সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘লিঙ্গহিংসার স্তরভেদ’ (১৮-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের আলোচনা শ্রেণি এবং জাতির প্রশ্নগুলোকে যথোচিত গুরুত্ব দেয় না। হাথরসের ধর্ষিত এবং নিহত মেয়েটি দলিত শ্রেণির, তা প্রকাশ্যে এলেও ধর্ষক হত্যাকারীরা যে উচ্চবর্ণের, তা অন্তরালেই থেকে যেতে চায়। অনেকের মনোভাব যেন এই রকম যে, দলিত মেয়ের ধর্ষণ হয়ে থাকতেই পারে, তবে ধর্ষক যখন উচ্চবর্ণের তখন ব্যাপারটা নিয়ে আর অত টানাহ্যাঁচড়া করে কী হবে। এই মানসিকতার পিছনে কাজ করছে সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব। খাজনা দিতে গিয়ে, এবং ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অতি দ্রুত চাষির জমি নিলাম হয়ে যেত, দলিল ঢুকত জমিদারের আলমারিতে। এই ভাবে যে বিশাল ভূমিহীন খেতমজুর শ্রেণির জন্ম হয়েছিল, তা-ই বংশ পরম্পরায় আজকের দরিদ্র ভারতবাসী।
তার উপর ছিল বর্ণপ্রথার অভিশাপ। মনুসংহিতার ছত্রে ছত্রে শূদ্রের অবনমনের কথা পাওয়া যায়। তাঁর সম্পদ আহরণ, বিদ্যা শিক্ষা, অস্ত্র ধারণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাঁরাই বংশপরম্পরায় আজকের তফসিলি জাতি, জনজাতি, দলিত। দীর্ঘ কাল এঁরা প্রথাগত শিক্ষার কাছাকাছি আসতে পারেননি। তাই আইনসভা, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগে কোথাও তাঁদের কোনও প্রতিনিধি প্রায় নেই বললেই চলে। জমি, সম্পত্তি কিংবা দেহ, কোনও কিছুতেই এঁদের স্বত্বাধিকার স্বীকার করতে, সম্মান করতে অভ্যস্ত নয় উচ্চবর্ণ হিন্দুরা। তাই দলিত মেয়েরা ধর্ষিত হয়েও প্রতিবাদ করবে না, এটাই তারা মনে করে স্বাভাবিক, বিচার পাওয়াই ব্যতিক্রম।
তৈয়েব মণ্ডল, হরিপাল, হুগলি
শাস্তি জরুরি
সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়ের সময়োচিত প্রবন্ধ সম্পর্কে কিছু কথা। প্রবন্ধকার তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, ভারতে নিচু, দলিত সম্প্রদায়ের মেয়েরা বার বার ধর্ষণের শিকার হয়েও কোনও বিচার পান না। উল্টে তাঁরাই হেনস্থার শিকার হন। প্রথমত পুলিশ এ ব্যাপারে অভিযোগকারিণীর কাছ থেকে কোনও ডায়েরি নিতে অস্বীকার করে, যদি ধর্ষণে অভিযুক্ত উঁচু সম্প্রদায়ের বা কোনও প্রভাবশালী অথবা জনপ্রতিনিধি হয়ে থাকেন। যাঁদের সমাজে নারীদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা, তাঁদেরই যদি ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়— তা হলে নারীর নিরাপত্তা দেবে কে? তা ছাড়া দলিত নির্যাতিতার পক্ষে বিচার চেয়ে সর্বস্তরের মানুষকে আন্দোলন করতেও তেমন দেখা যায় না। দলিত বা প্রান্তিক মেয়ে ধর্ষিতা হলে রাজপথে মৌন মোমবাতি মিছিল দেখা যায় না। লিঙ্গহিংসার ক্ষেত্রে এই স্তর বিভাজন দুঃখজনক এবং মানবতার পরিপন্থী।
মনে রাখা দরকার, ধর্ষণ ধর্ষণই। সমাজে একটা জঘন্য অপরাধ। আইন সবার জন্য সমান— সংবিধানে এ কথা লেখা থাকলেও তা কার্যকর হয় না। তাই নির্যাতিতা যে সম্প্রদায়ের হোক না কেন, যে আর্থিক অবস্থার হোক না কেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থার আইন চালু করা উচিত সরকারের। যে থানার পুলিশ আধিকারিক ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির অভিযোগ নিতে অস্বীকার করবেন, তাঁদের বরখাস্ত করার বিধান রাখা হোক আইনে। নয়তো এই জঘন্য অপরাধ রোধ করা সম্ভব হবে না।
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি
তাঁদের কথা
‘লিঙ্গহিংসার স্তরভেদ’ শীর্ষক প্রবন্ধে সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায় আমাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তুলে ধরেছেন সারা দেশে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান, ২০২২ সালে দেশে ৩১০০০ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে (ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে ২৪৮টি)— প্রতি দিন গড়ে ৮৫টি, প্রতি ঘণ্টায় ৪টি এবং প্রতি পনেরো মিনিটে একটি ধর্ষণ। মহিলারা এ দেশে কতটা অসুরক্ষিত, তা সহজেই অনুমেয়। সমাজ নারীকে সর্বদাই দুর্বল হিসাবে বিবেচনা করে। ভাবা হয় তাদের প্রতি নিপীড়ন ও বৈষম্য করা যেতে পারে। ভারতে নারীদের ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির মতো ভয়ঙ্কর প্রবণতা চিরকাল বর্তমান। ভারতের শোষণ কাঠামোয় লিঙ্গ পরিচিতি একটি অন্যতম দিক। প্রথমেই বলি সাম্প্রতিক ভারতে নৃশংস কয়েকটি ধর্ষণের কথা। ২০০৬ সালের খৈরলাঞ্জি হত্যাকাণ্ড। যেখানে দলিত মহিলা ও তাঁর মেয়েকে নগ্ন করে হাঁটিয়ে বার বার ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে উন্নাওয়ের কুখ্যাত ধর্ষণের ঘটনাতে নিগৃহীতা ছিল দলিত নাবালিকা। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ভারতের উত্তরপ্রদেশের হাথরস জেলায় চার জন পুরুষ ১৯ বছর বয়সি এক দলিত মেয়েকে গণধর্ষণ করে। পরে দিল্লির একটি হাসপাতালে মেয়েটি মারা যায়। ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর জেলার ১৩ বছরের এক দলিত কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়।
উপরের চারটি ঘটনাতেই ধর্ষকরা ছিলেন উচ্চবর্ণের পুরুষ। অঙ্কের হিসাবে দেশে প্রতি দিন গড়ে দশ জন দলিত মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যা উদ্বেগজনক। আজও নিচু জাতের মেয়েরা বর্ণপ্রথার নিষ্ঠুর নিষ্পেষণের শিকার। তার একমাত্র কারণ লিঙ্গবৈষম্য, জাতপাতের বেড়া আর অর্থনৈতিক বঞ্চনা। ভারতীয় সংবিধান মহিলাদের সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। তবুও দলিতরা প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হন। আইনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি সুবিচার করে না। কারণ— আইনি সাহায্য নেওয়ার জন্য অভিযোগ দায়ের করা থেকে শুরু করে বিচার পাওয়া অবধি পুরো যাত্রাটি একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। অনেকেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। অর্থনৈতিক ভাবে তাঁরা অত্যন্ত দুর্বল। এ ছাড়া থাকে পুলিশ এবং আইনি ব্যবস্থার উপর উচ্চবর্ণের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলদারি।
আর জি কর কাণ্ড সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের প্রেরণা জুগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থানের জন্য যে দলিত মহিলারা ইটভাটায় কাজ করেন, তাঁদের অনেকেই ধর্ষিত হন, এ কথা অনেকের জানা। নিরাপত্তাহীন এই মহিলাদের কথা কে বলবে? প্রশ্ন রইল দেশ তথা রাজ্যের প্রতিবাদী রাজনৈতিক দল ও শাসকের কাছে।
বিপদতারণ ধীবর, বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া
চেতনার বিকাশ
ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধ “প্রতিবাদের ‘আমরা-ওরা’”-র পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ঢেউ যেমন সব জায়গায় সমান ভাবে আঘাত করে না, তেমনই পুরুষশাসিত রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় শিক্ষার আলো কিছুটা উত্তরণের পথ দেখালেও, তা সব জায়গায় সমান কিরণ ছড়াতে পারে না। এ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অসাম্য, যাকে পুষে রাখতে চায় সব রাজনৈতিক দলই। ফলে সামাজিক সাম্য মুখে বলা যত সহজ, বাস্তবে তা হয় না। প্রতিবাদেরও নানা ধরন আছে। প্রবন্ধকার দলিত মেয়েদের ধর্ষণের কথা বলেছেন, কর্মক্ষেত্রে ধর্ষণের কথা বলেছেন, বলেছেন গৃহপরিচারিকার কথাও। আবার গৃহপরিচারিকা অনেক ক্ষেত্রে নাবালিকা মেয়েকে নিয়েই কাজে যান, কারণ বস্তির বাড়িওয়ালা মেয়েটির সঙ্গে কুকাজ করেছেন। এ সব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ যে ভাবে হওয়া উচিত, তা হয় না। এখানেই বলতে হয় যে, সব ধর্ষণ বা খুনের প্রেক্ষিত এক নয়। আর জি করের ডাক্তার পড়ুয়ার ঘটনা একটি পরিকল্পিত ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বৈরশাসনতান্ত্রিক সংঘটিত অপরাধ। যে অত্যাচার সম্পর্কে প্রত্যেকটি মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারা কম-বেশি অবহিত ও ভুক্তভোগী। তারা যে ভাবে আর জি কর কাণ্ডের বিচার চেয়ে তাদের আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী অরাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করতে পেরেছে, একটি সাধারণ মেয়ের ক্ষেত্রে এ প্রতিবাদ হওয়া দরকার হলেও বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তা অসম্ভব। এর জন্য চাই উন্নততর মানসিক চেতনার বিকাশ।
টুলু সেন, হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy