আমাদের দেশে ভাষার প্রচারে-প্রসারে দু’নম্বরে থাকবে মিডিয়া। এক নম্বর, শিক্ষার পরেই। মিডিয়ার এত ক্ষমতার কারণ, দেশের প্রায় সর্বত্র পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ এবং তার সঙ্গে রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রাষ্ট্রীয় ঘনিষ্ঠতা কর্তৃত্বের নামান্তর। কোনও রাজ্য সরকার চাইলেও মিডিয়ার হর্তাকর্তাদের সরকারি ভাষায় খবরের কাগজ ছাপতে বলতে পারে। ত্রিপুরায় যেমন। বছর দুয়েক আগে বিজেপি ক্ষমতায় এসে ককবরক ভাষার বদলে হিন্দিতে খবর সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়। কেন? মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের মতে, যারা ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে হিন্দির বিরোধিতা করে, তারা দেশবিরোধী।
পিছন ফিরে তাকালে দেখব, অষ্টাদশ শতকে ঔপনিবেশিক ভারতে প্রথম খবরের কাগজ বেরোয় ইংরেজিতে। ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে ইংরেজি পাঠক বাড়ে, সেই অনুযায়ী বাড়ে সেই ভাষার কাগজ। উনিশ শতকে মোট ১৩০টা কাগজ প্রকাশিত হয় ভারতে।
ভারতীয় ভাষায় প্রথম কাগজও এই শতকেই— ‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৮)। স্বাধীনতা পর্যন্ত ভারতীয় ভাষায় খবরের কাগজ ও পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১২০। তার উদ্দেশ্য ও পাঠক দুই-ই ইংরেজির চেয়ে ভিন্ন ছিল। হয় খ্রিস্টধর্ম প্রচার, নয়তো ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এগুলি তৈরি হয়েছিল। মুনাফা ছিল গৌণ। এগুলির সংখ্যা যত বেড়েছিল, চিন্তা বেড়েছিল ব্রিটিশ শাসকের। অনেকেই ভারতীয় ভাষা বুঝতেন না, তাই এর মাধ্যমে বিদ্রোহের ডাক দেওয়া হচ্ছে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের জন্ম এই ভয় থেকে— ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট ১৮৭৮। বলা হয়েছিল, নির্দিষ্ট প্রতিবেদন ছাপার আগে সরকারের সম্মতি নিতে হবে। কাগজের সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছিল তাতে এতগুলো ভাষার ওপর দখল তৈরি করা বিদেশি শাসকের পক্ষে কঠিন ছিল। তখন বহুভাষিক ভারত বিদ্রোহীদের অস্ত্র, সরকারের গলার কাঁটা।
স্বাধীনতার পর ইংরেজি সংবাদপত্রের সংখ্যা হঠাৎ বাড়ে। মোট খবরের কাগজের পাঁচ ভাগের এক ভাগই হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজি। তখনই প্রথম সংবাদপত্রকে নিশ্চিত ও লাভজনক ব্যবসা বলে ভাবা শুরু হয়। ১৯৫১ সালে অবশ্য যে সংবিধান লেখা হল, তাতে সংবাদপত্র ও বাক্স্বাধীনতার কথা বলা থাকলেও তাকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগও ছিল। কাগজের ওপর নয়, খবরের ওপর খবরদারি। এর চূড়ান্ত চেহারা জরুরি অবস্থা। এর পর আবার অভূতপূর্ব পটপরিবর্তন। শিক্ষা বিস্তার, পুঁজিবাদের উত্থান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ভারতীয় সংবাদপত্রের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি। কেবলমাত্র শহরকেন্দ্রিক পাঠক ছেড়ে সংবাদপত্র ঢোকে গ্রামে-গঞ্জে। সেখানে তাদের সমৃদ্ধিও হয়। এই পথেই আজ ইংরেজি কাগজ ও পত্রিকাকে ছাপিয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে গিয়েছে ভারতীয় ভাষার মিডিয়া। গত দশকের হিসেব, পাঠক সংখ্যার বিচারে এক থেকে দশ নম্বর পর্যন্ত রয়েছে হিন্দি, তেলুগু, মরাঠি, তামিল, মালয়ালম পত্রিকা। প্রথম ইংরেজি কাগজ এগারোয়।
দুই ধরনের কাগজের ফারাক স্পষ্ট। চাকরি বা ব্যবসার প্রয়োজনে, অথবা দেশে বা বিশ্বে কী ঘটছে তা বুঝতে ইংরেজি কাগজের ওপর ভরসা করেন পাঠকেরা। বিজ্ঞানের খবর বা পরিসংখ্যানেও তার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। কিন্তু আঞ্চলিক ও স্থানীয় খবর পেতে ভারতীয় সংবাদপত্রের গুরুত্ব সংশয়াতীত। স্থানীয় সংবাদ সংগ্রাহকেরা অঞ্চলবাসীর মনোভাব এবং আবেগের কথা জানেন, যেটা ইংরেজি অনুবাদে ধরা পড়ে না। ভ্রান্তিও ঘটে। তবে এই গুরুত্বের সবচেয়ে বড় কারণ ভাষা— সহজ ও চলতি বুলির ঢঙে খবর পড়ার আরাম পাঠক উপভোগ করেন। বুলির মতো করে খবর লিখতে গিয়ে হরদম ইংরেজি শব্দও প্রয়োগ করা হয়। যে কোনও বাংলা কাগজের খেলার পাতা খুলে কথাটা মিলিয়ে নিতে পারেন।
এক ভাষা-গবেষক লিখছেন, ভারতে ইংরেজির ব্যবহার ‘জাত ও শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্কিত’। বাংলা কাগজেও বিদেশি গাড়ির বিজ্ঞাপন ইংরেজিতে হতে হয়। অর্থনীতি বিষয়ক অনেক প্রতিবেদন ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে নেওয়া দস্তুর। ইংরেজি কাগজ এলিটের প্রতীক। পাছে কেউ অশিক্ষিত ভাবেন, তাই ভারতীয় ভাষার কাগজ ইংরেজি কাগজ দিয়ে চাপা দিয়ে রাখেন অনেকে। ইংরেজি কাগজ পড়লে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে এই আশায় বাচ্চাদের তা পড়ান অনেক ভাল ইংরেজি না জানা অভিভাবক।
এখনকার বাজারও ভারতীয় ভাষার পক্ষে। পাঠক যে ভাষা, এবং যে ধরনের ভাষা চাইছেন, খবরের কাগজ তা ছাপতে বাধ্য, না হলে তাদেরই ক্ষতি। সরকারও তা বোঝে। ভাষানীতি যা-ই হোক, বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই হয় তাদের। না হলে মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়। শেষ অবধি, ব্যবসাই শেষ কথা। না হলে কাগজ টেকে না।
বহুভাষিক ভারতের প্রতীকস্বরূপ তার সংবাদপত্র জগৎ। এখনও পর্যন্ত মোট ৮৭টা ভাষায় খবরের কাগজ বেরিয়েছে ভারতে। ভারতীয় ভাষার কাগজ এক সময় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধস্বর ছিল, স্বাধীন ভারতে তার ভূমিকা সমাজের সর্বাংশের মুখপত্রের। তার সঙ্গে নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বমহিমায় বিরাজমান কাজের ভাষা ইংরেজিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy