা হয়। এহ বাহ্য। শ্রীভাগবত উবাচ: ‘এই দেশের বাহিরে রচিত এক ধর্মগ্রন্থে’ লিঞ্চিংয়ের প্রসঙ্গ বিবৃত হইয়াছিল। ‘পাপী’কে সমবেত ভাবে পাথর ছুড়িয়া মারিবার উদ্যোগকে জিশুখ্রিস্ট কী ভাবে প্রতিহত করিয়াছিলেন, সেই কাহিনি উল্লেখ করিয়া তিনি ইহাও খোলসা করিয়া দেন যে, ধর্মগ্রন্থটি বাইবেল। পবিত্র ভারতের কীর্তিকলাপের বর্ণনায় এমন শব্দ ব্যবহার করিলে সনাতন হিন্দুত্বের যবনদোষ ঘটে বইকি!
লিঞ্চিং শব্দটি বিদেশি, সেই শব্দের পিছনে অষ্টাদশ শতাব্দীর মার্কিন ইতিহাসের ভূমিকা মোটের উপর প্রতিষ্ঠিত, উনিশ শতকের কয়েক দশক জুড়িয়া সেই দেশে লিঞ্চিংয়ের মড়ক লাগিয়াছিল, এ সকলই সুবিদিত। কিন্তু অনুমান করা চলে যে, মোহন ভাগবত কেবল শব্দতত্ত্ব ব্যাখ্যা করিবার জন্য প্রতিষ্ঠাদিবসের বক্তৃতা ফাঁদেন নাই। তাঁহার এই মন্তব্যের একটি গূঢ় উদ্দেশ্য থাকা সম্ভব। কথার মারপ্যাঁচে সত্যকে অস্বীকার করিবার উদ্দেশ্য। প্রথম কথা, তিনি বিলক্ষণ জানেন, গণপ্রহারে হত্যার ঐতিহ্য ভারতে আদৌ অপরিচিত নহে। পাড়ায় পাড়ায় ছেলেধরা বা পকেটমার সন্দেহে গণপ্রহার হইতে শুরু করিয়া দলিত বা অন্যান্য কিছু সুযোগবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মানুষকে সমবেত ও সংগঠিত উদ্যমে আক্রমণের ঘটনা এ দেশের নাগরিক বহু কাল ধরিয়াই দেখিয়া আসিতেছেন। কিন্তু এহ বাহ্য। গত কয়েক বছরে প্রাণঘাতী গণপ্রহারের পরম্পরায় এক নূতন মাত্রা যুক্ত হইয়াছে। তাহার নাম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বা রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ।
উত্তরপ্রদেশের দাদরি, রাজস্থানের আলোয়ার, গুজরাতের উনা— মহান ভারতের এমন আরও নানা অঞ্চলে দলিত ও সংখ্যালঘু মানুষ ক্রমাগত গোমাংস ভক্ষণ বা গোহত্যার অভিযোগে গণপ্রহারের শিকার হইয়াছেন, কেহ প্রাণে বাঁচিয়াছেন, অনেকেরই সেই সৌভাগ্য হয় নাই। বহু ক্ষেত্রেই ঘাতকরা সঙ্ঘ পরিবারের অনুগামী বা ভক্ত বলিয়া পরিচিত। কিন্তু আরও বড় কথা, মোদী সরকার শাসিত ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের যে প্রবল দাপট কায়েম হইয়াছে, যাহার উৎকট প্রকাশ ঘটিয়া চলিয়াছে গোমাতার বন্দনা হইতে শুরু করিয়া জয় শ্রীরাম কীর্তনের জবরদস্তি অবধি রকমারি উপদ্রবে, এই অপরাধগুলির পিছনে সেই সামগ্রিক বাতাবরণের অবদান বিপুল। এবং লক্ষণীয়, এই ধরনের ভয়াবহ ঘটনার মিছিল চলিলেও বাক্পটু প্রধানমন্ত্রীর মুখে তাহার কঠোর নিন্দা প্রায় শোনাই যায় নাই। তাঁহার এবং তাঁহার সহকর্মীদের নীরবতায় মনে হইয়াছে, যেন কিছুই ঘটে নাই। এখন মোহন ভাগবত লিঞ্চিং শব্দটির ব্যুৎপত্তির কাহিনি আওড়াইয়া কি সেই ‘কিছুই ঘটে নাই’ তত্ত্বটিকেই প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন? যদি এই অনুমান সত্য হয়, তবে প্রশ্ন উঠিবেই যে, তিনি কার্যত সংগঠিত হত্যার কারবারিদের সমর্থন করিতেছেন না কি? তিনি বা তাঁহার অনুগামীরা অবশ্যই এই প্রশ্ন ফুৎকারে উড়াইয়া দিবেন। কিন্তু প্রশ্নটি তাহার গুরুত্বে পর্বতপ্রমাণ, স্বয়ং বজরংবলীরও তাহাকে উড়াইবার সাধ্য নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy