প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। —ফাইল ছবি।
নতুন বছর শুরু হয়ে গেল। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেষ হয়েছে আগের বছর। খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব-নিকেশ করা যায়। দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ফিরে দেখা অনেক সময় আগামীর সংকল্প ও আশু প্রয়োজনীয়তা ঠিক করতে সাহায্য করে। অবশ্য বর্তমান ঘটনাগুলি আর্থসামাজিক প্রয়োজনীয়তাকে পেছনের সারিতে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক ও চর্চা এমন এক মাত্রায় পৌঁছেছে যে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি আলোচনার মূল স্রোত থেকে বহুদূর চলে গিয়েছে। রাজপথের মিছিল, ছাত্রছাত্রীদের লাগাতার আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় শক্তির দমননীতি— এ সবই এখন আলোচ্য বিষয়। নাগরিকত্ব বিষয়ে প্রতিবাদ যে এই স্তরে পৌঁছবে তা কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল কল্পনা করতে পারেনি। কেন্দ্রের দুই শীর্ষকর্তা— প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় স্ববিরোধী কথা বলছেন। ফলে বিভ্রান্তি আরও বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে চলছে মিথ্যাচার। তা সে ডিটেনশন ক্যাম্পের অস্তিত্ব নিয়েই হোক বা সদ্গুরুকে প্রচারের মাঠে নামানো নিয়েই হোক। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে চলচ্চিত্রের নায়ক, নায়িকাদের মাঠে নামিয়ে। আসলে সুচারু ভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এটাই চায়। মানুষে মানুষে লড়িয়ে দাও, ভুলিয়ে দাও তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকারবোধ। কিন্তু এই ভুলে যাওয়াটা সাময়িক। তাই নতুন বছরের সেই পিছনের সারিতে চলে যাওয়া আর্থসামাজিক বিষয়গুলি তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা আছে।
নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরে দেশের অর্থনীতি নানা সমস্যায় জর্জরিত। যার জন্য দায়ী সরকারের বিতর্কিত নীতি ও পদক্ষেপ। একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক অর্থনীতিতে প্রথম ও জোরালো নেতিবাচক ধাক্কা দেয় নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত। ২০১৬ সালের নভেম্বরের নোটবন্দির ঘোষণা অর্থনীতির গতিপথকে এমন এক ভয়াবহ স্রোতে ভাসিয়ে দেয়, যা থেকে এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রকে পুরো পঙ্গু করে দেয় সেই নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত। বলা হয়ে থাকে, সে দিন থেকেই অর্থনীতি ‘আইসিইউ’তে চলে গিয়েছে। যার ফল, আজকের ব্যাপক বেকারত্বের হার, একের পর এক বহুজাতিক সংস্থার লোকসান, প্রায় তলানিতে চলে যাওয়া বৃদ্ধির হার, কমতে থাকা সুদের হার। সব মিলেমিশে এক সর্বোপরি অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সূত্রে আমরা জানি যে নোট বাতিলের সময় প্রধানমন্ত্রী ৫০ দিন সময় চেয়ে ছিলেন সেই সিদ্ধান্তের তথাকথিত উপকারিতা বোঝার জন্য। ৫০ কেন, ৫০০ দিন পেরিয়ে গিয়েছে, এখনও সেই নোট বাতিলের ভয়াবহতা অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকট হয়ে উঠেছে। তিন বছর আগে জিডিপির বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। আর আজকে তার অর্ধেক, প্রায় ৪.৫ শতাংশ। স্বাধীন ভারতের জিডিপির হার এত কম আর কবে ছিল তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। আর আমরা প্রধানমন্ত্রীর সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করে উঠতে পারিনি।
আরও পড়ুন: নকল নয়, বরং আসল ইতিহাসে ডুব দিয়ে দেখি
বাজারে কেনাকাটা কমছে, গাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা প্রায় তলানিতে। তাই ক্রেতারা নতুন করে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ভোগ্যপণ্য কিনতে অনিচ্ছুক। এর জেরে টান পড়েছে লগ্নিতে। কোন সংস্থাই হাত খুলে উৎপাদন বাড়ানোর উপরে জোর দিচ্ছে না। ফলে সংগঠিত ক্ষেত্রে শিল্পের উৎপাদন মাত্রা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। ক্রমাগত কমতে থাকা সুদের হারের জন্য বিদেশি লগ্নিও মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির গতি শ্লথ হওয়ার জন্য রফতানিতেও তার রেশ পড়েছে। তাই অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নগামী। বলাবাহুল্য যে এই সব সূচক শুধু কোন দেশীয় সংস্থার তৈরি করা নয়। নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার তৈরি করার সূচকগুলিও ঐতিহাসিক ভাবে নিম্নগামী। শুধু ঊর্ধ্বগামী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলা হয় স্ট্যাগফ্লেশন, অর্থাৎ থমকে যাওয়া অর্থনীতিতে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের কোন দিশাই দেখাতে পারছে না সরকার। অন্য দিকে, রাজকোষের ঘাটতি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে হয়েছে ৭.২ লক্ষ কোটি টাকা যা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ১০২.৪ শতাংশ। হবে নাই বা কেন। ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে জিএসটি বাবদ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া অসম্ভব। নোট বাতিলের মতো তুঘলকি সিদ্ধান্ত অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে সংগঠিত ক্ষেত্রে প্রবল ভাবে কাঁপুনি দেওয়া শুরু করেছে। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আজকের এই স্ট্যাগফ্লেশন।
আরও পড়ুন: একা নয়, অনেকে মিলে
আমরা প্রশ্ন করে উঠতে পারিনি কালো টাকা উদ্ধারের সরকারের সেই আপোষহীন নীতির ফলাফল নিয়ে। ক্রমাগত জমতে থাকা অনাদায়ী ঋণ ব্যাঙ্কগুলিকে, বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়েছে। আরবিআই একটি সূত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৬.২ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিজয় মাল্যের আট হাজার কোটি টাকা, নীরব মোদির ১৩ হাজার কোটি টাকা ও মেহুল চোক্সির কয়েকশো কোটি টাকা কেলেঙ্কারি মিশে আছে। আরবিআই-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে আমরা জানতে পারি যে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি প্রায় ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। টাকার পরিমাণে এই ব্যাংক জালিয়াতি প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭১ হাজার কোটি টাকা। এই হারে ব্যাংক জালিয়াতি ও অনাদায়ী ঋণ চলতে থাকলে সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক আর কিছু দিনের মধ্যে লাটে উঠবে। কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক রুগ্ন হয়ে গিয়েছে সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের ফলে সেই অনাদায়ী ঋণগুলি উদ্ধারের আশাও জলাঞ্জলি দিতে হল।
দুর্নীতির প্রশ্নে রাজ্যের পরিস্থিতি আদৌ সুখকর নয়। সারদা ও নারদা কাণ্ডের তদন্ত চলছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। কয়েক জন দীর্ঘদিন জেলে রয়েছেন। পাশাপাশি, এ বছর কাটমানি কাণ্ড প্রমাণ করছে দুর্নীতির জাল নিচু স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এ বছরে কি এই অন্ধকার থেকে মুক্তি মিলবে? আমরা আশা ছাড়া আপাতত কিছুই করতে পারি না।
লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy