এনডিএ মনোনীত প্রার্থী রামনাথ কোবিন্দকে অভিনন্দন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহর। ফাইল চিত্র।
বিরোধী শিবির ভেবেছিল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাদের প্রার্থী জিততে না পারুক, অন্তত বিরোধী নেতাদের একটা ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বভারতীয় স্তরে। হায়, নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের রণকৌশলে আবার ভূপতিত বিরোধী ঐক্য। বাসে-ট্রামে আর পথচারীর ভাষায় ঘেঁটে চচ্চড়ি! একে দলিত প্রার্থী, তার উপর যাঁকে মানুষ বেশি জানেনই না তাঁকে নিয়ে আর বিতর্ক কী হবে? আরএসএসের ঘনিষ্ঠ একদা স্বয়ংসেবক ছিলেন, কিন্তু কোনও দিনই তিনি প্রচারক ছিলেন না। তা ছাড়া তিনি বিবাহিত। ছেলেপুলে আছে। আরএসএস শৃঙ্খলা অনুসারে প্রচারক তিনি হবেন কী করে? মোদী ঘনিষ্ঠ এই নেতাটিকে ঘিরে আরএসএস নেতাদের কোনও আপত্তিও নেই কিন্তু।
বিরোধী ঐক্য কোনও দিনই ভারতে মজবুত ছিল না। কংগ্রেস বিরোধী নেতাদের একজোট হওয়াও দেখেছি। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে আন্দোলন সফল হয়েছিল ইন্দিরা গাঁধীর বিরুদ্ধে। বিশ্বনাথপ্রতাপের নেতৃত্বেও রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে জোট রাজনীতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। বিজেপি-বিরোধী জোট রাজনীতি ইউপিএ নামক এক সত্ত্বা তৈরি করে এ দেশে দশ বছর রাজত্ব করেছে। দশ বছরের ইউপিএ জোটে সনিয়া গাঁধী ছিলেন চুম্বক। তাঁর নেতৃত্বেই শরিক ঐক্য অটুট ছিল। রামবিলাস পাসোয়ান জনপথে সনিয়ার প্রতিবেশী ছিলেন। এখনও মনে পড়ে, সনিয়া একবার ১০ জনপথ থেকে পায়ে হেঁটে রামবিলাসের বাসভবনে চলে যান। শরিক ঐক্যের জন্য কত কিছু করতে হয়! বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যের আবহ গড়ে উঠছিল উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের সময় থেকেই। অখিলেশ যাদব ও রাহুল গাঁধীর জোট প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর এই ঐক্য ধাক্কা খেল যখন মুলায়ম সিংহ যাদব ছেলের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলেন। কানে কানে কথা বললেন নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে লখনউতে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই নিয়ে বিরোধী ঐক্য দানা বাঁধছিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল উপলক্ষ, আসল লক্ষ্য সবাই জানেন, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন। দলিতদের সঙ্গে ঠাকুর সম্প্রদায়ের সংঘাতের খবর আসছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে। মায়াবতী শুধু নন, নতুন দলিত মুখ চন্দ্রশেখর। তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন দিল্লির রাজপথে। যন্তরমন্তরে ধর্না শুরু হয় দলিত সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এ দিকে কৃষকদের উপর পুলিশের গুলি। কৃষকদের আত্মহত্যা। এমনকী, খাস গুজরাতেই দলিতদের উপর চলেছে অত্যাচার।
এমন অবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী নেতারা বেশ ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে দিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লালুপ্রসাদ যাদব, এই দুই ব্যক্তিত্ব মোদী বিরোধী রাজনীতিতে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকেন। মমতা দিল্লিতে এসে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে চা-চক্র করেন। পাশাপাশি সনিয়ার সঙ্গেও দেখা করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন।
কিন্তু মোদী-অমিত শাহের কৌটিল্যের রাজনীতির ক্ষিপ্রতাটা দেখুন। এই রাজনীতির রূপ-রস-গন্ধটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমে লালু এবং তাঁর কন্যা মিসা ও জামাইয়ের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির মামলা শুরু হল। লালুর বিরুদ্ধেও সিবিআই তদন্ত দ্রুতগামী। নীতীশ এবং লালুর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধকে উস্কে দেওয়া। নীতীশ কুমারের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক খুবই কম। বিহারেও কুর্মি ভোট খুবই কম। শতকরা ১০-১২ ভাগ হবে। তিনি লালুর ভোটব্যাঙ্কের জোরে এখন মুখ্যমন্ত্রী। আগে তার সঙ্গে ছিল বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক। এখন তো বিজেপি চাইছে লালুকে জেলে পাঠিয়ে তাঁর দলকে ভেঙে দিতে, যাতে এ বার শেষ পর্যন্ত যাদব ভোট ভাঙা যায় এবং সেই ভোট বিজেপিতে আসে। লালুর দল ভেঙে যদি কেউ আর একটা দল গঠন করে, সেই দলটি হয় বিজেপির সঙ্গে মিশে যাবে নয়তো নীতীশের সহযোগী দল হবে। বিজেপি মনে করছে, ওই দল বিজেপির সঙ্গেই আসুক বা নীতীশের সঙ্গেই যাক, লাভ হবে বিজেপির-ই। এ কাজে অমিত শাহ শেষ পর্যন্ত সফল হবেন কি না জানি না কিন্তু আপাতত বিরোধী ঐক্য ভাঙতে বিজেপি সফল। বিহারের রাজ্যপালকে প্রার্থী করে বিজেপি নীতীশ কুমারের সমর্থনও আদায় করে নিয়েছে।
তাই এ হল মোদীর মাস্টারস্ট্রোক। এক দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রথম বসতে চলেছেন সঙ্ঘের রাষ্ট্রপতি। আরএসএস রাষ্ট্রপতি। অন্য দিকে, তিনি দলিত বলে বিরোধী শিবিরের একটা বড় অংশ তাঁকে সমর্থন না করে থাকতে পারছে না। যেমন মায়াবতী, এমনকী অখিলেশও।
তা ছাড়া, মায়াবতীই বলুন আর মুলায়ম, দুর্নীতি বিরোধী মামলা তো আছেই।
রাহুল গাঁধী কেন এমন অবস্থায় বিদেশ চলে গেলেন সেটা এ বার বুঝতে পারছি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy