বিকাশ দুবে ধরা পড়িবার পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে পূর্বাভাস করিয়াছিলেন, তাহার প্রাণে বাঁচা মুশকিল। বিকাশ মুখ খুলিলে উত্তরপ্রদেশ রাজনীতিতে বড় মাপের ভূমিকম্প হইতে পারে, ফলে এনকাউন্টারে তাহার ভবলীলা সাঙ্গ হইবে, এমন আশঙ্কা ছিল। সেই পূর্বাভাস মিলিয়া গেল। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ জানাইল, মাঝ রাস্তায় গাড়ি উল্টাইয়া গেলে বিকাশ পলাইবার চেষ্টা করে, এবং পুলিশের সহিত গুলি বিনিময়ে তাহার মৃত্যু হয়। গার্সিয়া মার্কেসের ভাষা ধার করিয়া ইহাকে একটি মৃত্যুর পূর্বেই তাহার ধারাবিবরণী বলা চলে। পূর্বাভাস মিলিয়া গিয়াছে মানেই যে এনকাউন্টারটি ‘সাজানো’, তাহা প্রমাণিত হয় না। এই মিল নিতান্তই কাকতালীয় হইতে পারে। তবে, ২০১৭ সালের মার্চে যোগী আদিত্যনাথ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হইবার পর উত্তরপ্রদেশে পুলিশের এনকাউন্টারে নিহতের সংখ্যা ১১৯; আহত ২,২৫৮ জন। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুসারে যে কোনও পুলিশি এনকাউন্টারেরই জেলা শাসক স্তরে তদন্ত হওয়া বিধেয়। উত্তরপ্রদেশে এই এনকাউন্টারগুলির মধ্যে ৭৪টির তদন্তে পুলিশ ‘নির্দোষ’ প্রমাণিত হইয়াছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত বৎসর প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে উত্তরপ্রদেশ সরকার স্থির করিয়াছিল, পুলিশের যে কৃতিত্বগুলির কথা সাধারণ মানুষকে জানানো হইবে, সেই তালিকায় ‘এনকাউন্টারের সংখ্যা’-কে রাখিতে হইবে। সরকারি নির্দেশটি পৌঁছাইয়াছিল জেলা শাসকদের নিকট— যাঁহাদের উপর এনকাউন্টারে পুলিশের ভূমিকার তদন্ত করিবার ভার ন্যস্ত। অতএব, কেহ যদি এখনই ধরিয়া লন যে তদন্তে জানা যাইবে উত্তরপ্রদেশ হইতে পলাইয়া বিকাশ মধ্যপ্রদেশে পৌঁছাইয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছিল উত্তরপ্রদেশে প্রত্যাবর্তনের পরই ফের পলাইবে বলিয়া, তাহার টেলিপ্যাথির জোরেই গাড়ি উল্টাইয়াছিল এবং তাহাকে না মারিয়া পুলিশের আর উপায় ছিল না, তবে সেই ধরিয়া লওয়াকে দোষ দেওয়া মুশকিল।
‘পুলিশি এনকাউন্টার’-এর নামে ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার লঙ্ঘন লইয়া প্রতিবাদ ও সমালোচনা বিস্তর। তাহার পরেও এনকাউন্টার বহু মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য কেন, এনকাউন্টারের কুশীলবরা কেন রীতিমতো মালাচন্দনে পূজিত হইয়া থাকেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে বহুবিধ তত্ত্ব খাড়া করা যাইতে পারে। চলচ্চিত্রে এনকাউন্টারের মহিমাকীর্তন, তাহাকে বৈধ করিয়া তোলা; বিচারবিভাগীয় দীর্ঘসূত্রতায় মানুষের ধৈর্যহানি; হাতেগরম ‘ন্যায়বিচার’-এর আকর্ষণ— প্রতিটি কথাই সত্য। কিন্তু এই মুহূর্তে আরও গুরুত্বপূর্ণ হইল এই এনকাউন্টারের প্রতি শাসকদের প্রচ্ছন্ন, বা ক্ষেত্রবিশেষে প্রকট, প্রশ্রয়। বিকাশ-বধে উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক রথী-মহারথীরা বাঁচিলেন কি না, সেই কারণেই বিকাশের এনকাউন্টার অনিবার্য ছিল কি না, এই জল্পনায় প্রবেশ করিবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু, যে প্রশাসন এনকাউন্টারকে পুলিশের কৃতিত্ব হিসাবে দেখে, এবং সেই কৃতিত্ব প্রচার করিতে চাহে, এই অসাংবিধানিক রাষ্ট্রীয় হত্যায় তাহার সমর্থন স্বপ্রকাশ। বিকাশ দুবে অপরাধী, তাহা সংশয়াতীত। আরও বহু এনকাউন্টারে যাহারা মারা গিয়াছে, তাহাদের অনেকেও হয়তো অপরাধীই ছিল। কিন্তু, অপরাধীর বিচারের জন্যই দেশে গোটা বিচারবিভাগ আছে, জেলা আদালত হইতে সুপ্রিম কোর্ট অবধি ন্যায়ালয় আছে। তাহাদের গুলি করিয়া মারা পুলিশের কাজ নহে। প্রশ্ন হইল, পুলিশের এই মারাত্মক অপরাধটিকে সরকার প্রশ্রয় দেয় কেন? এই অপরাধীরা আদালতে মুখ খুলিলে এমন কিছু জনসমক্ষে আসিবে, যাহার ধাক্কা রাজনীতিকদের পক্ষে সামলানো কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো তাহাই এনকাউন্টার-হত্যার হেতু। কিন্তু গভীরতর একটি কারণও থাকিতে পারে। ক্ষমতাবানরা এই ভাবেই দেখাইয়া দিতে চাহেন যে, মহান গণতান্ত্রিক দেশে শাসকের চক্ষুশূল হইলে কাহারও নিস্তার নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy