ক্ষুধাকে জয় করিবার উদ্দেশ্যেই মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন, কিন্তু এত বৎসরেও সেই প্রাচীন শত্রু পরাভূত হয় নাই। গত বৎসর বিশ্বের ৭৮০ কোটি জনসংখ্যার ৩০০ কোটি পর্যাপ্ত পুষ্টিকর আহার পায় নাই, অনাহার ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত অন্তত ৬৯ কোটি মানুষ। এখন অতিমারির সুযোগে ক্ষুধা দ্রুতবেগে তাহার প্রকোপ বাড়াইতেছে। তাহার মোকাবিলা করিতে হইলে কেবল স্থানীয় পুষ্টিপ্রকল্পে কিছু বাড়তি বরাদ্দের মাপে ভাবিলে চলিবে না। খাদ্যসংস্থান এবং অপুষ্টি-নিবারণের সমস্যা বিশাল আকার লইয়াছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সতর্ক করিয়াছে, এ বৎসরের শেষে তেরো কোটি এমন মানুষকে ক্ষুধায় বাঁচিতে হইতে পারে, অতিমারি না ঘটিলে যাহাদের সেই দুর্দশা ঘটিত না। ইহাদের মধ্যে বেশ কিছু ভারতবাসীও থাকিবে, তাহা প্রায় নিশ্চিত। আক্ষেপ ইহাই যে, ভারত ক্ষুধা নিবারণের কাজে যখন ধীরে কিন্তু নিশ্চিত গতিতে অগ্রসর হইতেছিল, তখনই অতিমারি ফের পিছাইয়া দিবার উপক্রম করিল দেশকে। রাষ্ট্রপুঞ্জ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০১৮ সালের তুলনায় ভারতে অনাহার-অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ছয় কোটি কমিয়াছে ২০১৯ সালে। এই সাফল্য উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, সামগ্রিক ভাবে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি বাড়িয়াছে। বহু ব্যয়ে ও পরিশ্রমে যে মানুষদের দারিদ্র ও অপুষ্টির ফাঁদ হইতে রক্ষা করা গিয়াছিল। এখনই সতর্ক না হইলে তাহাদের আবার ফিরিতে হইতে পারে সেই অন্ধকূপে। অতএব করোনাভাইরাস অতিমারির মোকাবিলার মতোই, তজ্জনিত ক্ষুধা-অপুষ্টির মোকাবিলাতেও আন্তর্জাতিক স্তরে নীতি গ্রহণ করা দরকার।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথাটি ইহাই যে, সমাধান সাধ্যের বাহিরে নহে। রাষ্ট্রপুঞ্জ মনে করাইয়াছে, ধরিত্রী অকৃপণ। হাজার কোটি মানুষের ক্ষুধানিবারণের মতো খাদ্য উৎপন্ন করা সম্ভব। দারিদ্র, অসাম্য, অনুন্নয়নের কারণে ক্ষুধিত মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছানো যায় নাই। অন্ন দিতে হইলে অসাম্য-সৃষ্ট বঞ্চনাগুলি দূর করিতে হইবে, প্রতিটি নাগরিকের নিকট তাহাদের মৌলিক প্রয়োজনগুলি পৌঁছাইতে হইবে রাষ্ট্রকে। তাহার মধ্যে সর্বপ্রথম অবশ্যই খাদ্য। ভারতে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলির কয়েকটি অতিমারিতে প্রায় অচল হইয়া পড়িয়াছে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং বিদ্যালয়গুলিতে শিশুদের জন্য যে গরম, পুষ্টিকর খাবার পরিবেশিত হইত, তাহা বন্ধ হইয়াছে। অভিভাবকদের চাল-আলু বিলি করিয়া যে মিড ডে মিল-এর অভাব পূরণ করা যাইবে না, তাহা স্পষ্ট। অথচ শিশু-অপুষ্টি ভারতের একটি প্রধান ও মৌলিক সমস্যা। রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষাতেও প্রকাশ, ভারতে সার্বিক ক্ষুধার প্রকোপ কমিলেও, শিশুদের বৃদ্ধির হার আশাপ্রদ নহে। অতএব শিশু-অপুষ্টি নিবারণে এখনই তৎপর হইতে হইবে ভারতকে। তাহার একটি উপায়, ভাইরাস-প্রতিরোধে সতর্ক ও যত্নশীল হইয়া রান্না-করা খাদ্য ঘরে ঘরে সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করিয়া দেওয়া। স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং তৃণমূল স্তরে সরকারি কাজের সহিত যুক্ত কর্মীদের এই কাজে ব্যবহার করা যাইতে পারে।
কিন্তু সার্বিক পুষ্টিবিধানের কাজটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। সরকার খাদ্য নিরাপত্তা বলিতে বোঝে চাল-গম প্রভৃতি খাদ্যশস্য সুলভে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ। অথচ প্রোটিন ও ভিটামিনের ঘাটতি ভারতে অপুষ্টির প্রধান কারণ। ডাল-ডিম-মাছের মতো প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, এবং বিবিধ তরিতরকারির যথেষ্ট জোগান বজায় রাখিতে, এবং তাহাদের দাম সাধ্যের মধ্যে রাখিবার লক্ষ্যও গ্রহণ করিতে হইবে সরকারকে। খাদ্যনীতি কেবল রেশননীতি হইয়া থাকিলে চলিবে না, তাহাকে সার্বিক পুষ্টিবিধানের নীতি হইতে হইবে। না হইলে অতিমারির ভয় কাটিলেও, অপুষ্টির নীরব মহামারি দেশকে দুর্বল করিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy