—ফাইল চিত্র।
লাল জ্যাকেট-পরা বছর দুয়েকের মেয়েটা কাঁদছিল হাপুস নয়নে। সদ্যই মায়ের সঙ্গে নদী পেরিয়ে আমেরিকার সীমান্তে নেমেছে সে। নামামাত্র সীমান্তরক্ষীর সামনে। বেআইনি অনুপ্রবেশ। তাই তল্লাশি হবে মায়ের। নির্দেশ এল, মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে দেওয়ার। আর মেয়ে মাটিতে নেমেই ভ্যাঁ। ওই এক মুহূর্তের মধ্যে কী করে যেন ছোট্ট প্রাণটাও বুঝে নিয়েছিল, তার পরম নিরাপদ আশ্রয়টুকু এ বার হারাতে বসেছে।
এর পরের কাহিনি আন্দাজ করে নিয়েছিলেন আলোকচিত্রী জন মুর। মেয়ের কান্নার সেই ছবি তুলেছিলেন তিনি। ‘ক্রাইং গার্ল ইন দ্য বর্ডার’— ভাইরাল হয় সে ছবি। পুরস্কৃত হন মুর। সাক্ষাৎকারে জানান, ছবি তোলার সময় বুক মুচড়ে উঠেছিল তাঁর মতো পোড়খাওয়া ফোটোগ্রাফারেরও। তিনিও যে সন্তানের বাবা! পেশার সূত্রে জানতেন, শিগগিরই মায়ের কোলছুট হবে বাচ্চাটি। আমেরিকার সীমান্ত পেরনো হাজার হাজার শরণার্থীদের সঙ্গে যা প্রতিনিয়ত ঘটছে। অথচ, সীমান্ত পার হওয়ার মুহূর্ত অবধি শরণার্থী মা-বাবারা জানতেনই না সেই নীতির কথা— ‘জ়িরো টলারেন্স’। তার মধ্যেই তো ছিল সেই নির্দেশ— জিজ্ঞাসাবাদ পর্বে বাচ্চাদের আলাদা করে দেওয়া হবে মা-বাবার কাছ থেকে। তার পর হয়তো মা-বাবাকে ঠেলে পাঠানো হবে সীমান্তের ও-পারে। এ-পারে আটকে রাখা হবে সন্তানদের। মধ্য আমেরিকার ভয়ঙ্কর দারিদ্র, নির্যাতনের হাত থেকে পালিয়ে একটু ভাল ভাবে বেঁচে থাকার আশায় যাঁরা পা রেখেছিলেন মার্কিন মুলুকে, তাঁদের মোক্ষম শাস্তি এ ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে!
আর সেই কোলছুট শিশুরা? অন্য দেশ, অন্য পরিবেশে এসে চেনা মুখগুলো হারিয়ে, রাশভারী জেরার মুখে কেমন থেকেছে তারা? ভাবার জন্য কল্পনাবিলাসী হতে হয় না। সন্তানের প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটিতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা শিশুর কী অবস্থা হয় ভাবলেই বুঝব, শরণার্থী শিশুরা অনির্দিষ্ট কালের এই বিচ্ছেদ নিয়ে কেমন করে বাঁচছে। ট্রাম্পের নীতি সমালোচনা কুড়িয়েছে বিস্তর। প্রতিপক্ষ তো বটেই, তাঁর দলও বিরোধিতা করেছে। কান্নামাখা শরণার্থী শিশুর ছবি দেখে এ দেশে আমরাও চোখ মুছেছি।
তবে চোখ মুছে এ বার একটু নিজের দেশের কথা ভাবি? অসমে এনআরসি নিয়ে ওই রাজ্যের বাইরে ক’খানা অ-রাজনৈতিক গলা নির্ধারিত ডেসিবেল ছাড়িয়েছে এ পর্যন্ত? অথচ, ঘটনাটা তো আমেরিকার চেয়ে আলাদা নয়। এখানেও তো সেই পরিবার ভাঙারই খেলা। তফাত একটাই, ওখানে খেলুড়ে বিদেশি সরকার। আর এখানে খেলুড়ে নিজের দেশটাই। এত দিন ধরে গুছিয়ে ঘরকন্না সাজিয়ে ফেলার পর হঠাৎ কিছু পরিবারকে বলে দেওয়া হল— এ দেশটা তোমাদের সবার জন্য নয়। এই পরিবারের কয়েক জন ভারতীয়। বাকিরা হলে শরণার্থী। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেল মা ঠাঁই পেয়েছেন-মেয়ে পায়নি, নাতনি পেয়েছে-দাদু পাননি, স্বামী পেয়েছেন-স্ত্রী পাননি।
যাঁরা ‘দেশহারা’ হলেন, তাঁদের জন্য অপেক্ষায় এক জটিল আইনি প্রক্রিয়া। আর যাঁরা রয়ে গেলেন? না-থাকাদের জন্য সীমাহীন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা তাঁদের চিরসঙ্গী হল। এনআরসি-তে আখেরে দেশের ভাল হবে, না মন্দ হবে, সন্ত্রাস কমবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, নাকি সব শেষে বিরাট এক অশ্বডিম্ব পড়ে থাকবে— সে সব নিয়ে এখন দীর্ঘ আলোচনা চলবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ভাবা প্রয়োজন সেই পরিবারগুলোর কী হবে, যেগুলো খুব শিগগিরই ভাঙা পড়বে। যাদের মধ্যে থেকে ১৯ লক্ষ মানুষকে কোনও এক দিন স্রেফ চলে যেতে হবে অন্য দেশে বা শরণার্থী শিবিরে। নাম উঠল না যাঁদের, তাঁদের অনেকে জানেনই না, নাগরিকপঞ্জি কেন? শুধু এইটুকুই জানেন, তাঁদের পূর্বপুরুষের অনুপ্রবেশের বোঝা তাঁদের ঘাড়ে এসে পড়ল। কে কবে কোথায় ‘প্রবেশ’ করেছেন, তার হিসেবপত্র মিলুক না মিলুক, অনেক মানুষকে এত দিনের চেনা গণ্ডি, প্রিয় মুখগুলোকে ছেড়ে দিতে হবে। তাঁদের যন্ত্রণাটা কি আমরা বুঝতে পারছি? পারছি না নিশ্চয়। সেই জন্যই অসমের পর পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হবে, নেতাদের এই হুঙ্কারে প্রীত হচ্ছি। অনেক মানুষ ভিটেছাড়া হয়ে যাবে, এই ভেবে শিউরে ওঠার বদলে বিজাতীয় আনন্দ উপভোগ করছি।
অন্যের পরিবার ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা বুঝি না বলেই তো কাশ্মীরে রাষ্ট্র যে ভাবে ‘মানবাধিকার’ শব্দটাই মুছে দিচ্ছে, তা নিয়েও প্রতিবাদ করি না। শয়ে শয়ে তরুণ কাশ্মীরিকে পরিবারের মধ্যে থেকে জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, গোটা উপত্যকার অস্তিত্বকে পরিচয়পত্রের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, নিজভূমে পরবাসী হয়ে বেঁচে আছেন কাশ্মীরিরা— অথচ ক’টা কথাই বা খরচ হয় তাঁদের নিয়ে! ৩৭০ ধারা বিলোপের পর শিশুসন্তান-সহ থানার বাইরে অপেক্ষমাণ যে কাশ্মীরি তরুণীর ছবি ছাপা হয়েছিল সংবাদপত্রে, যাঁর স্বামীকে সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছে, তাঁর ভয়ঙ্কর উদ্বেগ, অসহায়তাকে কি ছুঁতে পেরেছি আমরা? গোটা উপত্যকাকে আড়ালে ডাকা হয় ‘আধা-বিধবা’র দেশ বলে। আধা-বিধবা, অর্থাৎ যাঁর স্বামীকে পুলিশ-সেনা তুলে নিয়ে গিয়েছে কোনও এক রাতে। তাঁর লাশেরও আর খোঁজ মেলেনি।
অথচ, দেশজোড়া নাগরিক সমাজের যেন ঠোঁটে আঙুল। তাঁরা কি সকলেই রাষ্ট্রের দেখানো পথেই বিশ্বাস করেন যে, কাশ্মীরে ঘরে ঘরে সন্ত্রাসবাদীর ডেরা, তাই সে সব ঘর ও পরিবার ভেসে গেলেও ক্ষতি নেই? কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতা মহম্মদ ইউসুফ তারিগামি এই প্রশ্নই করেছেন বাকি দেশকে।
পুজো আসছে। আশ্বিনের এই সময়টা বড় খুশিমাখা। ঢাকের বাদ্যি আর কাশের শুভ্রশোভার সঙ্গে সময়টা পুনর্মিলনেরও বটে। ঘরছুটদের ঘরে ফেরার সময়। অথচ— এ বারের শরৎ কিন্তু দেশ হারিয়ে ফেলার, বন্দি হওয়ার ঋতু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy