ছবি: সংগৃহীত
শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। দূরদিগন্ত থেকে পরিযায়ী পাখি উড়ে আসার এই তো সময়। উত্তরে হিমেল বাতাসে ভর করে ওরা ভিড় জমায় আমাদের রাজ্যে। সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, হিমালয়ের পাদদেশ, চিন-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পেড়িয়ে এখানে আসে তীব্র শীত ও খাদ্যাভাব থেকে বাঁচার জন্য। নভেম্বর মাস থেকে শুরু করে প্রায় এপ্রিল মাস পর্যন্ত এরা আমাদের অতিথি হয়ে থাকে।
এ সব পাখির বেশির ভাগই জলচর ও হাঁস প্রজাতির। বৃক্ষচারী পাখিও আছে, তবে সংখ্যায় কম। এ তল্লাটে সবচেয়ে বেশি যে পরিযায়ী পাখি চোখে পড়ে, তার নাম সরাল। যদিও এরা ভিন্দেশি নয়, এদেশেরই। বাসস্থানের জলাশয় শীতকালে শুকিয়ে গেলে অন্য জলাশয়ের খোঁজে পাড়ি দেয়। তা ছাড়া প্রজননের অনুকূল আবহাওয়ার জন্যও পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলিতে আগমন ঘটে এদের। জলার ধারে কিংবা ভেজা জমিতে একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়ে মুরহেন, অসপ্রে, গার্ডওয়াল, কাস্তেচরা, কুট, টিল, মান্ডবি, জাকানা, রাঙামুড়ি, চখা-চখি, ভূতিহাঁস, উত্তুরে টিটি, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁসের মতো পরিযায়ীদের। শহুরে কোলাহল থেকে দূরে নিরিবিলিতে বাসা বাঁধতে পছন্দ করে এরা।
এইসব অতিথি পাখিদের জীবন এখন সঙ্কটে। পক্ষীবিশারদেরা এর কারণও খুঁজে বার করেছেন। তাঁদের মতে, এখানে পরিযায়ী পাখিদের বাসস্থান ক্রমে সঙ্কুচিত হচ্ছে। নিচু জমিতে গড়ে ওঠা ঝিল, বিল, প্রাকৃতিক সরোবর ছাড়াও মানুষের তৈরি দীঘি, পুকুরেও এদের আস্তানা। এই জলাভূমিগুলি বর্তমানে ভূমিরাক্ষসদের হাতে দারুণ ভাবে আক্রান্ত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও আমাদের রাজ্যে জলা জায়গায় মাটি, বর্জ্য, ছাই প্রভৃতি ফেলে বুজিয়ে দিয়ে মার্কেট, হাউসিং কমপ্লেক্স, কারখানা, হোটেল ও বিলাসবহুল বাড়ি গজিয়ে উঠছে।
তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। পরিযায়ী পাখিদের অস্তিত্ব সঙ্কটের একটি অন্যতম কারণ হল হত্যা করার প্রবণতা। যে সব পাখির মাংস সুস্বাদু তাদেরই মূলত শিকার করা হয়। গ্রামেগঞ্জে এদের ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হয়। এদেশে পাখি নিধনের ব্যাপারে কড়া আইন থাকলেও মানুষের সচেতনতার অভাবে তা আর সম্পূর্ণরূপে ফলপ্রসূ হয় না।
অন্য দিকে, প্লাস্টিক দূষণ পাখিদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। শুধুমাত্র বিদেশ থেকে আসা পাখিরা নয়, এ দেশীয় পাখিদের জীবনও আজ হুমকির মুখে। বিশেষ করে হাঁস গোত্রীয়রা প্লাস্টিক দূষণের শিকার বেশি হচ্ছে। এর কারণে মা পাখিদের জীবন বিপন্ন তো বটেই, এদের সন্তানরাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অকালে।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে আগত ৯০ শতাংশ পরিযায়ী পাখিদের পরিপাকতন্ত্রে প্লাস্টিক কণা পাওয়া গিয়েছে। প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরো জলে শ্যাওলা-সহ ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং পাখিরা এগুলো খাবার ভেবে গিলে ফেলে। শ্যাওলাযুক্ত প্লাস্টিক কণার গন্ধ পাখির খাবারের গন্ধের মতোই। ফলে তারা খাদ্য-অখাদ্যের মধ্যে তুলনা করতে পারে না। প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ থেকে সাধারণত বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়, যা পাখির দেহের বিভিন্ন কলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় শ্যাওলার আড়ালে ধারালো প্লাস্টিক কণাও থাকে। সেগুলি পাখির গলা দিয়ে পেটে প্রবেশ করার সময় পরিপাকনালির ক্ষতিসাধন করে। এইসব ক্ষেত্রে পাখি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে ও শেষ পর্যন্ত মারা যায়।
এ ছাড়া অনেক পাখি গভীর জলে ডুব দিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। এ সময় তারা প্লাস্টিক ব্যাগ ও পরিত্যক্ত জালে আটকা পড়ে জলের উপরে উঠতে পারে না ও বেঘোরে প্রাণ হারায়। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এ ভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৯ শতাংশ পাখির শরীরই কোনও না কোনও ভাবে প্লাস্টিক দ্বারা আক্রান্ত হবে। স্থলচর অতিথিরা খাদ্যের ব্যাপারে চাষের জমির উপর নির্ভর করে থাকে। আর সেখানেই নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকে তাদের মরণফাঁদ। উন্নত ফলনের আশায় অতিমাত্রায় কৃত্রিম রাসায়নিক বা কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। পাখিরা এই সব দানাশস্য খাওয়ার ফলে ফসলের মধ্যে সঞ্চিত বিষ তাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে স্বাভাবিক জৈবনিক ক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়, যার পরিণাম অকালমৃত্য।
অনেকে আবার পাখির সংখ্যা হ্রাসের কারণ হিসেবে মোবাইল ফোনের টাওয়ারের সংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। মাত্রাধিক তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ স্বল্প মেয়াদে তেমন কুপ্রভাব না ফেললেও দীর্ঘদিনের সংস্পর্শে কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। যে কোনও যোগাযোগ টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিয়ো তরঙ্গ ও মাইক্রোওয়েভ একত্রিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে একটি তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে যা পাখিদের জীবনধারণের পক্ষে বিপজ্জনক। যে সব পাখিরা প্রজননের জন্য এ রাজ্যে আসে তাদের সে ক্ষমতাই হারিয়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ডিম। শহরের আসেপাশে তাই এখন লাল মুনিয়া, নীল কটকটিয়া, পশ্চিমি হলুদ খঞ্জনদের দেখা মেলা ভার।
ইদানীং কালে আর একটি ব্যাপার চোখে পড়ছে। কোনও ঝিল বা বিলের কাছে শান্ত পরিবেশে পরিযায়ী পাখিরা আশ্রয় নিলেই তাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে পিকনিক স্পট। সেখানে বিভিন্ন বিধিনিষেধ সরকারি ও বেসরকারি তরফে উল্লেখ করা থাকলেও তা পরোয়া করেন না অনেকেই। অকারণ হুল্লোর ও আধুনিক ডিজে বক্সের ভয়ানক আওয়াজে পরিবেশ হয়ে উঠছে অশান্ত। তা ছাড়া কিছু মানুষ ইট-পাটকেল ছুড়ে পাখিদের বিরক্ত করার মতো বর্বর আচরণও করে থাকেন। পরিযায়ী পাখিদের কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের বিকাশের সুযোগ থাকলেও বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারায় আমরা তা হারাচ্ছি।
১৯৭২ সালে ভারতের ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন’-এ পরিযায়ী পাখি রক্ষার কথা বলা হলেও অল্প সংখ্যক মানুষ এ সম্পর্কে অবগত। অগত্যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এই সীমিত সংখ্যককেই উদ্যোগী হতে হয়। বিভিন্ন জেলার যে সব জায়গায় পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা সেখানে বিশেষ কর্মশালার মাধ্যমে পাখি হত্যা থেকে বিরত করতে হবে। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশে যে ভূমিকা নিতে পারে সে বিষয়ে অবগত করতে পারলে এদের সুরক্ষার দিকে সবার নজর পড়বে।
এই অতিথিদের আমরা সব রকম সুবিধা হয়তো দিতে পারব না, তবু নিজেদের সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা অন্তত করতে পারি। যত্রতত্র প্লাস্টিক আবর্জনা না ফেলে, জোরালো শব্দ না করে, রাসায়নিক ব্যবহারের মাত্রা কমিয়ে তাদের নির্বিঘ্নে দিনযাপন করার পরিবেশ দিতে পারে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরাই। যে পাখিরা উপকূল রেখা, সূর্যের অবস্থান, নদী-পাহাড় শ্রেণি দেখে পথ খুঁজে খুঁজে এসে কয়েক মাস এখানে আশ্রয় নেয় আমাদের ভরসা করে, তাদের নিরাপদে স্বভূমিতে ফিরতে দেওয়া তো আমাদেরই কর্তব্য।
পক্ষী পর্যবেক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy