লাভপুরে পিঠের প্রস্তুতি। নিজস্ব চিত্র
সংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তি একটা ফসলী উৎসব, যা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় পালিত হয়। ভারতে এই উৎসব অবশ্য রাজ্য ভেদে নানা নাম পেয়েছে। সাধারণত ১৪ জানুয়ারি বা তার এক দিন আগে-পরে এই তিথি আসে। তবে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, তার মেয়াদও আলাদা হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও চার দিন পর্যন্তও উৎসব চলে। বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত—এমন নানা নামে এই একই উৎসব পালন করা হয়। মকর সংক্রান্তিকে ঘিরে উৎসব আক্ষরিক অর্থেই একটি সর্বভারতীয় উৎসব।
মকরসংক্রান্তি হল সেই ক্ষণ, যাকে ঘিরে এই উৎসব পালিত হয়।প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব চলে আসছে। তবে সুস্পষ্টভাবে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। হতে পারে এটা হাজার বছরের উৎসব বা তারও আগের তবে পুরাণেও এর উল্লেখ আছে। মকর সংক্রান্তির এই মহাতিথিতেই মহাভারতের পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। আবার অন্য মত অনুযায়ী, এই দিনই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। বিষ্ণু অসুরদের বধ করে তাঁদের কাটা মুন্ডু মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলেন, তাই মকর সংক্রান্তির দিনই সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাস হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে আজও মানা হয়ে থাকে। আবার অন্য মতে, সূর্য এ দিন নিজের ছেলে মকর রাশির অধিপতি শনির বাড়ি এক মাসের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন। তাই এই দিনটিকে বাবা-ছেলের সম্পর্কের একটি বিশেষ দিন হিসাবেও ধরা হয়।
সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যের এক রাশি হতে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা যায়। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়। সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সঙ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ সংক্রমণ। অর্থাৎ, ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র সংক্রমিত হওয়া বা নতুন সাজে, নতুন রূপে অন্যত্র সঞ্চার হওয়া বা গমন করাকে বোঝায়। সূর্য এ দিনই ধনু থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। এর থেকেই মকর সংক্রান্তির উৎপত্তি।
পৌষ বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ উৎসব বা বিশেষ ঐতিহ্যবাহী দিন। বাংলা মাস অনুযায়ী পৌষ মাসের শেষ দিনটিতে এই উৎসব পালন করা হয়। শুধু বাংলায় বাঙালিরাই নন, আমাদের দেশের নানা প্রান্তে এই দিনটিকে নানা ভাবে বিশেষ বিশেষ উৎসবের সঙ্গে পালন করা হয়। বাঙালিরা এই দিনটিতে পুজো করে পিঠে-পুলি বানিয়ে খাওয়া দাওয়া করে। এই বিশেষ দিনটি নানা রকম অনুষ্ঠান ও আনন্দের মধ্যে দিয়ে পালিত হয়। কিছু বিশেষ নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে পালন করা হয় প্রাচীনকাল থেকেই। মকর সংক্রান্তির দিন দূর যাত্রা করা শুভ নয় বলে মনে করা হয়। কোথাও গেলেও নিজের বাড়িতে ফিরে আসা উচিত বলেও মানুষের বিশ্বাস।
মকর সংক্রান্তির দিন সাধারণত সূর্যদেবের পুজো করা হয়। তাঁর আশীর্বাদে আমাদের সকল রোগ-ব্যাধি দূর হয় বলে ভক্তেরা বিশ্বাস করেন। তাই এই বিশেষ দিনটিতে সকলেই নিজের ঘরবাড়ি, বিশেষ করে রান্নাঘর ও রন্ধন দ্রব্যাদি পরিষ্কার করেন, যাতে সমস্ত রকম ‘অপরিশুদ্ধতা’ দূর হয়। আসলে নিজের ঘরবাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার করে সুস্থতা বজায় রাখার জন্যই নিয়মটি পালন করা হয় বলে মনে করা হয়। সংক্রান্তির কিন্তু কিছু অবশ্য পালনীয় নিয়ম আছে, যেগুলি বেশ মজাদার। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেগুলি কী কী:
১) মকর সংক্রান্তির দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান করে উঠোনে বা ঘরে আলপনা দিয়ে সূর্যদেবের পুজো করার নিয়ম। ২) মকর সংক্রান্তিতে গুড়, চাল, দুধ ইত্যাদি সহকারে নানা ধরনের উপাদেয় মিষ্টি, পিঠে, পুলি, পায়েস ইত্যাদি বানানো হয় এবং খাওয়া হয়। ৩) কেউ বাড়িতে আসলে তাকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। কথিত, এই বিশেষ দিনটিতে সূর্যদেব পুত্র শনির প্রতি তাঁর ক্ষোভ ভুলে যান এবং তাঁর গৃহে সূর্যদেবের আগমন ঘটে। তাই এই দিনে সকলে মিলিত হন এবং মিষ্টিমুখ করানোর মাধ্যমে মিষ্টি সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করেন। ৪) মকর সংক্রান্তির আর একটি বিশেষ আকর্ষণ ঘুড়ি উৎসব। এই দিন প্রত্যেকটি বাড়ির ছাদে ছোট-বড়রা মিলে ঘুড়ি ওড়ান। এ পাড়া, ও পাড়ার মধ্যে রীতিমতো ঘুড়ি ওড়ানোর কম্পিটিশন চলে।
যে কোনও উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে মানুষের মিলনের আনন্দ বার্তা। আত্মীয়-পরিজনের আগমনে উৎসব পূর্ণতা লাভ করে। পৌষের সংক্রান্তির কথা উঠলেই ভেসে উঠে পিঠে, পুলি, পায়েস দিয়ে রসনাতৃপ্তি এবং ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সংক্রান্তির স্নান শেষে ধানের থেতে খড়ের বুড়ি মা-র ঘরে আগুন দিয়ে গ্রাম জুড়ে আট থেকে আশির শরীর উষ্ণ করার ছবি। এখানেই শেষ নয়, সবুজ শ্যামল গাঁয়ের বাড়ির বিরাট উঠোনে জায়া, জননীরা নানা রঙের আলপনা এঁকে ধান, দূর্বায় পুজো সারেন। ঘরের আসনে তিল-কদমায় ঠাকুর সেবা-সহ আরও নানা আয়োজন হয়ে থাকে পৌষ সংক্রান্তিতে।
বদলে যাওয়া এই বাংলায় এখনও দূর গাঁয়ে পৌষ সংক্রান্তির উৎসব নিয়ে আসে আনন্দ বার্তা। পৌষ সংক্রান্তিতে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় স্নিগ্ধ সবুজ গ্রাম। শহরের ব্যস্ত জীবনেও দোকানে দোকানে সেজে উঠা তিল, কদমা, প্যাকেটের চালের গুঁড়োর প্যাকেট, ঝোলা গুড়ের হাঁড়ি জানান দেয় চলে এসেছে পৌষ সংক্রান্তি। হালে পিঠে থেকে পায়েস সবই সহজলভ্য নির্দিষ্ট দোকানে। তবে শহরেও বেশ কিছু পরিবার আজও সমান আন্তরিকতার সঙ্গে এবং নানা আয়োজনে পালন করে পৌষ সংক্রান্তির উৎসব। বাড়িতেই তৈরি করেন পিঠে-পুলি।
প্রায় নিত্যদিনই দর্শন আর রূপ পাল্টে যাচ্ছে এই পৃথিবীর। সামাজিকতার যে বিষয়গুলো কোনও এক সময় পরিবার-পরিজনদের মধ্যে অনাবিল আনন্দের পরশ এনে দিত, সেই আনন্দঘন সময়ের ছবি ধীরে ধীরে কমে আসছে। সংক্রান্তির আগেই গ্রামে গ্রামে ঢেকিতে, গানের মধ্যে চাল গুঁড়ো করার ছবিও হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে নগরায়নের ঠেলায়। আশঙ্কা জাগে, আত্মকেন্দ্রিকতার বাড়বাড়ন্তে পৌষ সংক্রান্তিও না কোনও একদিন কাহিনি হয়ে বেঁচে থাকে লেখার পাতায় পাতায়!
লেখক নাট্য ও সমাজকর্মী, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy