বিপুল ভোটে জিতে মোদী সরকার দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই কাশ্মীরের পুরো প্রশাসনিক চরিত্র-মানচিত্র বদলে দিল। মুহূর্তে বাতিল হয়ে গেল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। রাজ্যসভায় পেশ হল জম্মু-কাশ্মীর বিভাজনের প্রস্তাব সংক্রান্ত বিল। ৩৫-এর এ অনুচ্ছেদ বাতিল হয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরকে দু’ভাগ করে কেড়ে নেওয়া হল রাজ্যের মর্যাদা। জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ হয়ে গেল দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা থাকল। লাদাখ সেটাও হারাল।
এমনিতেই ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে এখন অনেকটাই ফাঁকা মাঠ। বিরোধীরা নির্বাচনের ধাক্কা কাটাতে পারেনি এখনও। কংগ্রেসও বেহাল। রাহুল গাঁধীর বিকল্প কে— বোঝা যাচ্ছে না। আর তার মধ্যে বেশ নাটকীয় ও গোপনীয় ভাবে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির এই সিদ্ধান্ত।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশ জুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে যে, এই সিদ্ধান্ত বৈধ কিনা। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলছেন যে, এটি সংবিধান বিরোধী কোনও সিদ্ধান্ত নয়। ৩৭০ ধারা আসলে টেম্পোরারি আর্টিকেল ছিল। সে ভাবেই সংবিধানে গৃহীত হয়েছিল, তাই তাকে তুলে দেওয়াই যায়। অনেকে বলছেন, ৩৭০ ধারা থাকা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের স্বাধীন অঙ্গরাজ্য, তা হলে তার বিশেষ সুযোগসুবিধার কিসের প্রয়োজন? অন্য দিকে গেরুয়া শিবিরে উল্লাস। আর এটাও ঠিক জনসঙ্ঘের জন্মলগ্ন থেকেই তিনটি প্রধান দাবি তারা করে আসছিল। রাম মন্দির নির্মাণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এবং ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি। আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আত্মগর্বিত সরকার সেই পথেই এগোচ্ছে।
দেশের কোনও পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদাহানি করে তাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এ ভাবে পরিণত করার ঘটনা আগে কখনও হয়নি। অমিত শাহ যখন ঘোষণা করলেন এত দিনে কাশ্মীর ভারতের অভিন্ন অঙ্গে পরিণত হবে, ঠিক তখনই কাশ্মীরে ভারী বুটের আওয়াজে সন্ত্রস্ত মানুষজন। সেখানে ১ লক্ষ ১৫ হাজার নিরাপত্তা বাহিনীর টহল। বন্ধ ইন্টারনেট পরিষেবা এবং টেলিভিশনে সম্প্রচার। মোবাইলে ফোন করা যাচ্ছে না। সর্বত্র জারি ১৪৪ ধারা। কারারুদ্ধ বা গৃহবন্দি পিডিপি এবং নসির প্রধান নেতারা। মেহবুবা মুফতি এবং ওমর আবদুল্লার টুইটে ভেসে উঠেছে কাশ্মীরের স্বাধীনতা জোর করে কেড়ে নেওয়ার কথা। রাজ্যসভায় প্রতিবাদে বলা হল সংসদীয় গণতন্ত্রের কালাদিন।
৩৭০ ধারার সঙ্গে কাশ্মীরের যোগ এক ঐতিহাসিক সত্য।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য রাজা হরি সিং যে ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাসেসান-এ সাক্ষর করেছিলেন ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর, তার ৪ নম্বর ধারায় বলা ছিল— ‘‘আমি এই আশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি যে, এই রাজ্যে ভারত সরকার তার কোনও আইন চালু করতে চাইলে বা প্রশাসনিক দিক থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে গভর্নর জেনারেল ও এই রাজ্যের শাসকের মধ্যে চুক্তি হলেও তা কার্যকরী করবে ওই রাজ্যের শাসক (জে বি দাশগুপ্তের জম্মু ও কাশ্মীর)। এই চুক্তিতে রাজা হরি সিং আরও বলেন যে, এর কোনও পরিবর্তন করতে হলেও রাজার সম্মতি থাকতে হবে। পরে শেখ আবদুল্লা বলেছিলেন, কাশ্মীরের সামনে তিনটি পথ খোলা আছে। ভারতের সঙ্গে সংযুক্তি। না হয় পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি। অথবা, স্বাধীন থাকা। ভারতের সঙ্গে থাকার সাতটি যুক্তি তিনি দেন। এগুলি ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, স্বাধীনতার সাধারণ সংগ্রাম, ভূমি সংস্কার, কাশ্মীরের পণ্য বিক্রয়ের সুবিধা, ভোগ্যপণ্য সংগ্রহের সুবিধা, কাশ্মীরের প্রশাসনের জন্য আরও বড় বাজারে সাহায্য (শ্যামল চক্রবর্তী: কাশ্মীর)।
পাকিস্তানের সঙ্গে যাওয়ার অসুবিধার কথাও তিনি বলেন— যে সেটি ধর্মীয় রাষ্ট্র, কোনও সংবিধান নেই। নেই সুস্থ রাজনৈতিক ঐতিহ্য। এই সব ভেবে তিনি ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির পথই বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে নেহরু ও শেখ আবদুল্লার মধ্যে যে চুক্তি হয়, তাতে রাজা হরি সিং-এর চুক্তি বলবৎ থাকে। অবশ্যই কিছু পরিবর্তন-সহ। আর এর ফলেই সৃষ্টি হয় ৩৭০ ধারা।
এতে বলা হয়, ভারতের অন্য অঙ্গরাজ্যগুলির ক্ষেত্রে রেসিদুয়ারি পাওয়ার অফ লেজিসলেশন থাকবে কেন্দ্রের হাতে। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরের থাকবে রাজ্যেরই হাতে। কারা স্থায়ী অধিবাসী তা নির্ণয়ের ক্ষমকা থাকবে রাজ্যের আইনসভার। সরকারি কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও থাকবে বিশেষ অধিকার। ভারতের জাতীয় পতাকা ও কাশ্মীরের রাজ্যের পতাকা পাশাপাশি উড়বে।
অর্থাৎ, এই ৩৭০ ধারা ছিল নেহরুবাদী সেকুলার রাষ্ট্রদর্শনের এক বাতিস্তম্ভ। মোদীর রাষ্ট্রদর্শন সেই নেহরুবাদী মডেল বদলে দিয়ে এক নতুন হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় আখ্যান প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। আসলে এই সরকার মনে করে, এই আখ্যান কোনও কাউন্টার বা প্রতিকল্প নয়, আসলে এটাই সনাতন ভারতীয় চেহারা। এদের কাছে নেহরুবাদী মডেল ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আবরণে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ।
কিন্তু ভারতের ঐতিহ্যের মূলেই রয়েছে বৈচিত্র। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়— সকল ক্ষেত্রেই বিভিন্নতা ভারতীয়ত্বের প্রতীক। এ ভাবেই ভারতের জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। তা কখনওই এক ছাঁচে ঠেলে দেওয়া হয়নি। তাই এই ভাবে কাশ্মীরের অথনৈতিক-রাজনৈতিক মঙ্গলের যে কাহিনি শোনানো হচ্ছে, তার কত দূর বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
কাশ্মীরের হিংসা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী মতবাদ এ ভাবে কমবে, না কি এর আরও বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে— তা সময়ই বলবে। তবে যে ভাবে রাজ্যের সংবিধান সভার অনুপস্থিতিতে ৩৭০ ধারা বিলোপের আদেশ কার্যকর করা হল, তাতে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রক্ষমতার ভয় থেকেই যায়।
লেখক ইতিহাসের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy