চোখ মেললেই দেখতে পাচ্ছি জলঙ্গির পাড়ে আর রেল লাইনের ধারে ধারে শরৎ ফুটেছে কাশ হয়ে। নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘ আর ভোরের শিশিরমাখা শিউলি খবর পাঠিয়েছে— তিনি আসছেন। স্কুলের বাচ্চারা কর গুনছে দুর্গাপুজো আসতে আর কত দিন বাকি। সহজ হিসেবটা হল ‘মহালয়ার’ সাত দিন পর পুজো।
কিন্তু ‘মহালয়া’ ব্যাপারটা কী? কী আবার? ভোরবেলা আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অসামান্য কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ, স্তোত্রপাঠ ও বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে গান, যা কিংবদন্তি। এই হল সাধারণের ধারণা। এই অনুষ্ঠানটি সত্যিই পুজোর অনুসঙ্গ হিসাবে মূল সুরটি যেন বাজিয়ে দেয় বাঙালির হৃদয়তন্ত্রীতে। ইদানীং দূরদর্শনেও কাহিনিটি চিত্রিত হয়।
অথচ, মহালয়া অর্থ ভিন্ন। তার অনুসঙ্গ আলাদা। এর সঙ্গে মাতৃ আরাধনার কোনও যোগ নেই। তবু আমরা এ ভাবেই মহালয়া এবং দুর্গাপুজোকে একই উৎসবে রূপ দিয়েছি। যদিও তত্ত্বগত ভাবে এ দু’টি অনুষ্ঠানের কোনও যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। গবেষক পণ্ডিতেরা কেউ কেউ বলছেন ‘মহালয়া’ যা মহা-আলয় বা পিতৃপুরুষের বাসভূমি থেকে এসেছে। যেমন, দেবলোকে দেবতাদের বাস তেমনই এটি পিতৃলোক, সেখানে পিতৃপুরুষেরা বাস করেন। অমাবস্যায় তাঁদের জল দান করা আমাদের কর্তব্য। তাই মহালয়ার দিনটি আমাদের পিতৃ উপাসনার দিন রূপে চিহ্নিত হল। পিতৃ উপাসনার মধ্যে দিয়েই তৈরি হয় ধর্ম ভাবনা। আর সেই ভাবনার পূর্ণতা মাতৃ আরাধনায়। মা মহামায়া, জগজ্জননী, দুর্গাতিনাশিনী দুর্গা আসবেন আমাদের ঘরের কন্যা হয়ে কৈলাশ থেকে ঠিক সাত দিন পর। কবে, কী ভাবে এই দু’টি অনুষ্ঠান সংযুক্ত হল, তা বলা খুব কঠিন। অমাবস্যায় গঙ্গা বা অন্য কোনও নদীতে নেমে করজোড়ে মন্ত্রচ্চারণের মধ্যে দিয়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জল দান করাই রীতি। মন্ত্রগুলি একুট খেয়াল করলে বোঝা যায় যে, কেবল মাত্র আমাদের পিতৃপুরুষই নয়, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে তৃপ্ত করে সপ্তর্ষি ও পিতামহ ভীষ্মকেও জলদানের রীতি প্রচলিত। দেবতা এবং ঋষিদের উদ্দেশে জল দান করার পর পিতৃতর্পণ বা তাঁদের উদ্দেশে জল দান করা হয়। কৃষ্ণপক্ষের অবসান ঘটে শুক্লপক্ষ শুরু হয়। একে আমরা বলি দেবীপক্ষ। অর্থাৎ, মাতৃ আরাধনার কাল।
সূর্যের এই সময়কালীন গতি পথকে বলা হয় দক্ষিণায়ন। এ সময়টা নাকি দেবতাদের নিদ্রাকাল। তাই দেবীকে জাগ্রত করার রীতি প্রচলিত। স্বয়ং রামচন্দ্র রাবণবধের উদ্দেশে দেবীকে অকালে বা অসময়ে উদ্বোধিত করেছিলেন বলে এই পুজো ‘অকালবোধন’ হিসাবে চিহ্নিত। এখনও তাই মহাষষ্ঠীতে দেবীর বোধন বা নিদ্রাভঙ্গের আচার অনুষ্ঠানটি পালিত হয়। অনেকে এই নিদ্রাভঙ্গকে নিজের ঘুমন্ত সত্ত্বার জাগরণ বলে ব্যাখ্যা করে থাকেন— ‘‘উত্তিষ্ঠতঃ জাগত প্রাপ্য বরান নিবোধত।”
আমরা দেবীকে আপন ঘরের কন্যা রূপে গ্রহণ করেছি। সে কারণে রচিত হয়েছে বহু আগমনি গান। মেয়ে আসছে শ্বশুরালয় থেকে পিতৃালয়ে। সে জন্য মা, বাবার আনন্দের শেষ নেই। ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে নাড়ু, মোয়া, ক্ষীর, ছানা, নারকেলের মিষ্টি। এ সব এখন শহরাঞ্চলে দেখা না গেলেও গ্রাম বা মফস্সলে কম-বেশি চোখে পড়ে। স্বর্গের দেবীকে এ ভাবে বাংলার ঘরের মেয়ে করে নিয়েছি কবে, তা কে জানে। আবার, সাবেক পুজো মানেই এক চালের ঠাকুর। অর্থাৎ মেয়ে একা নয়, সঙ্গে তার চার ছেলে মেয়েও বাহন সমেত হাজির। এই যে পরিবারিক মেলবন্ধনের একটা প্রতীক, তা একান্নবর্তী বাংলার সংসার জীবনেরই প্রতিচ্ছবি বলা যায়। আজ দিন বদলেছে। তাই নিউক্লিয়ার পরিবারের মতো প্রতিমাও টুকরো টুকরো হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে কালের নিয়মে।
দেবীর মূর্তিটি কিন্তু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। অর্থাৎ, দেবী মহিষাসুরকে মর্দন করছেন। চণ্ডীর ব্যাখ্যায় সে তো ভয়াল-ভীষণ রূপ। কিন্তু দশভূজা দেবীর যে রূপটি এখন পূজিত হয় তা শান্ত, স্নিগ্ধ হাস্যোজ্জ্বল আমাদের ঘরের মা-মাসি-দিদিদের মতো। অনেক বাড়িতে মায়ের দ্বিভুজা মূর্তি খেয়াল করা যায়। নদিয়াতেই শিবনিবাসের কাছে পাবাখালি গ্রামে রায়চৌধুরীদের বাড়ির মূর্তিটি দ্বিভুজা। দেবীর মূল দু’টি হাত স্বাভাবিক। বাকি আটটি হাত আছে। কিন্তু বেশ ছোট ছোট এবং কোঁকড়ানো চুলে তা ঢাকা। ব্যাখাটি হল এই যে, বাপের বাড়িতে মেয়ে ওই ত্রুদ্ধ, উগ্রচণ্ডারূপে এলে সকলে ভয় পাবেন। তাই দেবী তাঁর সে রূপ গোপন রেখেছেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেবী রাজরাজেশ্বরীর মূর্তিটিও দ্বিভুজা। এ ভাবেই বাঙালি জীবনে মনের মাধুরী মিশেছে দেবী আরাধনায়।
আমরা বলি দুর্গাপুজো। অর্থাৎ, দুর্গার রূপকে আমরা অর্চনা করে থাকি। পুরাণমতে, যিনি দুর্গম নামে অসুরকে বধ করেছেন, তিনিই দুর্গা। অথচ, আমরা বলছি মহিষাসুর বধ হয়েছেন। মহাশক্তির এই দু’টি রূপকে কবে, কী ভাবে আমরা একত্র করে ফেলেছি সে হিসাব আজ আর মিলবে না। কারণ, শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠ দুর্গাপুজোর অন্যতম অঙ্গ। সেখানে দেবী দুর্গার রূপ বর্ণনা নেই। আছে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তবগাথা। দেবী দুর্গার কাহিনি দেবী ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে রুরু অসুরের পুত্র দুর্গম ছিলেন মহা পরাক্রান্ত এবং মহাতপস্বী। দুর্গম বেদ করায়ত্ত করার জন্য হিমাচলে তপস্যা শুরু করেন। উদ্দেশ্য একটাই, দেবকুল ধ্বংস করা। দুর্গমের মহা তপস্যা হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে মহাতেজে জগৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। অবশেষে ব্রহ্মা তাঁকে দেখা দিলেন এবং বর দানে সম্মত হলেন। দুর্গম চতুর্বেদ প্রার্থনা করলেন এবং সেই সঙ্গে দেবকুলকে পরাস্ত করার বরও চেয়ে নিলেন। ব্রহ্মা তথাস্তু বলে প্রস্থান করলেন। দুর্গম অসুর সুযোগ বুঝে অমরাবতী আক্রমণ করলেন এবং জয় করে নিলেন। দেবতারা স্বর্গচ্যুত হয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। মর্তে অনাবৃষ্টি দেখা দিল। অনাবৃষ্টিতে বহু মানুষ এবং গরু-মহিষের মতো গৃহপালিত পশুদের মৃত্যু হল। শুরু হল মানব এবং দেবতাদের করুণ প্রার্থনা— রক্ষা করো, রক্ষা করো।
দেব দ্বিজকে রক্ষা করতে এক অদ্ভুত রূপে আবির্ভুতা হন দেবী দুর্গা। তাঁর মুখমণ্ডল শতনেত্রযুক্ত, দেহকান্তি সুনীল, চতুর্ভুজা। দেবীর করুণাঘন শতনেত্রের অশ্রুতে বৃষ্টিপাত হল। ধরণি হল শস্যশ্যামলা। সকলেই প্রাণ ফিরে পেল। এই দেবী শতনেত্রযুক্ত বলে তাঁর নাম ‘শতাক্ষী’। এই সংবাদ পেয়ে দুর্গম আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি দেবী শতাক্ষীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। দেবী সে জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তাই প্রবল যুদ্ধ শুরু হল দুর্গমের সঙ্গে দেবী শতাক্ষীর। দেবী এই যুদ্ধে দুর্গমাসুরকে বধ করে চতুর্বেদ উদ্ধার করলেন, যা ছলে-বলে-কৌশলে দুর্গম অসুর ব্রহ্মার কাছ থেকে করায়ত্ত করেছিল। দেবী দুর্গমাসুর বধ করে হলেন দুর্গা।
এ তো গেল পুরাণের কথা। কিন্তু কালের নিয়মে সব মিলেমিশে একাকার। যিনি মহিষাসুরমর্দিনী তিনিই দুর্গা, তিনিই উমা, হৈমবতী, আমাদের ঘরের মেয়ে। কালিকাপুরাণ মতে, কখনও তিনি উগ্রচণ্ডা, কখনও ভদ্রকালী, আবার কখনও কাত্যায়নী দশভুজা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধন। তাই আগামী শুক্লাপক্ষের ষষ্ঠীতে বেলগাছ বা বিল্ববৃক্ষের নীচে দেবীর বোধন ঘটল অন্য বছরের মতোই। ঘুমন্ত দেবীর নিদ্রাভঙ্গ করে হল বোধন।
ঘূর্ণী উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাক্তন শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy