Advertisement
২৪ জানুয়ারি ২০২৫

পুলিশমন্ত্রীর ভাষণ শুনে চমকে উঠেছিল নবগ্রাম

মুর্শিদাবাদের সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিন বদলাতে শুরু করে ১৯৭২ সাল নাগাদ। চরমে পৌঁছয় ২০০৪ সালে। আর এখন তো একেবারে ক্লাইম্যাক্স চলছে! লিখছেন অনল আবেদিনশঙ্করদাস পালকে অবশ্য জেলে যেতে হয়নি। পুরমন্ত্রী ক্ষমতা বলে নির্বাচিত পুরবোর্ড ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন।

মতাদর্শের রাজনৈতিক পালা শুনতে মুখিয়ে থাকত আমজনতাও।

মতাদর্শের রাজনৈতিক পালা শুনতে মুখিয়ে থাকত আমজনতাও।

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০৩:০৪
Share: Save:

রাজ্য-রাজনীতি তখন উথাল-পাথাল। স্বাধীন ভারতে অকংগ্রেসি রাজনীতির চর্চায় সেই প্রথম ঢুকে গেল খেত-খামার, কল-কারখানা, নদী-নালা। সেই প্রথম এই রাজ্যে অকংগ্রেসি সরকার গড়ার সম্ভবনা দেখা দেয়। সম্ভবনা কয়েক মাসের জন্য বাস্তবও হল। অকংগ্রেসি দলগুলো ১৯৬৭ সালের বিধানসভার ভোটে দু’টি শিবিরে বিভক্ত। সিপিএমের নেতৃত্বে গড়া হয়েছে ‘ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট’ (ইউএলএফ), লোকমুখে ‘উলফ’। সিপিআই ও বাংলা কংগ্রেসের নেতৃত্বের দ্বিতীয় জোটের নাম ‘পিপলস ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট’ (পিইউএলএফ), লোকমুখে ‘পালফ’। পালফের পক্ষে বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিআই-এর নির্বাচনী প্রতীক ‘কাস্তে ধানের শিস’-এর প্রার্থী ছিলেন সনৎ রাহা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কংগ্রেসের শ্রীপদ ভট্টাচার্য।

মুর্শিদাবাদ জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সনৎ রাহার পক্ষে বহরমপুর গ্রান্টহল ময়দানে নির্বাচনী জনসভা চলছে। মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক বিষাণ গুপ্ত বলছেন, “নির্বাচনী জনসভায় সনৎ রাহা বলেন, ‘কংগ্রেস জোতদার, জমিদার, পুঁজিপতিদের দল। ওদের অর্থনীতি বড়লোকের অর্থনীতি। কমিউনিস্টরা চায় সমাজতন্ত্র।’ ভুল করেও তিনি কিন্তু কোনও ব্যক্তিগত আক্রমণে গেলেন না।’’

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বক্তব্যও তিনি শুনেছেন। বিষাণ বলেন, ‘‘শ্রীপদ ভট্টাচার্য তাঁর প্রচারসভায় বলেন, ‘কংগ্রেস দেশ স্বাধীন করেছে। আর কমিউনিস্টরা চিন-ভারত যুদ্ধে চিনের দালালি করেছে। ওরা রাশিয়ার দালাল। ওদের ভোট দিয়ে দেশকে বিপন্ন করবেন না।’ তিনিও ব্যক্তি আক্রমণে যাননি।’’ মতাদর্শের ওই রাজনৈতিক পালা শুনতে আমজনতাও তখন মুখিয়ে থাকত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মুর্শিদাবাদ লোকসভা ও রানিনগর বিধানসভায় ১৯৫৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কয়েক বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। ছ’টি ভাষায় পারদর্শী সৈয়দ বদরুদ্দোজা ছিলেন সালারের তালিবপুরের ভূমিপুত্র। তীব্র কংগ্রেস বিরোধী বদরুদ্দোজা ১৯৪৩-৪৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর ভাষণ শুনতে ১০-১২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম গ্রামান্তরের অসংগঠিত লোকজন পায়ে হেঁটে সভাস্থলে পৌঁছতেন। সভা শেষে বাড়ি ফেরার দৃশ্যও ছিল অন্য প্রকৃতির। জ্বলন্ত হ্যারিকেন হাতে মেঠো পথ ধরে সভা ফেরত সর্বদলীয় মানুষের সারি দেখে মনে হত যেন আলোর মিছিল।

সারা পথ তাঁরা নিজেদের মতো করে রাজনৈতিক নেতার ভাষণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে করতে হাঁটতেন। বদরুদ্দোজার ভাষণের নানা প্রসঙ্গ আজও মনে আছে রানিনগর থানা এলাকার কাতলামারি হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মুর্শিদাবাদ জেলার সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাসের গবেষক খাজিম আহমেদের। তিনি বলেন, “বদরুদ্দোজার ভাষণে নানা প্রসঙ্গ এলেও তিনি কিন্তু ঘুরে ফিরে বলতেন, ‘দেশভাগের জন্য দায়ী কংগ্রেস। জন্মভূমিকে ভালবেসে যাঁরা পাকিস্তানে যাননি তাঁদের নিরাপত্তা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার কথা কিন্তু ভাবে না কংগ্রেস। তবুও আপনাদের বলব, বিদেশের সোনাঝরা মাটির থেকেও পূণ্যস্থান স্বদেশের মাটি। আপনাদের কথা আমি লোকসভায় তুলে ধরব। আপনারা ভুল করেও স্বদেশ ত্যাগ করবেন না।’ সংখ্যালঘুদের দাবিতে সরব থাকার পাশাপাশি বদরুদ্দোজা এ ভাবে স্বদেশপ্রেম সঞ্চারিত করতেন।’’ তিনিও কখনও কোনও কুকথা মুখে আনেননি। মতাদর্শ ছাড়া, কখনও বিরোধীদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত কোনও প্রসঙ্গ তাঁর মুখ থেকে শোনা যায়নি কখনও। মুর্শিদাবাদের এই সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিন বদলাতে শুরু করে ১৯৭২ সাল নাগাদ। চরমে পৌঁছয় ২০০৪ সালে। আর এখন তো ক্লাইম্যাক্স চলছে!

তখন ইন্দিরা কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক ‘গাই বাছুর’। ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে তখন সিপিআই-এর গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গিয়েছে। তাই নিয়ে দেওয়ালে লেখা হল— ‘দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই’। ওই বক্রোক্তি সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এক দিকে ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা’, অন্য দিকে ইন্দিরা গাঁধীকে ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী ডাইনি’ বলে পরস্পর বিরোধী প্রচারশুরু হল মুর্শিদাবাদেও। এ জেলার রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের একটি মহলের মতে, ব্যক্তি আক্রমণের সেই শুরু। স্থান: ওল্ড কালেক্টরেড মোড়। কাল: ১৯৮৯। বহরমপুর শহরের মানুষ প্রকাশ্য জনসভায় ভাষণে সেই প্রথম সরাসরি ব্যক্তি আক্রমণের সাক্ষী থাকলেন। বক্তা তৎকালীন পুরমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

তখন বহরমপুরের পুরপ্রধান কংগ্রেসের শঙ্করদাস পাল। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ নিয়োগ ও এক খাতের টাকা অন্য খাতে খরচের অভিযোগ তুলে পুরমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন, “চেয়ারম্যান ভেবেছেটা কী! পার পেয়ে যাবে ভাবছে? না, না! কোমরে দড়ি বেঁধে তাকে টেনে নিয়ে যাব জেলে। জেলের ঘানি টানতে হবে তাঁকে।”

শঙ্করদাস পালকে অবশ্য জেলে যেতে হয়নি। পুরমন্ত্রী ক্ষমতা বলে নির্বাচিত পুরবোর্ড ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। তার কয়েক সপ্তাহ পরে হাইকোর্টের রায়ে জেলের বদলে শঙ্করদাস পাল পুরসভা ফিরে পেয়েছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখের উপর মোক্ষম জবাব দিয়ে শঙ্করদাস পাল ফের পুরপ্রধানের চেয়ারে বসেন।

তার কয়েক বছর পরে ১৯৯৬ সালের ভোটে নবগ্রাম বিধানসভায় সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য মুজাফ্ফর হোসেনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কংগ্রেস প্রার্থী, ফেরার অধীর চৌধুরী। নবগ্রামের নির্বাচনী জনসভায় পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হুঙ্কার ছিল, “মাফিয়া ডন ভেবেছেটা কী? টাকা দিয়ে ভোট কিনবে? মেরে ওর মাথা গুঁড়িয়ে দেব।” ফেরার থাকায় অধীরের পক্ষে পাল্টা জবাব দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে বার ভোটে জিতে প্রথম বিধায়ক হন অধীর চৌধুরী।

ওই বছরেই বহরমপুর শহরে দুই ভিভিআইপি বন্ধু প্রকাশ্য নির্বাচনী সভায় পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সমালোচনায় জড়িয়ে পড়েন। এক জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, পঞ্জাবের পূর্বতন রাজ্যপাল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তিনি সে বার বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী। অন্য জন সেই সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।

অন্য বিষয়গুলি:

লোকসভা ভোট ২০১৯ Lok Sabha Election 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy