Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Tebhaga Movement

মেয়েদের স্বনির্ভরতা শেখাতে পথে বিমলা

বাল্যবিধবা ছিলেন। পরিজনের চক্রান্তে হারিয়েই যেতেন অন্ধকারে। তবুও ঘুরে ছিলেন জীবনের দিকে। বিমলা মাজী হয়ে ওঠেন এক আন্দোলনের মুখ।ডাকাত পরিবারের বউ হয়ে উঠলেন তেভাগা আন্দোলনে অবিভক্ত মেদিনীপুরের মুখ।

বিমলা মাজী। ছবি বিপ্লব মাজীর সৌজন্যে।

বিমলা মাজী। ছবি বিপ্লব মাজীর সৌজন্যে।

আরিফ ইকবাল খান
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০০:৩৭
Share: Save:

বছর ছয়-সাতেকের মেয়েটা দেখত, বাড়ির চৌহদ্দিতে পুলিশ। পুলিশের অত্যাচারের ভয়ে গ্রামের পুরুষেরা পালিয়ে গিয়েছিল। ট্যাক্স আদায়ে মেয়েটিদের গ্রাম চকদুর্গাপুরে নৌকা করে গোরা পুলিশ এসেছিল। সঙ্গে দেশি পুলিশও। এই মেয়েটিই বিমলা মাজী। মেয়েদের স্বনির্ভরতা স্বপ্ন দেখানো এক নাম।

কৃষক পরিবারের সন্তান বিমলা। তবে পরিবারটি সঙ্গতিসম্পন্ন ছিল। বাড়ি ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া থানার চকদুর্গাপুর গ্রামে। জন্মসাল সঠিক জানা যায় না। আনুমানিক ১৯২৫ সাল। বাবা ভাগবত মাইতি গ্রামের মাথাদেরও অন্যতম ছিলেন। আশপাশের গ্রামেরও নানা সমস্যা, অপকর্ম, দুষ্কর্মের বিচার করতেন। ভাগবত মাইতির দুই ছেলে, ছয় মেয়ে। বড় মেয়ে বিমলা। বাড়িতে রাজনৈতিক আবহাওয়া ছিল। ভাগবত কংগ্রেস করতেন। তাঁর বাড়িতে আসতেন মেদিনীপুরে প্রথম সারির বিপ্লবীরা। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, কুমার জানা, অজয় মুখোপাধ্যায়। স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হত। বীরেন শাসমলের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। ছোট ছেলের নাম রেখেছিলেন বন্ধুর নামে। বিমলার বড় দাদা প্রথমে কংগ্রেস করতেন। অনেক পরে বামপন্থী দলে যোগ দেন। ছোট দাদা বীরেন কমিউনিস্ট দলের সাংস্কৃতিক কর্মী ছিলেন।

বিমলার বিয়ে হয় মাত্র তেরো বছরে। ডেবরার মণ্ডল বাড়িতে। শ্বশুরবাড়ি বেশ অবস্থাপন্ন। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে এসে তিনি ক্রমে বুঝতে পারলেন, মণ্ডলরা ডাকাত পরিবার। মাঝে মাঝেই ডাকাতি করতে যেত। ভোরে ফিরত লুঠের জিনিসপত্র নিয়ে। কখনও খুনও করত। তেজারতি কারবারে অসহায়দের সুদের জালে ফাঁসানো, দরিদ্র চাষির টিপছাপ দিয়ে জমি বন্ধক নেওয়া ছিল তাদের কারবার। বাড়িতে লেঠেল থাকে। ভয়ে কিছু বলতে পারেন না কিশোরী বিমলা। পালিয়ে যেতে চান। কিন্ত এক ননদ তাঁকে নজরে রাখেন। একদিন এলেন ভাগবত মাইতির বিশ্বস্ত সহচর চৈতন্য মাইতি। তিনি বিমলাকে নিয়ে গেলেন। বাবার কাছে সব বললেন মেয়ে। বাবা মেয়েকে পাঠালেন না শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে পারলেন না। তখন যে বিবাহিত মেয়েদের স্কুলে নেওয়া হত না।

একদিন খবর এল, তাঁর স্বামী মারা গিয়েছেন। মাত্র ১৪ বছর বয়স তখন বিমলার। বিধবার পোশাক পরতে হল তাঁকে। ননদ এল তাঁকে নিতে। যেতে রাজি নন তিনি। কিন্তু জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়। শ্বশুরবাড়িতে তাঁকে প্রাণে মারার চেষ্টা করেছিল ননদ। প্রথমে প্রসাদে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা। কিন্তু সেই প্রসাদ না খাওয়ায় বেঁচে যান তিনি। এক বিধবা বুড়ির সহায়তায় লুকিয়ে বাপের বাড়িতে খুন হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে চিঠি লিখলেন। কিন্তু ননদ তখন অন্য ঘুঁটি সাজিয়েছে। কলকাতায় দুর্গাঠাকুর দেখানোর নাম করে বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করে। বিক্রি হয়েও গিয়েছিলেন বছর পনেরোর-ষোলোর বিমলা। তাঁকে গাজিয়াবাদ নিয়ে যাবে বলেছিল খদ্দের। কিন্তু সেই সময়েই প্রায় দেবদূতের মতো হাজির হয়েছিলেন গ্রামের দুই বাসিন্দা। তাঁরা ননদকে নির্দেশ দিলেন সন্ধের ট্রেনে সকলকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গ্রামের বিচারসভা। বিমলার ভাগের জমি বুঝে নিলেন বড় ভাই। বিমলা শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি যা পেলেন তার বেশির ভাগটাই ফিরিয়ে দিলেন মণ্ডলদের প্রতারণার শিকার হওয়া লোকজনদের। বিমলাকে চিঠি লিখতে সাহায্য করা বুড়িকেও দিলেন তাঁর জমি। তবে মণ্ডল পদবিটা ঘুচল না। তেভাগা আন্দোলনে পুলিশের রিপোর্টে তাঁর নাম বিমলা মণ্ডল।

বিমলার জীবনের পরিবর্তন এল মণিকুন্তলা সেনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে। অবশ্য মণিকুন্তলাকে বিমলার খোঁজ দিয়েছিলেন সরোজ রায়। সেই সময়ে বিমলা বাপের বাড়িতে আড়ালেই থাকতেন। সরোজ রায়ের যাতায়াত ছিল বিমলার বাপের বাড়িতে। দাদা বঙ্কিমের সঙ্গে বামপন্থী নেতাদের যোগাযোগ গড়ে উঠতে থাকে। সেটা ১৯৪৩ সাল। তাঁর পরামর্শে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির মণিকুন্তলা সেন, কমলা মুখোপাধ্যায় এবং নারী সেবা সঙ্ঘের ফুলরেণু গুহ, রেণু চক্রবর্তীরা বিমলার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু দাদা চাইতেন না বোন কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিক। তাঁর ভয় ছিল, সমাজের। তবে শেষপর্যন্ত মণিকুন্তলার সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি পান। মণিকুন্তলা সেন প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজে এসেছিলেন মেদিনীপুরে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ কেন্দ্র খোলার জন্য মহিলা সমিতি গঠন করেন। তিনি ঘুরতেন বিভিন্ন জায়গায়। মণিকুন্তলা পাঁশকুড়া থানার পূর্ব চিল্কায় বিমলাকে নিয়ে গিয়ে কাপড় ও কম্বল বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করেন।

মণিকুন্তলা বুঝতেন, বিমলার নতুন জীবন দরকার। ধীরে ধীরে সেই পরিবর্তন এনেছিলেন বিমলার জীবনে। গ্রামের রাস্তায় মণিকুন্তলার সঙ্গে হাঁটতেন সাদা থান পরা বিমলা। কিন্তু পাকা রাস্তার কাছে এসে তিনি বিমলাকে রঙিন শাড়ি পরতে দিতেন। প্রথমদিকে বিমলার অস্বস্তি হত। তমলুকে বিমলা উঠতেন সান্ত্বনাময়ী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুচরিতা দাশগুপ্তের হস্টেলে। সুচরিতা ছিলেন মণিকুন্তলার সহপাঠী। তাঁর আরও একটি পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের দিদি। মণিকুন্তলার অনুরোধেই বিমলাকে লেখাপড়া শেখান সুচরিতা। ত্রাণ কেন্দ্রের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন বিমলা। পূর্বচিল্কা ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ ও দুধ বিতরণ কেন্দ্র খুলেছিলেন বিমলা। মণিকুন্তলা পথ প্রদর্শকের কাজ করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়েই অনন্ত মাজীর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রপাত। পরে সেই সম্পর্ক বিয়েতে পরিণতি পায়। যদিও আগে বিয়ে হওয়া মেয়েকে বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি ছিল তাঁর শাশুড়ি ও ননদের।

ত্রাণ কাজে যোগ দেওয়ার পরে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয় বিমলার। দুর্ভিক্ষ ও মহামারির খবর সংগ্রহে মেদিনীপুরে আসেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অনন্ত মাজী তাঁকে পূর্বচিল্কা, তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা ও নন্দীগ্রাম ঘুরিয়ে দেখান। পূর্বচিল্কায় কবির সঙ্গে পরিচয় হয় বিমলার। তিনি কবিকে ছোট্ট ডিঙি করে খাল, ধান জমির ভিতর দিয়ে গ্রাম দেখাতে নিয়ে যেতেন। বিমলা ত্রাণ কাজের সঙ্গেই মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজ করতেন। ১৯৪৬ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে মেয়েদের স্বনির্ভর করে তুলতে নানা উদ্যোগ করেন বিমলারা। চালু হয় মাদুর ও বেতের জিনিস বোনার ব্যবস্থা। সরকার মাদুর ও বেতের জিনিস কিনে নিত। মেয়েরা মজুরি পেতেন আধ সের চাল আর চার আনা পয়সা। মাদুরকাঠি কেনা হত সবং থেকে। বিমলারা ঢেঁকিশ্রমিক প্রথা চালু করেছিলেন। মেয়েরা অবস্থাপন্নদের বাড়ি থেকে ধান সংগ্রহ করতেন। সেই ধান চাল করে মালিককে দেওয়া হত। মেয়েদের কাজ পাওয়ার গারেন্টার থাকত মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি।

মেয়েরা স্বনির্ভরতার স্বাদ ও গুরুত্ব বুঝতে পারছিলেন। কাজের জন্য হেঁটেই সারা জেলা ঘুরতেন বিমলারা। সেই বিমলাই জাহাজে চেপে বরিশালে সারা ভারত মহিলা সম্মেলনে যোগ দিলেন। যাতায়াতের ৩০০ টাকা জোগাড় করেন চাঁদা তুলে, আত্মীয়স্বজনদের থেকে নিয়ে আর সোনার হার বিক্রি করে। নিজে সুচরিতা দাশগুপ্তের কাছে লেখাপড়া শেখেন। তা কাজে আসে। ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার সম্পাদক সোমনাথ লাহিড়ীর নির্দেশে বিমলাও লিখে পাঠাতেন। আত্মরক্ষা সমিতি বিভিন্ন জায়গায় বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র খোলে। মেয়েরা বর্ণপরিচয় শিখতেন। স্লেট, বই বিমলারা দিতেন। বিমলা একসময়ে হয়ে ওঠেন তেভাগা আন্দোলনে অবিভক্ত মেদিনীপুরের মুখ।

২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন বিমলা মাজী।

ঋণ স্বীকার: ‘তেভাগা-র অগ্নিকন্যা বিমলা মাজী- সম্পাদনা বিপ্লব মাজী ও মুক্তি মুখোপাধ্যায়

অন্য বিষয়গুলি:

Tebhaga Movement Midnapore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy