‘সিবিআই তদন্তের দাবি, বিধায়কের নামে নালিশ বিশ্বভারতীর’ (১৯-৮) প্রসঙ্গে বলি, এই দাবি খুবই সঙ্গত। শাসক দলের এক জন বিধায়কের নেতৃত্বে হাজারখানেক বহিরাগত যে ভাবে বিশ্বভারতীতে আড়াই ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালাল, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এই কাজ রবীন্দ্রনাথের ওপর আঘাত। যাঁরা বলেন, মেলার মাঠ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া রবীন্দ্রভাবনা-বিরোধী, তাঁদের প্রতি প্রশ্ন, পে-লোডার দিয়ে এক জন জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গণে তাণ্ডব চালানো সমাজবিরোধী কাজ নয়? বিশ্বভারতী যদি প্রাচীর তুলে কোনও অন্যায় কাজ করে, তা হলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। বহিরাগতেরা কী করে বিশ্বভারতীতে প্রবেশ করে ভাঙচুর করার সাহস পায়?
বিধায়ক সাফাই গাইছেন, তিনি বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী হিসেবে গিয়েছিলেন নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া কারও পক্ষে হাজারখানেক লোক জড়ো করা সম্ভব নয়। আবার, অশান্তির আশঙ্কায় আগে থেকেই প্রশাসনকে সতর্ক করে রেখেছিলেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। কর্ণপাত করেনি প্রশাসন। ভাঙচুর চলাকালীনও তাদের সাহায্য চেয়ে পাওয়া যায়নি। বোঝাই যাচ্ছে, প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদত ছাড়া এটা সম্ভব নয়। বিশ্বভারতীতে অশান্তি ও রবীন্দ্র-ভাবধারায় কালিমা লেপনের দায় প্রশাসন এড়াতে পারে না। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি
কলের জিনিস
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘প্রাক্তনী’ প্রবন্ধে ৫ সংখ্যক রচনায় (৮ পৌষ ১৩২৫) বলছেন “প্রাচীরের পর প্রাচীর তুলে বাইরের জগৎকে দূর করে রাখলে কিছুদিন হয়তো বেড়ে ওঠা যায়, কিন্তু তার পরে প্রাণের প্রবাহ রুদ্ধ হয়ে শরীর মন বুদ্ধি ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।” একই প্রবন্ধের আর একটি রচনায় (পৌষ উৎসব, ১৩৪১) কবি বলছেন, “আমার অবর্তমানে এ যদি একটা কল মাত্র হয়, তবে কেন এত করেছি?” বিশ্বভারতী গ্রন্থের ১৬ সংখ্যক রচনায় (৮ পৌষ ১৩৪১) দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ উদ্বিগ্ন চিত্তে বলছেন, “অন্য সব বিদ্যালয়ের মতো এ আশ্রম যেন কলের জিনিস না হয়। যন্ত্রের অংশ এসে পড়েছে, কিন্তু সবার উপরে প্রাণ যেন সত্য হয়।”
শৈবাল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-২৬
এই কি ভাষা?
আমার যত বিশ্ববিদ্যালয় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তাদের বেশির ভাগেরই ক্যাম্পাস আলাদা করে সুনির্দিষ্ট। বহিরাগতের অবাধ বিচরণ সম্ভব নয়। বিশ্বভারতীর ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন। ভুবনডাঙা থেকে শুরু করে শান্তিনিকেতন বিনয় ভবন, শ্রীনিকেতন হয়ে চীপকুঠি পর্যন্ত যে বিস্তার, তার মধ্যে একেবারে জন্মলগ্ন থেকে রয়েছে কিছু আদিবাসী গ্রাম, ব্যক্তিগত জমি বা বাসস্থান, আর বিভিন্ন গ্রামে যাওয়ার সংযোগকারী রাস্তা। তাই প্রাচীরের মাধ্যমে বহিরাগতের প্রবেশাধিকার বন্ধ করা যাবে না। বিশেষত, রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে মুক্তাঙ্গন শিক্ষার বিকাশ চেয়েছিলেন, আজকের দিনে প্রাচীর তুলে স্থানীয় মানুষের সমস্যা সৃষ্টি করে সেই শিক্ষাকেই যেন হেয় করার প্রয়াস বলে মনে হল। বসন্ত উৎসব বা পৌষমেলা স্থানীয় মানুষ, আশ্রমিক ও জন প্রতিনিধিদের আন্তরিক যোগদানের মাধ্যমে পালন করা যায় (করোনা পরিস্থিতি ব্যতিরেকে)। হয়তো কর্তৃপক্ষই খোলস থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের হাত ধরতে পারেননি।
তাঁরাই বোধ হয় আঘাত হেনেছে আজ। “মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে’’— এ সেই ক্ষোভ। তা না হলে শিক্ষাপ্রাঙ্গণে পে-লোডার এনে এত সংগঠিত জনরোষ খুব কম দেখা গিয়েছে। যখন আক্রমণ নেমে এল, তখন অধ্যাপকসভা, কর্মিসভা বা ছাত্র সংগঠন কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলল না, কোনও প্রতিবাদ (অন্তত টিভির পর্দায়) করল না কেন? এমনই কি স্বার্থান্বেষী, আত্মকেন্দ্রিক, বিচ্ছিন্ন বর্তমানের শান্তিনিকেতন? আন্দোলনকারীদেরও কি আর কোনও ভাষা ছিল না প্রতিবাদের, ব্যাপক ভাঙচুর ছাড়া? এই আঘাত বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার মতো কালিমালিপ্ত। বিশ্বের দরবারেও আজ সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
উপাচার্যকে অনুরোধ, বিশ্বভারতী বন্ধ করে কোনও সমাধান অতীতেও হয়নি, এখনও হবে না। আশা করি, যুযুধান দু’পক্ষ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে কমিটি গঠন করে অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠবে।
সৌমিত্র সেন, কলকাতা-৮৪
অবনমন
রবীন্দ্র-ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে গুন্ডামির আশ্রয় নিতে হবে, ভাবতে মাথা ঝিমঝিম করছে। বিশ্বভারতীর ঢিলছোড়া দূরত্বে রাজ্য সরকারের বিশ্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ চলছে। ওখানে তো প্রাচীর দেওয়া আছে। পৌষমেলার মাঠটিতে প্রাচীর দেওয়ার কাজ জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায় অনুযায়ী হচ্ছে। বিরোধী বক্তব্য থাকতেই পারে। সে ক্ষেত্রে আদালতে যাওয়াটাই বিধিসম্মত। পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে নির্মাণ ভেঙে দেওয়া আজীবন শান্তির পূজারি রবীন্দ্রনাথের ভাবধারাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নামান্তর। এ কোন হিংস্র সমাজের সাক্ষী আমরা?
রবীন্দ্রনাথ যে উদ্দেশ্যে পৌষমেলা করেছিলেন, সেটা আর অবশিষ্ট আছে কি? এখন পৌষমেলা মানে পুরোটাই বাণিজ্য, বিনোদন, হইহুল্লোড়। রবীন্দ্রনাথের পৌষমেলা হত মাত্র তিন দিনের জন্য। গত বছর পৌষমেলা হয়েছিল ১৫ দিন ধরে। ব্যবসায়ীরা পৌষমেলাকে হাইজ্যাক করে নিয়েছেন তাঁদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। এটা হল একটা দিক।
উল্টো দিকে, এটাও ঠিক যে বিশ্বভারতীর মাননীয় উপাচার্য মহাশয় একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়ে অতীতে কথাবার্তা বলেছেন। তাঁর উদ্যোগে সিএএ-র সমর্থনে একটি সেমিনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাঘরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সিএএ-র যাঁরা বিরোধী ছিলেন, তাঁদের প্রতি উনি কঠোরতা প্রদর্শন করেছিলেন।
আমরা দেখেছি, জেএনইউ-এ উপাচার্যের মদতে এবিভিপি-র গুন্ডামি। বর্তমানের বিজেপি সরকার সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের রাজনৈতিক ভাবনায় বিশ্বাসী অনেক কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শীর্ষস্থানে নিয়োগ করছে, এবং এই মানুষেরা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে চলেছেন। আবার, এ রাজ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্মানসূচক ডি লিট দেওয়া হল অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ভাবে। এই সবের নিট ফল শিক্ষার চূড়ান্ত অবনমন, কেন্দ্রীয় স্তরে এবং রাজ্য স্তরে।
সুদীপ সরকার, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
হঠকারিতা
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে তাঁর দল সরবে না। এমনকি এ জন্য তিনি ‘গুন্ডা’ অপবাদ সইতেও রাজি।
আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। উঠেছে গুন্ডামি নিয়ে, ধ্বংস ও হঠকারিতা নিয়ে। নিজেদের মত ও পথের সমর্থনে আন্দোলন করার অধিকার সকলের আছে। তাতেও কাজ না হলে ধর্না, বিক্ষোভ এবং শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হতেও বাধা নেই। কিন্তু প্রতিবাদ-আন্দোলনের নামে যা হয়েছে, তা নিন্দনীয়। বিশ্বভারতীর মেলাপ্রাঙ্গণ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা যেমন ঐতিহ্য বিরোধী, তেমনই রাজ্যের শাসক দলের বিধায়ক এবং অন্য নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে ভাঙচুর চালানোও অন্যায়। পুলিশের নাকের ডগায় এ ভাবে ভাঙচুর সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়।
নাগরিকমাত্রেই বুঝতে পারছেন, বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য রক্ষার পথে কোনও পক্ষই হাঁটেননি। সকলেই নিজের ক্ষমতা জাহিরের ব্যবস্থা করেছিলেন। উভয় পক্ষই নিজেদের প্রশ্ন করুন, রবীন্দ্রনাথ কি তাঁদের এই হঠকারিতাকে সমর্থন করতেন?
পলাশ পাল, কাঠজুড়িডাঙা, বাঁকুড়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy