নিত্য হয়রানির চিত্র।—নিজস্ব চিত্র।
নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে বিজেপির শীর্ষনেতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইডু একটা মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন রোলব্যাক নামক বস্তুটি নরেন্দ্র মোদীর রক্তেই নেই। হক কথা বলেছেন বেঙ্কাইয়া। নরেন্দ্র মোদী নামক মানুষটিকে আমিও আজ নতুন দেখছি না। তিন দশক ধরে এই মানুষটিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এখন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। ঠিক যে ভাবে আগে তিনি সময় দিতে পারতেন, যে ভাবে যখন তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারতাম এখন সে ভাবে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমি সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলে তাঁর ভাবনাচিন্তা জানতে চাই, ঠিক যে ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁর রাজনীতি বুঝতে চাই। কিন্তু বিজেপি আর তৃণমূল রাজনীতি কোন পথে চলা উচিত সেটা নিয়ে ওঁদের মতামত দেওয়ার কোনও প্রয়োজন না আমার আছে, না ওঁদের আছে। আবার বিরোধী নেতারা যাঁরা ক্ষমতায় নেই তাঁদের কাছে বেশি যাই কারণ বিক্ষুব্ধ বিরোধী নেতাদের হাতে সময়ও বেশি থাকে, কথা বলার প্রয়োজনও তাঁদের বেশি।
যাই হোক মোদীর কথায় ফিরে আসি। মোদীকে দেখেছি ওঁর মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর জেদ আছে। মমতার মধ্যেও যেমন আছে। সমাজতাত্ত্বিকেরা কেউ কেউ বলেন, যে সব নেতা তলা থেকে উঠে এসেছেন, লড়াই করেছেন এই শীর্ষাসনে পৌঁছনোর জন্য, তাঁদের মধ্যে একটা রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য থাকে। এঁদের মধ্যে একটা ‘ডিনায়াল মোড’-ও থাকে। এই আহত ইগো কমপ্লেক্স-এর চূড়ান্ত রূপ আমি দেখেছিলাম ফুলনদেবীর মধ্যে।
এক জনসভায় নরেন্দ্র মোদী।
তাই নোট বদলের সিদ্ধান্তের যত প্রতিবাদ হচ্ছে, যত মোদী-বিরোধী হুঙ্কার হচ্ছে মোদী তাই আরও অনড় হচ্ছেন। রাজনেতা তিনি, ঝুঁকি নিতে পারেন এবং মোদী ঝুঁকি নিয়েওছেন। মমতা নিয়েছেন বিরোধিতার ঝুঁকি। কিন্তু স্বভাবগত ভাবে মোদী মচকাবেন কিন্তু ভাঙবেন না।
যখন কেশুভাই পটেল গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিধায়কেরা যখন বিদ্রোহ করতে শুরু করেন তখন নরেন্দ্র মোদী সেই বিক্ষুব্ধ কর্মীদের নেতৃত্ব দিতেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি চাননি তবু নরেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী হতে সক্ষম হয়েছিলেন। লালকৃষ্ণ আডবাণী মোদী সম্পর্কে বলেন, ওর মধ্যে একটা অসম্ভব জেদ আছে। আডবাণীর নিজের ভাষায়, এক ‘তীব্র সঙ্কল্প’, সেই সংকল্প সেই বাসনার লক্ষ্যে কোনও হতাশা নেই। কোনও ছোট ছোট ব্যর্থতায় মোদী ভেঙে পড়েন না।
এ বারেও তিনি খুব চাপের মুখে, এটা কি নরেন্দ্র মোদী বুঝতে পারেন না যে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও হোমওয়ার্ক করার প্রয়োজন ছিল? ব্যাঙ্ক প্রশাসন ও সার্বিক প্রশাসন যে সুষ্ঠ পরিষেবা দিতে ব্যর্থ এটা নিয়ে কি কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে মনে হচ্ছে যেন দেশের সমস্ত মানুষ চোর, কালোবাজারি আর শুধু নরেন্দ্র মোদী একাই সততার পরাকাষ্ঠা। এই ধরনের আচমকা সিদ্ধান্তে সত্যি সত্যিই কি ভারতের সমান্তরাল কালো টাকার অর্থনীতি বন্ধ হয়ে যাবে? সমগ্র কালো অর্থনীতির মধ্যে কালো টাকার কারবার শতকরা মাত্র ৬ ভাগ। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদী হয়তো বুঝছেন, বুঝছেন বলেই প্রায় প্রতি দিন নতুন নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি হচ্ছে।
তবু বলব, মোদী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাঁর সিদ্ধান্তে। গুজরাতের ঘটনার পর যখন মোদী চূড়ান্ত রক্ষণাত্মক, দলের ভিতরে ও বাইরে তিনি তখন খলনায়ক, তখনও দেখেছি তিনি আরও আক্রমণাত্মক। আমেরিকা ভিসা দিচ্ছে না, তবু তার তোয়াক্কা না করে তিনি এগিয়েছেন এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন।
তবু ভয় হয়, এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতন্ত্রের যে শিকড় আছে তাকে উপড়ে ফেলা হবে না তো? রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ দেশের গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে। সেই ঐকমত্য, সেই বহুত্ববাদ কি বিপন্ন হচ্ছে না? প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থে লিখেছেন, সমস্যা জটিল হয় যখন রাজনেতারা নিজেদের শাসনের প্রেমে পড়ে যান। যাকে বলা হয় রাজনৈতিক নার্সিসিজম। কম-বেশি সব রাজনীতিকেরই এই দোষ দেখা যায়। নন্দীগ্রামে গুলি চলার পরেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মানতে চাননি। তিনি আমাকে বলেছিলেন মানুষ বোকা নয়। মানুষ মমতার সঙ্গে নয়, আমাদের সঙ্গেই থাকবে। বাজপেয়ী সরকারের পতনের সঙ্গেও ওরা ফিল গুড ফ্যাক্টর আর ইন্ডিয়া সাইনিং নিয়ে গর্বিত উদ্ধত হয়ে উঠেছিল। প্রমোদ মহাজন, অনন্ত কুমারের কথা তো ছেড়েই দিলাম, লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো লোকও আমার কাছে বলেছিলেন, মানুষ অবুঝ নয়। কংগ্রেস যুগ শেষ! তার পর কী হয়েছিল আমরা সবাই জানি। মোদী আজ রেসকোর্স রোডের বাড়িতে বসে পেখম মেলা ময়ূর দেখতে দেখতে বুঝতেই পারছেন না, আড়াই বছরে অসন্তোষ কতটা বেড়েছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy