Advertisement
১১ জানুয়ারি ২০২৫

সম্পত্তিতে সমান অধিকার যাঁদের

সম্পত্তির উত্তরাধিকারে হিন্দু ছেলেমেয়েদের সমান অধিকার দিয়েছে আইন। কিন্তু আইন কি সমাজ-মনকে আজও পাল্টাতে পারল?

আফরোজা খাতুন
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

এ রাজ্যে মুসলিম মেয়েদের সমস্যা: পিতার সম্পত্তির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মতো আইন নেই। আর হিন্দু মেয়েদের সমস্যা, আইন থাকলেও মিলছে না অধিকার। কখনও বাধা বাইরের, কখনও বা মেয়েদের অন্তরের। পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকার দাবি করা অন্যায়, এই চিন্তাটা এখনও কাজ করছে ঘরে-বাইরে।

সম্পত্তির উত্তরাধিকারে হিন্দু ছেলেমেয়েদের সমান অধিকার দিয়েছে আইন। কিন্তু আইন কি সমাজ-মনকে আজও পাল্টাতে পারল? শিক্ষক অমিতা মণ্ডল মুর্শিদাবাদের গোয়ালজানের মেয়ে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পৈতৃক সম্পত্তি তো ভাই-বোনের মিলিত পরামর্শে ভাগ হবে। কিন্তু ছেলেদের সরাসরি অধিকার বর্তায়, সে তারা বিবাহিত বা অবিবাহিত যা-ই হোক না কেন। বিয়ের পর মেয়েরা হয়ে যায় ‘বহিরাগত’। যা ছিল নিজের বাড়ি, তাকে বলতে হয় ‘বাবার বাড়ি’। মেয়েদেরকে যা দেবে তা-ই যদি হাত পেতে গ্রহণ করে, তবেই ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকবে। আর যদি পৈতৃক সম্পত্তিতে নিজের ভাগ বুঝে নিতে চায়, তা হলে সমাজের চোখে সে লোভী। বোনদের সম্পত্তি যে ভাইরা ভোগদখল করছে, তারা লোভী নয়। কেন এই একচেটিয়া মানসিকতা? আর্থিক নিরাপত্তা, আশ্রয়ের দরকার মেয়েদের নেই?’’

এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বলে অমিতাদের তিন বোনের সঙ্গে ভাইদের সম্পর্ক ছেদ হয়েছে। ভাইরা তাঁদের মর্জিমতো কিছু টাকা দিয়ে মিটমাট করতে চেয়েছিলেন। বোনেরা গ্রহণ করেননি। অমিতা মনে করেন, মেয়েদের বিয়ের খরচকে তাদের প্রাপ্য সম্পত্তির ভাগ বলে মনে করে পরিবার। অথচ বিয়ের খরচ নিয়ে সামাজিক প্রতিপত্তি দেখানোর প্রতিযোগিতা চলে। মেয়ের হাতে কী থাকে? ‘‘যা অধিকার, তাকে দান হিসেবে গ্রহণ করা বড় অপমানের’’, মনে করেন শিক্ষিকা লিলি দত্ত। যে ছেলে বিদেশে চাকরি করেন, বৎসরান্তেও বাড়ি ফেরেন কি না ঠিক নেই, বাবা-মা সেই ছেলেকেও বাড়ির ভাগ দেবেন। মেয়ে নিয়মিত এলেও বাড়ির অংশ দিতে চান না। ‘বাইরের লোক’ বাড়িতে ঢোকানো যেন উপদ্রব। এই ভাবনা লালন করলে সমান অধিকার আসবে কি শুধু আইন-আদালত করে? অনেক বাবা-মা মনে করেন, মেয়েকে খরচ করে লেখাপড়া শিখিয়েছি, বিয়ে দিয়েছি। সম্পত্তির ভাগ দেব না। কিন্তু ছেলেদেরও লেখাপড়া শিখিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হয়, তখন তো এই প্রশ্ন ওঠে না?

চিত্রটা সব জায়গায় এক নয়। বর্ধমানের নমিতা দেবীকে বাবা লিখে দিয়ে গিয়েছেন তাঁর ভাগের সমস্ত সম্পত্তি। সম্পত্তির পরিমাণও অনেক। কিন্তু নমিতা দেবী কানাকড়িও নেবেন না। তিনি মনে করেন, বাবার বাড়ির সম্পত্তি নিলে স্বামীর নিন্দা হবে। গ্রামের লোক, আত্মীয়স্বজনের কাছে স্বামীকে ‘বিত্তশালী’ প্রমাণ করবেন বলেই হয়তো তিনি ঠিক করেছেন, ভাইদের সব সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবেন। নইলে লোকের সামনে নাকি মুখ দেখাতে পারবেন না। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় লালিত নমিতা দেবীর মতো মহিলারা স্বামীর আশ্রয়ই মেয়েদের কাছে গৌরবের বলে মনে করেন। সমাজ মেয়েদের শেখায়, নিজের সম্পত্তি গ্রহণ করা অসম্মানের ব্যাপার।

১৯৫৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনকে ২০০৫ সালে সংশোধন করা হয়েছে। এই সংশোধিত আইন অনুযায়ী এ দেশের হিন্দু মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির সমান অধিকার ভোগ করবেন। কথা বললাম কিছু ছাত্রীর সঙ্গে। শুনতে চাইলাম এই প্রজন্মের বক্তব্য। বাবা-মায়ের সম্পত্তি বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে সমান ভাগে নেবে কি না? এক ছাত্রী বলল, বিয়ের জন্য এখন থেকে টাকা, গয়না জমাচ্ছে বাবা-মা। পণ তো দিতেই হবে। বিয়েতে এত খরচ হবে, তার পরেও সম্পত্তি চাইলে লোকে বেয়াদব বলবে না? ব্যস, প্রায় সুরে সুর মিলে গেল। মেয়ে হওয়ার জন্য বাবা-মা বাড়তি মানসিক চাপ ও খরচ বহন করেন। তা হলে আর কেন সম্পত্তি নেব। কেউ যদিও বা ভাগ নিতে চায়। কিন্তু না দিলে জোর করা উচিত নয় বলে মনে করছে।

তবে কিছু অধিকার সচেতন ছাত্রীর দাবি অন্য রকম। ওদের বক্তব্য, মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার মানসিক, সামাজিক তাগিদেই অভিভাবকরা পণ দিতে রাজি হন। পাত্রপক্ষের দাবি পূরণ করতে যে টাকা, জিনিসপত্র দেওয়া হয় তা তো শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামীর দখলেই থাকে। পণ তো মেয়ের সম্পদ নয়। কেবল গয়নাটুকু হয়তো তার থাকে। কখনও আবার সেটাও হাতছাড়া হয়ে যায়। পণ দেওয়ার কারণ দেখিয়ে তাই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না। স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তিতে যতটা অধিকার রয়েছে, ততটাই দাবি করা উচিত। ছেলেদের যেমন অর্থের প্রয়োজন আছে, মেয়েদেরও রয়েছে। এই প্রজন্মের মেয়েদেরও যদি অধিকার নিয়ে সচেতনতা না বাড়ে, তা হলে আইন তাদের নিরাপত্তা দেবে কী করে?

মুসলিম মেয়েরা বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে পুরুষ উত্তরাধিকারীদের সমান অধিকার দাবি করে আইন চাইছেন। এই আইন অত্যন্ত প্রয়োজন, কিন্তু অধিকার পাওয়ার লড়াইতে তা প্রথম ধাপমাত্র। নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে গড়েপিটে নিতে না পারলে মেয়েরা কখনওই তাঁদের প্রাপ্য পাবেন না।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন

অন্য বিষয়গুলি:

Women Inheritance Rights
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy