নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র
নরেন্দ্র মোদী ব্যক্তিমাত্র নহেন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং তাঁহার কথা শুনিতেই হয়, তাহা লইয়া ভাবিতেও হয়। বল্লভভাই পটেলের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি বলিয়াছেন, পাকিস্তান যুদ্ধ করিয়া ভারতের সহিত আঁটিয়া উঠিতে পারে না, তাই (কাশ্মীরে এবং অন্যত্র সন্ত্রাস সৃষ্টি করিয়া) ভারতের ঐক্য ও সংহতি বিনাশ করিতে চাহে। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধপ্রতিভার তুল্যমূল্য বিচার আপাতত মুলতুবি থাকুক, ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডির নায়করা যে ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী আক্রমণে ধারাবাহিক ভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত দিয়া চলিয়াছে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কাশ্মীরে অশান্তি ও সংঘাত যত বেশি হইবে, পাকিস্তানের শাসকদের তাহাতে ততই সুবিধা— ইহাও সুবিদিত। বস্তুত, কাশ্মীর সমস্যা না থাকিলে সেই দেশের অতিশক্তিমান সেনা এবং গোয়েন্দা বাহিনীর গুরুত্ব বিস্তর কমিয়া যাইবে। সুতরাং পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধ্বংসাত্মক ভূমিকা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ যে সত্য, তাহা বালকেও জানে।
কিন্তু প্রতিপক্ষকে ঠেস দিয়াই প্রধানমন্ত্রী পরিতৃপ্ত থাকিবেন? পাকিস্তান পাকিস্তানের কাজ করিতেছে, ভারত কী করিতেছে? জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-এর কথা ধার করিয়া বলা যায়: মোদী কী করিতেছেন? তাঁহার আবেগাপ্লুত উক্তি: তিন দশকে সন্ত্রাসী আক্রমণে চল্লিশ হাজারের অধিক ভারতবাসী প্রাণ হারাইয়াছেন। আবেগ অসঙ্গত নহে, কিন্তু কাঁদিয়া অথবা রাগ দেখাইয়া তো প্রধানমন্ত্রীর কাজ ফুরাইতে পারে না। নরেন্দ্র মোদীর মহাশক্তিধর সরকার কেন এই সন্ত্রাসের কবল হইতে অসহায় ভারতবাসীকে বাঁচাইতে ব্যর্থ? কেন্দ্রীয় শাসনাধীন (এখন সরাসরি কেন্দ্রশাসিত) কাশ্মীরে গত সপ্তাহে যে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিল, তাহা নিবারণ করিতে না পারিবার দায় তো তাঁহার প্রশাসনেরই। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ: সম্মুখসমরে না পারিয়া পাকিস্তান চোরাগোপ্তা সন্ত্রাস চালাইতেছে। কিন্তু সন্ত্রাসের ধর্মই তো অতর্কিত আক্রমণ। ‘অ্যাসিমেট্রিক ওয়রফেয়ার’ বা অসম যুদ্ধের এই মৌলিক চরিত্রটি লইয়া গত দুই দশকে কাহন কাহন আলোচনা হইয়াছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাহার খবরই রাখিবেন না? সন্ত্রাসী আক্রমণ হইতে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে না পারিয়া জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আবেগের ফানুস উড়াইয়া দায় সারিবেন?
ছেঁদো কথা ছাড়িয়া সমস্যার শিকড়ে পৌঁছাইতে চাহিলে প্রধানমন্ত্রী ও সহকর্মীদের মানিতে হইবে, পাকিস্তান সমস্যার সদ্ব্যবহার করিতেছে মাত্র। সমস্যাটি কাশ্মীরের ইতিহাসে নিহিত। ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত চাপাইয়া সেই ইতিহাস বদলাইবার খোয়াব দেখিলে তাহা দুঃস্বপ্নে পরিণত হইবার আশঙ্কা অতি প্রবল। ইতিহাসের কানাগলি হইতে সুস্থিতির পথে পৌঁছাইতে চাহিলে প্রথম প্রয়োজন ছিল কাশ্মীরের মানুষের মন জয় করা। তাহার বদলে তাঁহাদের আরও বহু যোজন দূরে ঠেলিয়া দিয়াছে অমিত শাহের দণ্ডাদেশ। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং বঞ্চনাবোধ এই তিন মাসের অবরোধে কী পরিমাণে বাড়িয়া থাকিতে পারে, যে কোনও নিরপেক্ষ সমীক্ষা তাহার ছবিই তুলিয়া ধরিতেছে। এই অবস্থা ‘চলিতে পারে না’— জার্মান চ্যান্সেলরের মন্তব্যটি নিতান্ত কাণ্ডজ্ঞানের কথা। কিন্তু শাসকরা এই বাস্তব সম্পর্কে হয় নির্বাক অথবা তারস্বরে তাহা অস্বীকার করিতেছেন। কাশ্মীরে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’র বিজ্ঞাপন বানাইতে বাছাই করা বিদেশি পর্যটকদের ডাল লেকে শিকারায় চড়াইয়া ‘কাশ্মীর কি কলি’-র রিমেক করিতেছেন। ঢের হইয়াছে, নরেন্দ্র মোদী অন্তত এই বার তাঁহার আসনখানির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হউন। বল্লভভাই পটেল তাঁহার কাজ সাধ্যমতো সম্পন্ন করিয়া অনেক আগে গত হইয়াছেন। পটেল-কীর্তন থামাইয়া প্রধানমন্ত্রী সপারিষদ নিজের কাজে মন দিন। এখনও তাহা না দিলে সবচেয়ে উপকার হইবে— পাকিস্তানের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy