ফাইল চিত্র।
রামমন্দিরের ভূমিপূজায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চিন-সহ এশিয়ার নানা দেশে রাম তথা ‘রামায়ণ’-কথার বিস্তারের উল্লেখ করেছিলেন। ২০১৮-য় আসিয়ানভুক্ত দেশগুলিকে নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল ‘আন্তর্জাতিক রামায়ণ সম্মেলন’ও। অর্থাৎ রাম ও রামায়ণকে কেন্দ্র করে এক কূটনৈতিক আবহ প্রস্তুত করার চেষ্টা চলছে।
কিন্তু এই আবহটির যথার্থতা তখনই, যখন এই রাম-কথা ও তার বিস্তারের ধারাবাহিক বৈচিত্রটির অন্বেষণ করা সম্ভব হবে। এই বৈচিত্রকে আমরা দু’ভাবে খুঁজতে পারি: প্রথমত, কী ভাবে এই কথার বিস্তার ঘটল, সেই পথ-বৈচিত্রের কথা চর্চা করে। দ্বিতীয়ত এবং প্রধানত, আখ্যানভাগের বৈচিত্র ও রামায়ণ প্রসঙ্গে ভিন্দেশের আগ্রহের বিষয়টি নজরে রেখে। তবে, নানা জায়গার বিস্তৃত রামকথার আলোচনায় না গিয়ে সমসময়ে চর্চিত চিন, ইন্দোনেশিয়া ও নেপালের শুধুমাত্র লেখ্য-প্রসঙ্গটি আমরা তুলতে পারি।
গবেষকদের মতে, রাম এবং রামায়ণ এই ভারতভূম থেকে এশিয়ার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে মূলত দু’টি স্থলপথ এবং একটি জলপথ ধরে। পঞ্জাব, কাশ্মীর হয়ে উত্তরাভিমুখে স্থলপথে রামের কথা পৌঁছয় চিন, তিব্বত ও পূর্ব তুর্কিস্তানে। এই সূত্রটির বিস্তার মূলত বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে। অন্য স্থলপথটি, বঙ্গদেশ থেকে পূর্বাভিমুখী হয়ে মায়ানমার, তাইল্যান্ড, লাও, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে। আর জলপথের মাধ্যমে রাম-কথা গুজরাত এবং দক্ষিণ ভারত থেকে পৌঁছয় জাভা, সুমাত্রা, যবদ্বীপ অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া-সহ ‘দ্বীপময় ভারতে’। সম্ভবত এই সাগর-পথটির ঐতিহ্য স্মৃতিতে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। তাই হয়তো বলছেন— মন্দাকিনীর কলধারা সেদিন ছলোছলো/ পুব সাগরে হাত বাড়িয়ে বললে, “চলো, চলো।”/ রামায়ণের কবি আমায় কইল আকাশ হতে, “আমার বাণী পার করে দাও দূর সাগরের স্রোতে।” (শ্রীবিজয়লক্ষ্মী)
এই সব ক’টি দেশের মধ্যে চিনের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। কারণ, সমসময়ে চিনের সঙ্গে সীমান্তে টানাপড়েন। এই পরিস্থিতিতে ভারত থেকে রামায়ণ-যোগের কথা বলে চিনকে কূটনৈতিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। বহির্বিশ্বে ‘রামায়ণ’-এর সম্ভবত প্রাচীনতম লিখিত উল্লেখটি রয়েছে চিনে প্রচলিত অনূদিত ‘মহাবিভাষা’য়। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘রামায়ণ’-এ শ্লোক সংখ্যা ১২ হাজার। অথচ, ‘বাল্মীকি রামায়ণ’-এ রয়েছে ২৪ হাজার শ্লোক।
আখ্যানভাগের বৈচিত্র প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, চৈনিক ত্রিপিটকের অন্তর্গত দু’টি জাতকে রাম-কথার ছায়া দেখা যায়। একটি, ‘অনামক জাতক’, অন্যটি, ‘রাজা দশরথের নিদান’। অনামক বা নামহীন ওই জাতকে রাম রাজাই এবং তিনি বোধিসত্ত্ব। কিন্তু এখানে তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্ব রাবণের সঙ্গে নয়, আপন মামার সঙ্গে। মামা রাজ্য কেড়ে নিতে আসছেন শুনে জীবহত্যার সম্ভাবনার কথা ভেবে তিনি স্বেচ্ছা-নির্বাসনে চলে যান। এক নাগ সাধুবেশে তাঁর স্ত্রীকে হরণ করলে বানর সৈন্য সমাবেশে তাঁকে উদ্ধার করেন। এই জাতকের শেষে ভগবান গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুদের বলছেন, “ওই রাজাটি ছিলাম আমিই। রানির নাম গোপী। আর মামাটি ছিল দেবদত্ত।” এ দিকে, অন্য জাতকটির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, রাম (লোমো) নির্বাসনে যান ১২ বছরের জন্য, বাল্মীকি রামায়ণের মতো ১৪ বছর নন।
চিনের পাশাপাশি, তিব্বতেও এই দু’টি কাহিনি প্রচলিত। কিন্তু, তিব্বতের রাম-কথার প্রসঙ্গ উঠলে নজর দেওয়া দরকার রাম-কিংবদন্তির দিকে। সেখানে আখ্যানটি এমন: রাবণের কন্যা সীতা; কিন্তু জন্মছক অনুযায়ী, সীতা পিতার ধ্বংসের কারণ হবেন। এই পরিস্থিতিতে সীতাকে সাগরে নিক্ষেপ করা হয়। ভারতীয় কৃষকেরা ওই শিশুকন্যাকে উদ্ধার করে রাজা জনককে উপহার দেন। এই বিষয়টি নিয়ে ১৯৫০-এ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছিলেন বেলজিয়ামের হিন্দি পণ্ডিত ক্যামিল বুলকে।
চাষির কথা উঠলই যখন, তখন একটু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে রাম-চরিত্র সম্পর্কে একটি তত্ত্বের কথাও উল্লেখ করা যায়। তত্ত্বটি এমন: ‘হিন্দু’র সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তিন জন রামের কথা আমরা জানি— দাশরথিরাম অর্থাৎ শ্রীরাম, পরশুরাম এবং বলরাম। এই ক্রমটিতেই তর্কসাপেক্ষ ভাবে আর্য সভ্যতার পর্বগুলিকে বোঝার চেষ্টা করেন অনেকে। সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ধারণাটি এমন— তির ও ধনুকে সজ্জিত দাশরথিরাম জঙ্গল থেকে হিংস্র জন্তুদের বিতাড়নের শক্তির প্রতীক। কুঠারধারী পরশুরাম জঙ্গল সাফ করে চাষ জমি নির্মাণের প্রতীক এবং লাঙলধারী বলরাম কৃষি-সভ্যতার প্রতীক।
এই তত্ত্বের ইঙ্গিত কি রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও পাওয়া যায়? কৃষি সভ্যতা এবং অরণ্যের দ্বন্দ্বটিকে কিন্তু তিনি অনুধাবন করেছিলেন। এর মহাকাব্যিক যোগ নিয়েও হয়তো তিনি সচেতন ছিলেন। তিনি লিখেছেন, “আর্যাবর্তের পূর্ব অংশ থেকে ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত কৃষিকে বহন করে ক্ষত্রিয়দের যে-অভিযান হয়েছিল সে সহজ হয় নি; তার পিছনে ঘরে-বাইরে মস্ত একটা দ্বন্দ্ব ছিল। সেই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস রামায়ণের মধ্যে নিহিত, অরণ্যের সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রের দ্বন্দ্ব।” (জাভা-যাত্রীর পত্র)
ফিরে আসা যাক রাম-কথা ও পড়শি দেশের প্রসঙ্গে। সম্প্রতি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি বলার পরে দক্ষিণ নেপালের বীরগঞ্জের একটি গ্রামে রামের সম্ভাব্য জন্মস্থানের খোঁজে ‘অযৌক্তিক’ খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে সে দেশের পুরাতত্ত্ব বিভাগ। সঙ্গত কারণেই এ সব উদ্যোগের বিরোধিতাও করে ভারত। এ দিকে, ‘মাঘ মাসের উত্তরিয়া বাতাস’ বইলে বাঙালি-মন সঙ্গ নেয় কালকূটের। ‘রাম বিবাহের বরযাত্রী’ হয়ে বাঙালিও ছোটে পুরনো দিনের জনকরাজার রাজ্যে। প্রশ্ন জাগে, জনকপুরেই কি যুগান্তরে বিয়ে হয়েছিল রাম-সীতার? আবার সঙ্গে কৌতূহলও, ‘কেমন দেখতে ছিলেন সেই কন্যাটি?... সত্যি কি সেই কন্যা অযোনিজাতা, জনকরাজের হলকর্ষণের সময়ে, হলের অগ্রভাগে তাঁকে পাওয়া গিয়েছিল?’ (বাণীধ্বনি বেণুবনে) এই সূত্রে, একটু প্রসঙ্গান্তর হলেও, কম্বোডিয়ায় প্রাপ্ত দশম শতকের একটি শিলালেখে উৎকীর্ণ শ্লোকটির কথা মনে পড়তে পারে, “অযোনিজাং যো জনকোপনীতাং সীতাং সতীং রাম ইবোদুবাহ।”
রাম ও রামায়ণ সম্পর্কে নেপালি ভাষা-সাহিত্যের আগ্রহ কিন্তু কয়েক শতাব্দীর। নেপালি ভাষার আদিকবি ভানুভক্ত আচার্যের ‘বাল্মীকি রামায়ণ’-এর অনুবাদ সুপ্রচলিত। কিন্তু তারও আগে নেপালি ভাষার দুই সাহিত্যিক গুণানিপন্থ ও রঘুনাথ ভট্টও এই কাজটি নিয়ে বহু দূর এগিয়েছিলেন। তবে, রঘুনাথ বারাণসীতে থেকে বাল্মীকি রামায়ণ নয়, ‘অধ্যাত্ম রামায়ণ’-এর সাত খণ্ড অনুবাদ করেন।
সম্প্রতি ভারতে এসেছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবৌ সাবিয়ান্তো। দু’দেশের নৌ-সেনার মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো নিয়েও কথা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই ‘বন্ধন’ মজবুত করতে পারে সে দেশের রাম-কথার দীর্ঘ ঐতিহ্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগসূত্রটি। এই ঐতিহ্য, বৈচিত্র ও বর্তমানের যোগসূত্রটি দেখান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও: “...রামায়ণ-মহাভারতের নরনারীরা ভাবমূর্তিতে এদের দেশেই বিচরণ করছেন; আমাদের দেশে তাঁদের এমন সর্বজনব্যাপী পরিচয় নেই, সেখানে ক্রিয়াকর্মে উৎসবে আমোদে ঘরে ঘরে তাঁরা এমন করে বিরাজ করেন না।” (জাভা-যাত্রীর পত্র)
ইন্দোনেশিয়ায় অন্তত ছ’ধরনের লিখিত নিদর্শনে রাম-কথা প্রচলিত। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যোগীশ্বর রচিত ‘কাকাবিন রামায়ণ’। কিন্তু এখানে ‘বাল্মীকি রামায়ণ’ নয়, বরং মূলত ‘ভট্টিকাব্য’ অনুসৃত হয়েছে। এখানে বালকাণ্ড অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মূল বাল্মীকি রামায়ণের মতো এখানেও উত্তরকাণ্ড অনুপস্থিত। পাশাপাশি, ভট্টিকাব্য অনুসরণে এখানেও কোনও রকম মঙ্গলাচরণ ছাড়া কাব্যটি শুরু হচ্ছে। এ দেশে প্রচলিত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাম-কথা ‘সেরৎ কাণ্ড’। এখানে আখ্যানভাগের বিশেষত্ব মূলত মন্দোদরীকে কেন্দ্র করে। এই আখ্যান অনুযায়ী, রহবন ও নকল বন্দোদরীর কন্যা ‘শ্রী’র অবতার সীতাদেবী বা সিন্তদেবী। ‘নকল’— কারণ, বন্দোদরী আসলে মন্দ্রপুরের রাজা দশরথের মহিষী। রহবন তাঁকে দাবি করে বসলে, বন্দোদরী নিজের প্রতিরূপ গড়ে রহবনের কাছে তাঁকে পাঠান। পরে, বিষয়টি জানতে পেরে রহবন ঠিক করেন, কন্যা হলে তাঁকে বিবাহ করবেন! এই পরিস্থিতিতে কন্যাটিকে সাগরে ভাসিয়ে দিলেন মা। পরবর্তী কাহিনি বাল্মীকি রামায়ণের অনুরূপ।
রামায়ণকে কূটনীতির সেতু হিসেবে ব্যবহার করা কতখানি কার্যকর হবে, সে প্রশ্ন ভিন্ন। কিন্তু, সেই চেষ্টা করা হলে প্রথমে বুঝতে হবে, মহাকাব্যের বীজটি ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়লেও এক এক দেশের জলহাওয়া তাকে এক এক ভাবে গড়েছে। এই উপলব্ধির মধ্য দিয়েই হয়তো বহুত্ববাদকে স্বীকার করার অভ্যাসও তৈরি হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy