মণিকুন্তলা সেনের স্মৃতিকথা। নিজস্ব চিত্র
বরিশালের মেয়ে। মেদিনীপুরের মহিলাদের জন্য বহু কাজ করেছিলেন মণিকুন্তলা সেন। মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও গড়বেতায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির শাখা গড়ে তোলায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তমলুকে জেলা সম্মেলন হওয়ার আগে অন্তত একটি করে প্রাথমিক কমিটি গঠনের জন্য মণিকুন্তলা তাঁর সঙ্গী গীতা মুখোপাধ্যায়, উষা চক্রবর্তী, সাধনা পাত্র প্রমুখ কেশপুর, দাশপুর, শালবনি, ঘাটাল-সহ কয়েকটি জায়গায় ঘুরেছিলেন। তমলুকে গঠন হয়েছিল জেলা কমিটি। কারণ, সমিতির প্রধান সংগঠনগুলো তমলুকেই গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন এই শহরে তাঁরা সাহায্য পেয়েছিলেন সেখানকার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুচরিতা দাস-সহ অন্য শিক্ষিকাদের কাছ থেকে। সুচরিতার অন্য একটি পরিচয় ছিল। তিনিও বরিশালের মেয়ে ও কবি জীবনানন্দ দাশের বোন। কৃষক, মহিলা ও মধ্যবিত্তের একাংশ নিয়ে এখানে শুরু হল নতুন ধারায় নারী আন্দোলন। সালটা ১৯৪৩।
কংগ্রেস নেতাদের মুক্তির দাবি, মেয়েদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়ের দাবি জানিয়েছিল মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় মেদিনীপুরে ত্রাণের কাজে সমিতির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছরে মণিকুন্তলার নেতৃত্বে ভুখা মিছিল বিধানসভা অভিযান করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকের কাছ থেকে ঘটনাস্থলেই আংশিক দাবি আদায় করেছিল। মণিকুন্তলা ছিলেন সেই মিছিলের নেত্রী।
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হওয়ার পর মণিকুন্তলা বিনা বিচারে আটক হন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপন করে মহিলাদের জন্য কাজ করতে থাকেন। নেতৃত্ব তাঁকে পার্টির কাজে খড়গপুরে পাঠায়। ১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ ডাকা রেল ধর্মঘটে সহায়তা করতে তিনি খড়গপুরে পৌঁছলেন। কোয়ার্টারের বাসিন্দাদের পরিচয় দিলেন বীণা দাস নামে। শুরু হল প্রচার। রেল কোয়ার্টারের মধ্যবিত্ত মেয়েদের মধ্যে ধর্মঘটের পক্ষে কোনও সাড়াই মিলল না। তাঁকে বস্তি এলাকায় আনা হল। যে পরিবারে উঠলেন তাঁরা সিলেটের লোক। তাঁরা মণিকুন্তলাকে চিনে ফেললেও নাম গোপন রাখলেন। কিন্তু ধর্মঘটে তেমন সাড়া পেলেন না।
সেইসময়েই খড়্গপুরে জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের মিটিং হচ্ছে। মণিকুন্তলাকে বলা হল, ওই মিটিংয়ে তিনি শ্রমিক মেয়েদের নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। মণিকুন্তলা খড়গপুরের জনৈক পণ্ডিতজির স্ত্রীকে প্রশ্ন করার জন্য শিখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। জয়প্রকাশের ভাষণের মাঝে ওই মহিলা প্রশ্ন করতে লাগলেন। জয়প্রকাশ বিব্রত হলেন। বিরক্ত মুখে বললেন ‘আচ্ছা তো, আপ আইয়ে, ভাষণ দিজিয়ে, মেরা ভাষণ ম্যায় বন্ধ রাখতা হুঁ’। তখনই স্বেচ্ছাসেবকেরা মেয়েদের দিকটা ঘিরে ফেলল। জয়প্রকাশ আবার বক্তৃতা শুরু করলেন। সভাস্থলে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে, মেয়েদের বেরনোর সরু পথ ধরে সকলকে নিয়ে উঠে গেলেন মণিকুন্তলা। কিন্তু ৮ মার্চ গ্রেফতার হন। ৯ মার্চ মেদিনীপুর জেলে পাঠান হয়।
জেল সুপারের কাছেও পরিচয় গোপন করলেন মণিকুন্তলা। দিলেন টিপসই। কারণ তাঁর নাম তো ‘বীণা দাস’। কিন্তু মণিকুন্তলাকে ভিতরে ঢোকানো মাত্র রাজবন্দি ওয়ার্ডগুলোয় ছেলেরা চিৎকার করে উঠল, ‘মণিকুন্তলা সেন জিন্দাবাদ’। মণিকুন্তলার মুখ ঘোমটা দেওয়া। তিনি ইশারা করলেও স্লোগান থামেনি। ফিমেল ওয়ার্ডে ঢোকা পর্যন্ত তাঁর অভ্যর্থনা চলল। পরিচয় না দেওয়ায় মণিকুন্তলাকে থার্ড ডিভিশনের বিচারাধীন বন্দি করা হল। পরের দিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রক্ত পড়তে শুরু করল মলের সঙ্গে। বড় ডাক্তার এসে তাঁর চিকিৎসা করলেন। দিন পনেরো লাগল ভাল হতে। জেলের ডাক্তার মণিকুন্তলার পরিচয় জানতেন। পরিচয় জানতে আইবি অফিসার প্রায় রোজই অফিসে এসে মণিকুন্তলাকে ডেকে পাঠাতেন। ছেলেদের ওয়ার্ড থেকে মণিকুন্তলার কাছে নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল প্রকৃত নাম প্রকাশ না করতে।
দুপুরে একদিন মণিকুন্তলা কাপড় পেতে শুয়ে আছেন। জেলার রাউন্ডে এসেছেন। বললেন ‘কী জন্য আপনি এই ভূমিশয্যা নিয়েছেন বলতে পারেন? আর নিজের হাত খরচের টাকা থেকে তেল, সাবান, পেস্ট ও ব্রাশ ইত্যাদি কিনতে পাঠিয়েছেন কেন? এ সবই তো আপনার জন্য কেনা রয়েছে। নামটা লিখে দিলেই তো সবই সরকারি খরচে পাবেন’। মণিকুন্তলা বললেন ‘কী নাম লিখে দেব?’ জেলার বললেন ‘কেন, মণিকুন্তলা সেন’। উত্তরে তিনি বললেন, ‘না, যা আছি এই বেশ’। পুলিশ মেদিনীপুরের কৃষক নেত্রী বিমলা মাজী-সহ প্রায় ৪০ জন মহিলাকে ধরে আনল। তাঁরা মণিকুন্তলাকে চেনেন। জেলে সকলে একই সঙ্গে খান, কম্বল বিছিয়ে ঘুমোন। মণিকুন্তলা বলতেন, ‘রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা নিয়ে আমি খাটে শোব, ওরা মাটিতে থাকবে এ আমার মোটেই মানতে ইচ্ছা হচ্ছিল না’। মণিকুন্তলাদের ওয়ার্ডে লন্ঠন জ্বলত। মহিলা বন্দিদের লেখাপড়া শেখাতেন। কলকারখানা, কৃষক-মজুরের দাবিদাওয়া নিয়ে বোঝাতেন।
মেদিনীপুর জেলে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে আনা বেশ কয়েকজন সাঁওতাল মেয়ে ছিল। তাঁদের বলা হত, ‘চোলাই’ আসামী’। এঁরা মহুয়া বা চাল থেকে মদ বানাত। জেলখানায় সকাল থেকে সন্ধ্যা একটানা খাটতেন তাঁরা। এক মহিলা জমাদার ওঁদের দিয়ে হাত-পা টেপাত। একদিন জমাদার একটি মেয়েকে ঝাঁটা মারে। ফলে ওই মেয়েরা খাওয়া বন্ধ করলেন। মণিকুন্তলা ব্যাপারটা জানতে পেরে বললেন, ‘জমাদারনী যতক্ষণ তোমাদের কাছে ক্ষমা না চাইবে ততক্ষণ খাবে না’। তিনি জেলারকে আসতে বললেন। জেলার সেই মহিলা জমাদারকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ালেন। তার পর মেয়েরা খেল।
জেলখানায় মণিকুন্তলার প্রায় একমাস কেটে গেল। বন্দিমুক্তির দাবিতে মিছিল করতে গিয়ে লতিকা, প্রতিভা, গীতা ও অমিয়ার মৃত্যু হয়েছে (২৭ এপ্রিল ১৯৪৯ সাল)। খবর মেদিনীপুর জেলে পৌঁছলে প্রতিবাদে অনশন চলল। কৃষক মেয়েরা ১০ দিন অনশনে থাকতে পারলেন না। সরকার ধর্মঘটিদের দাবি মেনে নিল এবং অনশন শেষ হল। মণিকুন্তলা সেন তাঁর নাম স্বীকার করার দিনই কর্তৃপক্ষ তাঁকে সিকিউরিটি বন্দি হিসাবে গণ্য করল। বিছানা হল খাটিয়ায়, খাওয়া-দাওয়াও আলাদা। মণিকুন্তলা কিন্তু অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে খেতেন। এ ভাবে মাস তিনেক কাটল। কিন্তু সরকার প্রতিশ্রুতি পালন না করায় জুন মাসে দ্বিতীয়বার ধর্মঘট ডাকা হল। তবে জেলে কৃষক মেয়েদের অনেকেই বাদ দেওয়া হল। শুধু সক্ষমেরাই অনশন করলেন।
মণিকুন্তলা কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অবস্থা খারাপ হতে লাগল। জেল কর্তৃপক্ষ চিন্তায় পড়লেন। ২৩ দিনের দিন খবর এল ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়েছে। জেলর টেলিগ্রাম দেখালেন। দফায় দফায় কৃষক মেয়েদের ছেড়ে দেওয়া হল। শেষে মণিকুন্তলা সেনের বদলির অর্ডার এল। পাঠানো হল কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে।
(তথ্যসূত্র: মণিকুন্তলা সেন-সেদিনের কথা, জ্যোতি বসু-যতদূর মনে পড়ে, শ্যামলী গুপ্ত-নারী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা)।
লেখক প্রাবন্ধিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy