মানুষ এখন তার একান্ত নিজস্ব বিনোদন খুঁজে পেয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।
ধীরে ধীরে উঠছে লকডাউন। শুরু হয়েছে ‘আনলক ১’। তবু অন্য অনেক কিছুর মতোই সিনেমা হল বন্ধ। কবে খুলবে, তার একটা আভাস মিললেও, কবে জনসমাগম হবে বোঝা যাচ্ছে না। অনেক শিল্পী কাজ হারিয়েছেন, তারকারাও কাজের জীবনে ফিরতে না পারায় ম্লান। বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো সিনেমাহলের পাশে একই রকম খাঁ খাঁ করছে মাল্টিপ্লেক্স। সপ্তাহান্তের ভিড়ে উপচে উঠছে না কাউন্টার। রুপোলি পর্দা তার দ্যুতি হারিয়ে স্থির।
কিন্তু তা বলে কি মানুষের সিনেমা দেখায় ভাঁটা পড়েছে? মোটেই না। যার যার মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপে ঠাসা ফিল্ম লাইব্রেরি কতটা সঙ্গ দিচ্ছে একার জীবনে, ফেসবুক খুললেই বোঝা যাচ্ছে। নিত্যনতুন সিনেমা, সিরিজের আলোচনায় মুখর যুবসমাজ। তা হলে, বিনোদনের চাহিদা কমেনি, জোগানও নয়। বিনোদন স্রেফ মাধ্যম পাল্টেছে। আর এই পথ ধরেই বদলে যেতে চলেছে বিনোদনের আঙ্গিক।
যে সমস্ত চলচ্চিত্র ‘হিট’, ‘বক্স অফিসে সাফল্য’ আনে, তাদের অধিকাংশই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। সেখানে বিরাট পর্দায় বিরাট হয়ে দেখা দেন নায়ক, পর্দায় আগুন ধরিয়ে দেন রূপসী নায়িকা। এক-একটা অ্যাকশন দৃশ্যে উড়ে যায় গাড়ি, দশ-বারো জন গুন্ডা। প্রেম আসে বিদেশের বিস্তৃত সুরম্য ল্যান্ডস্কেপে, হলের স্পিকারে গমগম করে ওঠে গান। গায়ে কাঁটা দেয় সকলের, যখন রহস্যের উন্মোচন ঘটে। চোখে জল ঝিলমিল করে সবার, যখন বিচার পায় শোষিত। সকলে একসঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে যখন নায়কের চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে চোখ নামায় নায়িকা। বাহুবলী-দেবসেনার যৌথ লড়াই, কিং খানের দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো, জোকারের শেষ দৃশ্যে নৈরাজ্যের কার্নিভাল, ‘Avengers, assemble’-এর উদাত্ত আবাহন— সমস্ত দর্শকের হলভর্তি প্রতিক্রিয়া নিয়ে অধিকতর সত্য হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: কালী-কৃষ্ণ-রামভক্তের দেশেও ফর্সা হওয়ার দৌড় কেন
কিন্তু আজ, যখন পর্দায় কিচ্ছু নেই, তখন কী নিয়ে থাকবে দর্শক? একটি ওয়েবিনারে সাহিত্যিক সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় এ রকমই এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘কন্টেন্ট’। এখানেই লুকিয়ে আছে লকডাউন পরবর্তী সিনেমা জগতের মূল সূত্র। মানুষ এখন হাতের মুঠোয় কিংবা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনেমা-সিরিজ দেখতে শিখেছে। তার কানে ইয়ারফোন। সে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। এই সময়ে সে আর গ্ল্যামার চায় না, জাঁকজমক চায় না। এখন তার প্রয়োজন, একটা ভাল গল্প। নায়কের পেশী বা নায়িকার সৌন্দর্য যখন ছোট ফ্রেমে সীমাবদ্ধ, তখন তা দিয়ে আর তেমন বিভ্রম তৈরি করা যাবে না। ফলে এ বার মানুষ অভিনয় দেখবে। দেখবে ‘স্টোরিটেলিং’। দেখবে প্রতিটি শট, আলোর কাজ। তীক্ষ্ণতর কান নিয়ে শুনবে সংলাপ। মন দিয়ে যাচাই করবে, কোথায় যাচ্ছে গল্প। এখন আর তাকে ভোলানো তত সহজ নয়।
আরও পড়ুন: ক্রিমওলাদের হঠাৎ বোধোদয় হল, ভাল, কিন্তু কালো-বিদ্বেষী মনটা বদলাবে কি!
পাশাপাশি, এই সময়ে প্রাধান্য পাচ্ছে গল্পে থাকা সূক্ষ্মতর সংবেদন। এক জন দর্শকের নীরবতা, চোখ ভিজে আসা, চাপা কষ্ট, আনন্দে মুখ জ্বলজ্বল করে ওঠা, উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠা— এগুলো এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোটা দাগের হাসিকান্না নয়, এখন স্ক্রিপ্টের শক্তি মানুষের মর্মস্থল স্পর্শ করা। সেইমতো লেখা হচ্ছে গল্প। যে সব সিনেমা বা সিরিজে এই সব উপাদান ছিল, কিন্তু চর্চিত হয়নি, তাদের ফিরিয়ে আনছে মানুষ। ওয়েব পোর্টাল, ওটিটি, ইউটিউব, ডাউনলোডিং সাইট ঘেঁটে। নিজস্ব প্রতিক্রিয়াকে আলোচনায় ফেলছে, মিলিয়ে নিচ্ছে অন্যের সঙ্গে।
লকডাউন সম্পূর্ণ উঠলেও মানুষকে হলমুখো করতে জোরালো ‘কনটেন্ট’ প্রয়োজন। ছবি: সংগৃহীত।
এক দিন সিনেমা হল খুলবে ঠিকই। ফের রুপোলি পর্দা ঝলমলাবে, হাউজফুল হলে বেজে উঠবে প্রোডাকশন হাউজের শীর্ষসঙ্গীত। কিন্তু মানুষের রুচি তত দিনে সূক্ষ্মতায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ঘরমুখী মানুষ, একটি কোণে কুশন পেতে ‘নেটফ্লিক্স অ্যান্ড চিল’ প্রজন্মের মানুষকে যদি হলে ফেরাতে হয়, তাদের যোগ্য সিনেমা প্রয়োজন। তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে আবেগে উদ্বেলিত করতে পারে, এমন গল্প, সংলাপ, অভিনয়, ক্যামেরার কাজ প্রয়োজন। না হলে এই খরা কাটিয়ে সিনেমাশিল্প আগের শক্ত মাটি ফিরে পাবে না।
যে কোনও অসময়ের পর মানুষ কিছুটা সময়ের জন্য প্রখর বাস্তববাদী হয়। সে জানে কোনও হিরো তাকে অসুখ থেকে বাঁচাতে আসেনি। সে জানে কার্ফুর মধ্যে বেরিয়ে পুলিশের লাঠি খেলে হিরোইনের চোখের রং তাকে সান্ত্বনা দেবে না। সে জানে, এখন সত্যিকারের নায়ক-নায়িকারা হাসপাতালে, আপৎকালীন পরিষেবায় ব্যস্ত। সে জানে, কোন গল্প জীবনের। এখন বহু দিন মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখবে না। একটা মানবিক, সংবেদনশীল, মায়ায় ঘেরা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখবে। আগামীর চলচ্চিত্রকারদের কাজ সেই স্বপ্নকে অবয়ব দেওয়া। যদি তাঁরা পারেন, তা হলে এক দিন ফের উপচে উঠবে হল। এক দিন ফের ‘কী খালি মোবাইল দেখিস, চল সিনেমা দেখে আসি’-র আবদার ফিরে আসবে। এক দিন ফের স্ক্রিপ্ট পড়ে আমাদের প্রিয় তারকাদের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠবে।
আশা রাখি, ঘুরে দাঁড়াবে চলচ্চিত্র শিল্প, সময়ের সমস্ত সঙ্কেত সঠিক ভাবে পড়তে পড়তে। কারণ, অন্ধকারের পর আলো খুঁজে পাওয়া ছাড়া আমাদের গতি নেই।
(লেখক শিক্ষাবিদ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy