পেঁচাশিমূল গ্রামের অর্চনা মণ্ডল, নয়নতারা মণ্ডলরা দেখে নেন, বাঁকুড়ার ছাতনায় আজ বৃষ্টি হবে কি না
মোবাইলটা একবার দ্যাখ দেখি ঠাকুরঝি, আজ চালে নুন মাখাব কি না। পাঁজি নয়, ফোন। তিথি-নক্ষত্র নয়, আবহাওয়ার পূর্বাভাস। এমন করেই বদলে যাচ্ছে বাংলার মাসি-পিসিদের চাহিদা। সকাল সকাল চালে নুন মাখিয়ে রোদ্দুরে বেশ করে শুকিয়ে বিকেলে ভাজলে ফুটফুটে মুড়ি হয়। কিন্তু বৃষ্টি পড়ে যদি? সব নষ্ট। তাই পেঁচাশিমূল গ্রামের অর্চনা মণ্ডল, নয়নতারা মণ্ডলরা দেখে নেন, বাঁকুড়ার ছাতনায় আজ বৃষ্টি হবে কি না।
যদি মোবাইল বলে, বৃষ্টি আসতে পারে? তা হলে চালে নুন মাখানো তো চলবেই না, ছাগলও পাঠানো যাবে না দূরে চরতে। ভিজলে সর্দি করবে। চারা মাছ ছাড়া যাবে না পুকুরে, ঠান্ডায় মরে যাবে। সব্জি তুললে পচে নষ্ট হবে। কাপড় ক্ষার-কাচা বন্ধ। ছুটতে হবে পাঁজা-করা শুকনো কাঠ ঘরে তুলতে। তুচ্ছ বুঝি? ভিজে কাঠে উনুন ধরান দেখি।
গত দু’বছর ধরে বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লক আর পুরুলিয়ার কাশীপুর ব্লকের পাঁচটা গ্রাম পঞ্চায়েতের বারো হাজার পরিবারের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে মেসেজ। চল্লিশটা মৌজায় বোর্ডেও লিখে দেওয়া হচ্ছে, ব্লকে আগামী পাঁচ দিন বৃষ্টি হবে কি না, কেমন থাকবে আর্দ্রতা, কোন দিক দিয়ে বইবে হাওয়া। তবে এত দিন মোবাইল মেসেজ ছিল মিনি মাগনা। এই আষাঢ় থেকে দিতে হচ্ছে বছরে একশো আশি টাকা। সেচহীন, অনুর্বর, ঢালু জমিই যাদের বেশি, সে সব চাষির কাছে টাকাটা খুব কম নয়। তাঁরা কি আগ্রহী?
যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই প্রকল্পের দায়িত্বে, তার প্রতিনিধি সুজিত মিত্র আশাবাদী। প্রথম মাসেই চারশো জন টাকা দিয়েছেন, ধান রোয়ার সময় পেরোলে আরও অনেকে দেবেন। সবাই নগদে নয়। কেউ কুড়ি কুইন্টাল ধান, কেউ এক দিনের শ্রম দেবেন। ছোট চাষির ঘরে নগদ টাকার বড় টান। কিন্তু টানাটানির সংসারেও যে আবহাওয়ার খবর মূল্যবান, তার একটা আভাস মিলছে।
সুজিতবাবু বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম, আগাম পূর্বাভাসের খদ্দের হবেন চাষিরাই। তার পর দেখি, ক্রেতারা বিচিত্র।’’ নিজেদের ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছেন রাজমিস্ত্রিরা। বৃষ্টি আসবে জানলে ঢালাই সেরে রাখবেন, খরচ করে ছাদকে জল খাওয়াতে হবে না। খবর চান স্থানীয় ইটভাটার মালিকরাও। বৃষ্টিতে কাঁচা ইট গলে গেল মানে টাকাগুলো গেল। বৃষ্টির দিন গড়বেতার জঙ্গলে চালতা পাতা তুলতে যাবেন না কাশীপুরের নামাগোড়া গ্রামের আদিবাসী মেয়েরা। তাঁরা অবশ্য পড়তে পারেন না। গ্রামের সুখমণি হাঁসদা সপ্তম শ্রেণি পাশ, তিনি বোর্ড পড়ে বলে দেন, আজ জঙ্গলে গেলে ভিজতে হবে কি না।
শ্রাবণের সকাল। আজ ‘হালকা বৃষ্টি’ আর আগামী দু’দিন ‘বজ্র-সহ মাঝারি বৃষ্টি’, জেনেই সুখমণি ভোর না হতে করলা ভাজা আর মাড়ভাত রেঁধে খাইয়ে বরকে মাঠে পাঠিয়েছেন। চাষিরা জানালেন, কাল-পরশু বৃষ্টি হবে জানলে ধান রোপণ করেন তাঁরা। প্রথম সেচের খরচটা বাঁচে। এই রুখুশুখু এলাকায় পাম্পে বিদ্যুৎ নেই, ডিজ়েলের খরচ অনেক। একটা-দুটো সেচ বাঁচলে চাষির অনেক লাভ। বৃষ্টি হবে জানলে কীটনাশক স্প্রে করেন না চাষি, ধুয়ে যাবে। ঝড় আসছে জানলে বীজ পোঁতা বন্ধ। উপরের মাটি উড়ে গেলে বীজ নষ্ট হয়।
ব্লক-ওয়ারি পূর্বাভাসের এই প্রকল্প চলছে ‘নাবার্ড’-এর অনুদানে। বাঁকুড়ায় ‘নাবার্ড’ আধিকারিক সোমনাথ ভট্টাচার্য জানালেন, অগস্ট মাসে বৃষ্টি হবে ধরে মাঠে নামেন চাষি। ২০১৬ সালের অগস্টে কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ার পূর্বাভাস পেয়ে ছাতনার অনেক চাষি বীজ না পুঁতে ঘরে রেখেছিলেন। ২০১৭ সালে আমন ধান পেকে এসেছে, বৃষ্টির খবর এল। চটপট ধান কেটে ফসল বাঁচালেন বেশ কিছু চাষি। আবহাওয়ার হেরফেরের জন্য চাষির ক্ষতি কমানোই প্রকল্পের লক্ষ্য।
কতটা নির্ভরযোগ্য এই পূর্বাভাস? প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আবহাওয়া বিজ্ঞানী কৈলাস পান্ডে বলেন, ভারতের একশো ছ’টি ব্লকে এই প্রকল্প চলছে। স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের তথ্য নিয়ে দেখা যাচ্ছে, ৮৫-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে মিলছে পূর্বাভাস। কী করে? ব্লকে দশ কিলোমিটার অন্তর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসানো হয়েছে, যা তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, হাওয়ার গতি মেপে চলেছে। তার সঙ্গে আবহাওয়া দফতরের তথ্য মিলিয়ে একটি গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস তৈরি করছেন। চাষিদের দেওয়া হচ্ছে জলবায়ু অনুসারে চাষের পরামর্শও। আগামী পাঁচ দিনে যেমন উষ্ণতা ও আর্দ্রতা, তাতে কোন পোকা লাগতে পারে। কোন কীটনাশক চাই।
চাষিরা কী বলছেন? ঝুঁঝকার পোড়াডিহা গ্রামের চাষিরা বললেন, ‘‘বোর্ডের লেখা মিলছে তো বটে, কিন্তু পিচ রাস্তার ও দিকে বৃষ্টি হয় তো এ দিকে হয় না। ওই দেখুন না, জিড়রায় ট্র্যাক্টর চলছে। এ দিকে জলই দাঁড়ায়নি।’’ সাগর মণ্ডল, দুলাল রায়ের মতো চাষিদের দাবি, দশ কিলোমিটার এলাকার হিসেবে হবে না। পাঁচ কিলোমিটারে নামাতে হবে। মানছেন সুজিতবাবুও। ‘‘শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে যন্ত্রে বৃষ্টির যে পরিমাণ পাচ্ছি, সাত কিলোমিটার দূরের ঝুঝকা গ্রামে বসানো যন্ত্রে পাচ্ছি প্রায় ত্রিশ শতাংশ কম।’’ বাঁকুড়ার কৃষি আধিকারিক আশিস বেরা জানালেন, পাঁচবাগায় সরকারি জলবায়ু স্টেশনের পরিসংখ্যান অনুসারে জেলায় যে দিন গড়ে দু’শো মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, সে দিনই বড়জোড়ায় বৃষ্টির পরিমাণ আঠারো, বিষ্ণুপুরে দশ, কোতুলপুরে ছয়। গড় বৃষ্টি দিয়ে জেলার চাষের পরিস্থিতি বিচার করা অসম্ভব হয়ে উঠছে।
বিজ্ঞান বলছে, বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র কণা (এয়ারোসোল) বাড়ার জন্য এত হেরফের হচ্ছে জলবায়ুর। তা হলে ‘গাঙ্গেয় উপত্যকার পূর্বাভাস’, ‘দামোদর অববাহিকায় বৃষ্টির সম্ভাবনা’ জেনে চাষির লাভ কী? নিজের এলাকায় কখন কত বৃষ্টি, জানতে হবে। তা থেকে স্থির করতে হবে, স্বল্পমেয়াদি ধানের প্রজাতি বাছা দরকার না দীর্ঘমেয়াদি, কোন বিকল্প চাষ লাভজনক হতে পারে। বিজ্ঞান চাষের ঝুঁকি কমিয়ে ক্ষুদ্র চাষির সক্ষমতা কতটা বাড়াতে পারে, সেটাই হল প্রশ্ন। ছাতনা আর কাশীপুর প্রতি দিন তার উত্তর সংগ্রহ করে চলেছে।
তা বলে বৃষ্টির আগাম খবরে সবাই কি খুশি? পোড়াডিহার মায়েদের মুখ ভার। ‘‘ম্যাডাম যাবার সময় বোর্ড দেখে যায়। বৃষ্টি দেখলে আর আসে না।’’ চালাঘরে অঙ্গনওয়া়ড়ি, বৃষ্টি হলে রান্না বন্ধ। চিনি-মাখা ছাতুও জোটে না। বাংলার গ্রামে গ্রামে কত যে লাভক্ষতির অঙ্ক লেখে বৃষ্টির জল।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy