কেহ বলিবেন, পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গির প্রকোপ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী ভাঙিয়াছেন, কিন্তু মচকান নাই। কেহ বলিবেন, মুখ্যমন্ত্রী আস্তে আস্তে ভাঙিতেছেন। কেহ বা অলিভার গোল্ডস্মিথ-এর পদ্যে কথিত গ্রামের স্কুলশিক্ষকের কাহিনি স্মরণ করাইয়া দিবেন, সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হইয়া গেলেও যিনি পরাজয় মানিতেন না। কাহারও কথাই উড়াইয়া দেওয়া চলে না, উড়াইয়া দেওয়ার প্রয়োজনও নাই, কারণ এ-সকলই ক্ষুদ্র কথা, যাহা ক্ষুদ্র চিন্তার প্রকাশমাত্র। ডেঙ্গির কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করিবার নেতিবাচন হইতে শুরু করিয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বীকৃতির পথে কতটা সরিয়া আসিয়াছেন, ক্রমে আরও কতটা সরিবেন, বেসরকারি হাসপাতালের প্রদত্ত তথ্য ফের ‘যাচাই’ করিবার অবকাশে সরকারি হাসপাতালের পরিসংখ্যান ব্যবহার করিয়া ডেঙ্গি-মৃত্যুর সংখ্যা কম রাখিবার আয়োজন কত দিন কার্যকর থাকিবে, সেই সকল প্রশ্ন লইয়া ক্ষুদ্রবঙ্গের চণ্ডীমণ্ডপে অনন্ত চর্চা চলুক, প্রকৃত প্রশ্ন একটিই। ডেঙ্গি প্রতিরোধে ও মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি অবশেষ তৎপর হইবেন?
সোমবার নবান্নে ধ্বনিত তাঁহার কিছু উচ্চারণ শুনিয়া সন্দেহ হয়, বিলম্বে হইলেও নেত্রী জাগ্রত হইয়াছেন, হয়তো বা প্রশাসনেরও এ বার ঘুম ভাঙিবে। পঞ্চায়েত-পুরসভাকে পূর্ণোদ্যমে কাজ করিতে বলিয়া তিনি বুঝাইয়া দিয়াছেন, বিপদের মোকাবিলা যে জরুরি, তাহা তিনি মানিতেছেন। কাজ না করিলে পুরসভার বোর্ড ভাঙিয়া দিব— এহেন হুমকি নিশ্চয়ই গণতন্ত্রসম্মত নহে, তাহা অনস্বীকার্য। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাগ্ধারার সহিত কিছুমাত্র পরিচয় থাকিলেই বুঝিতে অসুবিধা হয় না যে, এই পরুষ উক্তি প্রধানত তাঁহার ক্ষোভের প্রকাশ। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরা আশা করিবেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই ক্ষোভ সজাগ ও সক্রিয় থাকিবে, কারণ তাহা হইলে পঞ্চায়েত, পুরসভা, রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য প্রশাসন ইত্যাদি সমস্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই সংক্রমণের প্রতিরোধে ও মোকাবিলায় তৎপর হইবার সম্ভাবনাও থাকিবে। যাহা প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজ, মুখ্যমন্ত্রী তিরস্কার না করিলে প্রশাসন তাহা ঠিক ভাবে করে না কেন, পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রশ্ন বাহুল্যমাত্র, যস্মিন্ দেশে যদাচারঃ। বিভিন্ন স্তরের প্রশাসন যাঁহারা চালাইতেছেন তাঁহারা যদি বোঝেন, ডেঙ্গির বিপদকে সত্য বলিয়া মানিলে আর ভর্ৎসনার ভয় নাই, বরং তাহার বিরুদ্ধে লড়াই না করিলে শাস্তির ভয় আছে, তবে মঙ্গল।
ধন্য আশা কুহকিনী। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক এমন স্বপ্নও দেখিতে পারেন যে, মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার প্রশাসন ডেঙ্গি মোকাবিলার সূত্রে রাজ্য জুড়িয়া এক যথার্থ যুদ্ধ ঘোষণা করিবেন। কেবল ডেঙ্গি নহে, সব ধরনের সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বিভিন্ন দেশের, এ দেশেরও বিভিন্ন রাজ্যের অভিজ্ঞতা নির্ভুল ভাবে জানাইয়া দিয়াছে, প্রশাসন এবং সমাজ কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া যথার্থ যুদ্ধকালীন উদ্যোগে ঝাঁপাইয়া পড়িলে কার্যত যে কোনও সংক্রমণকে বহু দূর অবধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পোলিয়ো নির্মূল করিবার সফল কর্মসূচি বহুচর্চিত। সত্য বটে, পোলিয়োর টিকা আছে, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ এক অর্থে কঠিনতর, কারণ তাহাদের নিবারণী প্রতিষেধক নাই। কিন্তু কঠিন এবং অসম্ভব এক নহে। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা সম্প্রতি ম্যালেরিয়া-মুক্ত হইয়াছে। আবার সেই দেশেই এই বছর ডেঙ্গির অভূতপূর্ব আক্রমণ ঘটিয়াছে, যাহার ধাক্কায় সে দেশের শাসকরা বিপুল তৎপরতায় যুদ্ধে নামিয়াছেন এবং সাধারণ মানুষকে সেই যুদ্ধে শামিল করিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গ তেমন উদ্যোগ দেখাইতে পারিলে নূতন ইতিহাস সৃষ্টি হইবে। মারি লইয়া ঘর করিবার মধ্যে কোনও গৌরব নাই— এই সত্য যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করেন, তবে এখন তাঁহার বীজমন্ত্র হওয়া উচিত একটি শব্দ: উত্তিষ্ঠত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy