বোলপুরের একটি স্কুলে বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতামূলক প্রচার। নিজস্ব চিত্র
আমাদের সরকারি স্কুলে বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী থাকে, যারা বহু বিষয়ে উদ্যোগী, কিন্তু বইয়ের পড়া কিছুতেই রপ্ত করতে পারে না। এর জন্য তারা কিছুটা মুখ লুকিয়েই থাকে। সময়ে সময়ে ভালবেসে সাহস করে এরা রাখির দিনে রাখি বাঁধতে আসে, কখনও বা জন্মদিনের চকোলেট দেয়। এরই মধ্যে ঘোষিত ডানপিটে এক মেয়ে, অনেক বকুনি খাওয়ার পরে চুপচাপ এসে বলত—‘পেয়ারা খাবেন? আমাদের গাছের পেয়ারা’। সেই উজ্জ্বল চোখ আর ছেলেমানুষি ভরা মুখ মনে গেঁথে যায়। এরাই তো স্কুলের আঙিনা কলরবে মুখর করে রাখে।
হঠাৎ খবর পাওয়া গেল ডানপিটে সেই মেয়ের বিয়ে হতে চলেছিল, শেষ মুহূর্তে জেলা চাইল্ড লাইন ও প্রশাসন সেই বিয়ে আটকেছে। দুষ্টুমি ভরা চোখ আর কচিমুখের রাঙা চেলি পরা ঘোমটা দেওয়া চেহারা কল্পনা করলে রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ মনে পড়ে যায়। যার মন-শরীর কিছুই তৈরি হয়নি, তাকে সংসারের যূপকাষ্ঠে বলি দেওয়ার উদ্যোগ হয়তো বা এ বার ঠেকানো গেল, কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতেও এমন ঘটনা চলতে থাকছে, ভাবলেই ভয় লাগে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম-দ্বিশতবর্ষের সূচনা হল বলে। বাঙালি সমাজের ব্যতিক্রমী এই মহাপ্রাণ, যিনি আজীবন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়েছেন অত্যন্ত প্রতিকূল সমাজের বিরুদ্ধে। ১৮৯১ সালে তাঁর মৃত্যুর মাত্র চার মাস আগে ব্রিটিশ সরকার সহবাস সম্মতি আইন করে বাল্যবিবাহ বন্ধের সূচনা করে। তার কত পরে ১৯২৯ সালে সারদা আইন বা বাল্যবিবাহ নিষেধের আইন তৈরি হয়। তার পরেও কতকাল গিয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজও বাল্যবিবাহ চলছে।
সারা পৃথিবীর নিরিখে হিসেব করলে প্রতি দুই সেকেন্ডে কোথাও-না-কোথাও বাল্যবিবাহ ঘটে। ন্যাশনাল ফামিলি হেল্থ সার্ভে-৪ এর তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে দু’জনের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়। নারী আন্দোলন যখন শবরীমালা পেরিয়ে ‘#metoo’ আন্দোলনে পৌঁছল, তখনও বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথা সমান প্রাসঙ্গিক আমাদের রাজ্য ও দেশে। এই বাল্য বিবাহ ঠেকাতেই এ রাজ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্পের সূচনা। অভিনব যে প্রকল্পের দ্বারা অবিবাহিত থাকা ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া মেয়েদের এক সূত্রে বাঁধা হয়েছে। আমাদের দেশে আইন সম্পর্কে অধিকাংশের ভাবনা এই যে, আইন যদি নিজের সুবিধার্থে হয়, তাহলে মানব, না হলে ফাঁকি দেওয়াই ভাল। শুধুমাত্র ধূমপানের কুফল জানিয়ে ধূমপান বন্ধ হয় না। শেষ পর্যন্ত দণ্ড দিতে হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রেও পরিবারের দণ্ডের ভয় কম, না হলে পণপ্রথা এখনও চলত না। বৃহত্তর সমাজের স্বীকৃতি রয়েছে বলেই আইন সেখানে অকেজো।
কন্যাশ্রীতে দণ্ডের বদলে আর্থিক সহায়তার প্রসঙ্গ এসেছে। মেয়েরা স্কুলে থাকলে বাল্যবিবাহ কমে, এটা প্রমাণিত। কিন্তু সেইটুকুই যথেষ্ট নয়। স্কুল থেকেই সচেতনতা প্রয়োজন। পঞ্চম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর কাম্য স্বার্থের তালিকায় বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতনতার কথা আছে। বিদ্যালয় পরিসরে এটি এখন আলোচিত। প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মাঝে মাঝেই এ নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করেন। কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরাও অগ্রণী ভূমিকা নেয়।
তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। প্রশ্নটা এই যে, আজও সমাজে মেয়েদের জীবনে বিয়ে নামক বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে কেন। এটি হল কন্যাদায়। মেয়েরা লেখাপড়া শিখে কী করবে— এটি হল পরবর্তী প্রশ্ন। সেই প্রাচীনকালের মতো ভাবনা, সে কি জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হবে? মোদ্দা কথা, সমাজের নির্ণায়ক ভূমিকায় মেয়েদের দেখতে এবং মেনে নিতে এখনও সমাজ অভ্যস্ত হয়নি। ছেলের শিক্ষা বা কর্মজীবনের জন্য যে খরচ হতে পারে, তার সমতুল্য খরচ মেয়ের ক্ষেত্রে বিয়েতে করা হয়। বিয়ে ঠেকাতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাইল্ড লাইন বা পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অভিভাবকেরা যুক্তি দিয়েছেন, ‘ভাল পাত্র’ হাতছাড়া করতে চাননি। যেন জগতের শেষ ভাল পাত্রটিই তাঁদের বাড়ির মেয়ের জন্য পড়ে আছে। এঁরা বুঝতে চান না, কম বয়সে বিয়ে মানে সন্তান ধারণে অসুস্থতা এবং সর্বোপরি মেয়েটির সমস্ত জীবন নষ্ট।
এই সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ চলছে। আশঙ্কার আরও বেশি কারণ, অনেক সময় মেয়েরাও তাতে সায় দিচ্ছে। স্কুলের পড়াশোনা বহু ছাত্রীকে ধরে রাখতে পারে না, এরা পালিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজে। কম বয়সে বিয়েটা একটা উপায় হিসেবে সামনে দাঁড়ায়। প্রেম-ভালবাসার টান তো আছেই। আবার এটাও সত্যি, পালিয়ে গিয়ে বিয়ের ঘটনায় অল্পবয়সি মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই নারী পাচার চক্রের খপ্পরে গিয়ে পড়ে। এ রাজ্যে পাচারের ঘটনাও উদ্বেগজনক।
বর্তমানের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা সমাজের প্রান্তিক অংশ থেকে আসে, তাদের কাছে স্কুল একই সঙ্গে আশা ও হতাশা। যে আশা নিয়ে তারা স্কুলে আসে, দিনে দিনে তা নষ্ট হয়। পাঠ্যক্রম, পরিবেশ, পরিকাঠামো— বৈরিতার তালিকা দীর্ঘ। স্কুল তার জন্য তৈরি করে রাখে এমন একটি পরিবেশ, যেখানে এদের সংস্কৃতি সম্পর্কে গোটা ব্যবস্থার ধারণা অস্বচ্ছ এবং প্রায়শই ভুল; মূঢ় অজ্ঞতায় তথাকথিত মূলস্রোতের শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত সকলেই এদের অবজ্ঞা করে, তাদের পিছিয়ে পড়া বলে ধরে নেয়। পড়াশোনা এখন যেভাবে টিউশন-নির্ভর, দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা অচিরেই পিছিয়ে পড়ে। তার সঙ্গে জোটে ‘তোর দ্বারা জীবনে কিছু হবে না’—এই গোছের ভাবনা । ফেল করলে আরও বিপদ। পরিবার এদের জন্য অর্থ খরচ করতে চায় না। ফলে তাদের একটাই উপায়— বিয়ে। পড়ে কী হবে সেটাও একটা প্রশ্ন। মেয়েরাও গ্রামীণ পরিসরে দেখছে, তাদের স্বনির্ভরতার কাহিনি আসলে সীমাবদ্ধ থাকছে অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকা, আশাকর্মী, বড়জোর নার্সিং পড়ে ছোটখাটো কাজ পাওয়াতে। খুব বেশি হলে শিক্ষিকা। এই মেয়েরা স্বপ্নেও ভাবেনি বিজ্ঞানী হবে, পাইলট হবে, সর্বোপরি দেশ চালাবে। বাবা মায়ের কাছেও সেই আকাশ নেই। বিকল্প হয়ে ওঠে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ে করে সংসারী হওয়া। সেটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভাল। তাই প্রচারের পাশাপাশি মেয়েদের ক্ষমতায়নের দিকটাও ভাবতে হবে।
সেই কবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘‘ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায় এ কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যা গুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র উপার্জন করুক।... আমরা সমাজেরই অর্ধ অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপে? আমরা অকর্মণ্য পুতুল, জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত।’’
১৩৭০ সালে লেখা এই আক্ষেপ আর কতকাল বহন করতে হবে?
লেখক লাভপুর সত্যনারায়ণ শিক্ষানিকেতন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা,
মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy