ছবি সংগৃহীত।
ট্রাকের পাটাতনের নীচে বসে ১২০০ কিলোমিটার দূরের মথুরা থেকে হরিশ্চন্দ্রপুরে বাড়ি ফিরেছেন শ্রমিকেরা।
ওড়িশা থেকে বাইকে মালদহে ফেরার পথে পশ্চিম মেদিনীপুরে ধরা পড়লেন কিছু শ্রমিক।
১০০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরল এক পরিবার। সবাই ফিরছেন। ফিরতে চাইছেন। তার জন্য দু’দিন ধরে ১২০০ কিলোমিটার রাস্তা বস্তায় ঢাকা পাটাতনের নীচে বসে থাকতেও রাজি ওঁরা।
কিন্তু কেন? আপাতদৃষ্টিতে খুবই বালখিল্য মনে হলেও এই একটা প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর খুঁজতে গেলেই চলে আসে অনেক কিছুই। সারা বিশ্বের এত দেশের উপর করোনাভাইরাসের মারণ প্রভাব আর হাহাকার থেকে একটা জিনিস তো স্পষ্ট, এ রোগ থেকে বাঁচতে গেলে ভিড় এড়াতে হবেই। প্রতিষেধক কবে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে যখন কোনও নিশ্চয়তা নেই, সাবধান আমাদের থাকতেই হবে। আর তার প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হল, ভিড় এড়ানো।
সরকারি-বেসরকারি-আন্তর্জাতিক—সর্বস্তরে তাই একটাই প্রচার চলছে সব সময় ছোঁয়া এড়িয়ে চলুন, কম বাজারে বেরোন এবং যতটা সম্ভব জিনিস কিনে নিন, খাবার মজুত করুন ইত্যাদি ইত্যাদি।
অত্যন্ত বাস্তবসম্মত উপদেশ, নিজেদের ভালর জন্যই আমাদের তা মেনে চলা উচিত।
কিন্তু তা হলে প্রশ্ন ওঠে, এই শ্রমিক, নির্মাণকর্মীরা কেন ফিরতে চাইছেন এই সময়? প্রাণের মায়া নেই? অনলাইন শপিং করে বা পাড়ার দোকান থেকে ব্যাগভর্তি জিনিস কিনে বাড়ি ফিরে আমেজ করে বসে চা খেতে খেতে এ সব কথা হয়তো আমাদের মনে হয়। দিল্লিতে শ্রমিকদের সমাবেশ দেখে রাগ হয়।
কিন্তু তবু ওঁদের ভিড় করতে হয়। কারণ, তাঁদের দেশ সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হয়েও খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। তাই পাটাতনের নীচে সেই শ্রমিক দু’দিন থেকে যান এক বোতল জল, শুকনো খাবার আর যে কোনও সময় ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়েও। কারণ, তিনি তো বাড়িতে রেখে এসেছেন বৃদ্ধ বাবা-মা, ছোট্ট শিশু আর অন্তঃস্বত্তা স্ত্রীকে। রোজ একটা আতঙ্কের ফোন আসে, যেটার ওপার থেকে ভেসে আসে— বাচ্চাটার ওষুধ শেষ বা আজও কেউ খাবার দিতে আসেনি কিংবা রেশন শেষ। আর তারপর লাইনটা কেটে যায়। কারণ, ফোন করতেও যে টাকা লাগে। ‘‘টাকা তো অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনও ভাবে কিছু একটা করা যাবে— এ জন্যই বাড়ি ফিরতে চাইছি। আর কিছু না হোক নিজের মাটিতে ফিরে মরব!’’ বলছেন সদ্য ফেরা এক শ্রমিক। কিন্তু করারও তো কিছু নেই, এমনই এই ব্যাধি যে, এই ধরনের যাতায়াত বন্ধ করতেই হবে, তাতে যে ভাইরাস আরও বেশি ছড়াবে। এটাও হক কথা। কিন্তু খাবার তো দরকার। খেতে তো হবেই। আর এখানেই সমস্যায় পড়ছেন এই মানুষগুলো।
কোনও এক সন্ধ্যায় লকডাউনের ঘোষণা আর সঙ্গে অনেক ধরনের আশ্বাস। যে যেখানে আছেন, সবার কাছে খাবার পৌঁছে যাবে— দেশের অভিভাবকেরা যদি এটা নিশ্চিত করতে পারতেন, ছবিটা হয়তো পাল্টাতে পারত অনেকটাই। শোনা গিয়েছে, ভাণ্ডারে যত খাবার মজুত আছে, তাতে নাকি গোটা দেশের এক বছরের চলে যাবে। তা হলে দরকার তো শুধু পৌঁছে দেওয়ার। সেটুকুও যদি না করা যায়, ভোট-মরসুমের নমস্কার- আদাব পৌঁছলেও ত্রাণের চালের গাড়ি রাতের অন্ধকারে পাচার হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে যদি, তবে আর আঙুলে কালি লাগানোর জন্য নিজের ছবি দেওয়া একটা কাগজ বাড়িতে রেখে কী লাভ?
যদি ভিড় এড়াতেই হয়, তবে মুদির দোকান, বাজার খোলা রেখে কী ভাবে সম্ভব হবে তা? ‘কম বেরোন, একবার বেরলে পর্যাপ্ত খাবার কিনুন’ জাতীয় আতঙ্ক মাথায় থাকলে বাজারে ঠিক যে ভিড়টা হওয়ার কথা, হয়তো সেটাই হয়েছে। আর এ ভাবে বিশেষ কিছু দোকান খোলা রাখতে বলে যে ভাবে কালোবাজারির গাজর ঝুলিয়ে দেওয়া হল, তাতে বিপদে পড়ছেন এই মানুষগুলোই। কারণ, ‘ভয় পাবেন না, বাজারে খাবারের পর্যাপ্ত জোগান থাকবে’ আর পাড়ার দোকানির ‘জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না, নিতে হলে নিন, না হলে পরের জনকে পথ ছাড়ুন’—এই অসম লড়াইয়ে জিতে যান দোকানিই। আর যিনি ইমিটেশনের গয়না বিক্রি করেন বা যাঁর রোজগার হয় প্রতিদিন বাজারে ঝুড়ি বিক্রি করে, তাঁর তো সেটাই আয়ের উৎস, কিন্তু তাঁদের দোষ হল, তাঁরা জানতেন না, করোনা হলে বেছে বেছে কিছু দোকান খোলা রেখে সব বন্ধ রাখা হবে। অন্যের কাছে স্টিলের বাসন বিক্রি ‘ইমার্জেন্সি সার্ভিস’ না হলেও সংশ্লিষ্ট বিক্রেতা এবং তাঁর পরিবারের কাছে তো এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু ছিল না। তাঁরা তাই বুঝতে পারেননি তাঁদের আয়ের পথ বন্ধ করে বলা হবে খাবার কিনে রাখতে, কিন্তু কী ভাবে, তার কোনও উত্তর নেই।
ক’দিন আগে ফাঁকা রাস্তায় দেখলাম, প্লাস্টিকের খুচরো জিনিস বিক্রি করতে বেরিয়েছেন একজন। তা দেখে যারপরনাই ক্ষুব্ধ সবাই। ‘এই সময় কে এ সব কিনবে, এদের পুলিশ ধরছে না কেন? এদের কাণ্ডজ্ঞান নেই?’ কাণ্ডজ্ঞানের সত্যিই অভাব? ওঁর তো উপায় নেই আর কোনও! এ ভাবেই তো উপার্জন করেন তিনি আর তা থেকেই সংসার চলে। তাই কেউ কিনবে না জেনেও ফাঁকা রাস্তায় হাঁক দেন তিনি। কিন্তু যদি ওই ফেরিওয়ালার বাড়িতেও পৌঁছে যেত খাবার, তা হলে?
কিন্তু বাস্তব ছবিটা তেমন নয়! তাই সকালে উঠে খুদের ‘খিদে পাচ্ছে’ আর্তির মুখোমুখি না হতে লুকিয়ে বেড়াতে হয় মাকে! ‘এ বেলা শরীর ভাল নেই, খেতে ইচ্ছে করছে না’ বলে এক বেলার খাবার বাঁচান কেউ!
এখনও হয়তো চলে যাচ্ছে। কিন্তু এ ভাবে কত দিন? কেউ জানে না!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy