মোহিত রায়ের ‘সংবিধান কেন পবিত্র গ্রন্থ’ (১৪-৬) প্রবন্ধটির বিষয় সংবিধানের ‘দেবত্বপ্রাপ্তি’। সঙ্গে প্রকাশিত চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রবর রাষ্ট্রনেতা ভারতীয় সংবিধান গ্রন্থটিকে সযত্নে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করছেন। দৃশ্যটি দৃষ্টিনন্দন। তবে দৃশ্যমাহাত্ম্য পার হয়ে বিষয়টির সার্বিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা ভেসে ওঠে। প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে কিছু প্রতীকী আচরণের দস্তুর সব দেশেই আছে। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে পোশাকি অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকাকে প্রথাগত পদ্ধতিতে অভিবাদন জানানো হয়ে থাকে সব দেশেই। কোনও দেশে সংবিধান গ্রন্থকে আনুষ্ঠানিক সমাবেশে প্রণাম জানানোর রীতি অতীতে চোখে পড়েছে বলে তো মনে পড়ছে না। এটা ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। কিন্তু যখন দেশের কোনও শীর্ষ নেতা রাষ্ট্রীয় পরিসরে আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের অঙ্গ হিসেবে সংবিধানকে প্রণাম করেন, ও সেই ঘটনার দেশব্যাপী প্রচার হয়, তখন জনমানসে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, তবে কি এক নতুন আচার প্রবর্তিত হতে চলল? ধর্মীয় আরাধনার এক ভাব ধীর পদসঞ্চারে একটি ধর্মসংস্রবহীন বিষয়কে আবিষ্ট করার উপক্রম কি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না?
সংবিধান রাষ্ট্রের দর্শন। সংবিধানে সঙ্কলিত নীতিসূত্রগুলি পালনের মাধ্যমেই সংবিধানের প্রকৃত সম্মাননা সম্ভব। আমি সংবিধান পুস্তকের একটি কপিকে মাথায় নিয়ে যত বার খুশি প্রণাম করতে পারি, কিন্তু যত ক্ষণ না আমি নিজের মনকে সাংবিধানিক আদর্শ ও মূল্যবোধের সঙ্গে বাস্তবিক যুক্ত করতে পারছি, ও সেই আদর্শ অনুসারে প্রতিটি কর্তব্য নির্বাহ করছি, তত ক্ষণ আমার সেই প্রণাম এক ব্যর্থ আচার হয়েই থেকে যাবে। আমাদের কবি এক গভীর আত্মসমীক্ষার বোধ আমাদের মনে সঞ্চার করেছিলেন, যখন তিনি গেয়েছিলেন— “তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।” সংবিধান-প্রণামের ক্ষেত্রেও তেমনই হবে না তো? আচারসর্বস্বতা জনজীবনে আধিপত্য বিস্তার করে, কারণ সেটা অপেক্ষাকৃত সহজ; আদর্শের অনুবর্তী হয়ে বাস্তবে পথ চলা কঠিন।
শতদল ভট্টাচার্য, কলকাতা-১৬৩
আবহমান
মোহিত রায় লিখেছেন, সংবিধানের ভাগ্য এ রকম কয়েক জন অনির্বাচিত, দেশের নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধতাহীন ব্যক্তির উপরে ছেড়ে রাখা কি ঠিক? গণতন্ত্রে দেশের সমাজের ভবিষ্যৎ কয়েক জন পেশাজীবী ঠিক করতে পারেন না। এখানে প্রবন্ধকার কি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ‘দায়বদ্ধতাহীন’ বলতে চেয়েছেন? সুপ্রিম কোর্ট নামক প্রতিষ্ঠানটির কি কোনও সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই?
সংবিধান বিষয়ে ‘অনির্বাচিত’ ব্যক্তিদের ভূমিকা এবং নির্বাচিতদের ভূমিকা সংবিধানই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আইন প্রণয়ন করা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব। সংবিধানের ১৩১(ক) ধারা বলেছে, আইনটির সাংবিধানিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের। কেন্দ্রীয় আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিচারের নিরঙ্কুশ অধিকার দেওয়া হয়েছে ‘অনির্বাচিত’ সুপ্রিম কোর্টকে।
প্রবন্ধকার আরও বলেছেন, আদালতের অধিকার নেই সংবিধানের মূল কাঠামো ব্যাখ্যা করার। তিনি বিস্মৃত হয়েছেন, ভারতের সংবিধানের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২২ জানুয়ারির কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে ‘অবজেক্টিভ রেজ়লিউশন’ গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে। সংবিধানের ১৩, ৩২, ১৩১-১৩৬, ১৪৩, ২২৬ এবং ২৪৬ ধারাগুলি সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের মূল কাঠামো ব্যাখ্যা করার অধিকার প্রদান করেছে। সংবিধানের এই ধারাগুলি অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট যে কোনও আইন পর্যালোচনা করে দেখতে পারে যে, সেগুলি সংবিধান-প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না। ৩২ নম্বর ধারায় সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে অর্পিত অধিকারসমূহ বলবৎকরণের জন্য প্রতিকার করার দায়িত্ব প্রদান করেছে। ৩২(২) ধারায় সুপ্রিম কোর্টকে রিটসমূহ জারির আদেশ-নির্দেশ, হেবিয়াস কর্পাস, ম্যান্ডামাস, প্রহিবিশন কো ওয়ারেন্টো, সার্টিওরারি ইত্যাদি রিট জারি করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই ৩২ ধারাটিকে বাবাসাহেব আম্বেডকর স্বয়ং সংবিধানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারা বলে অভিহিত করেছিলেন।
একটি দেশের সংবিধান রচিত হয় দর্শন ও ইতিহাসের ভিত্তিতে। স্বভাবতই, সে সব বুঝে সংবিধান বিষয়ে মতামত দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে বিশেষজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে যে সব মামলা হয়, সেখানে অতীতে সওয়াল করেছেন ফলি নরিম্যান, সোলি সোরাবজি, ননী পাল্কিওয়ালা, রাম জেঠমলানি, বেনুগোপালের মতো সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে সওয়াল করেন হরিশ সালভে, কেশব পরাশরন, মুকুল রোহতগি প্রমুখ। এঁদের এক-একটি সওয়াল সংবিধানের কোনায় কোনায় আলোকপাত করে আইনের এবং সংবিধান সংশোধনের ‘সাংবিধানিকতা’ ব্যাখ্যা করে। সুপ্রিম কোর্ট শুধুমাত্র আইনের নয়, সংবিধান সংশোধনেরও ‘সাংবিধানিকতা’ দেখে।
প্রবন্ধকার বলেছেন, সংবিধানের মূল কাঠামো নিয়ে সংবিধান প্রণেতারা কিছু বলেননি। আদৌ সে রকম কিছু আছে কি না বা থাকলে সেটা কী, তা ঠিক করে ফেললেন কয়েক জন বিচারক। প্রবন্ধকারের কি জানা নেই যে, একটি সংবিধানের একটি দর্শন থাকে? সেই দর্শনটিই সংবিধানের প্রাণকেন্দ্র। সেই দর্শন গড়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক দর্শনের উপরে ভিত্তি করে এবং সেটিই গড়ে দেয় সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’। পড়ে বোঝার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে দুর্গাদাস বসুর ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া (২০তম সংস্করণ, ২০১১, পৃ ২০-৩১)।
ভারতের রাজনৈতিক দর্শন ভাবনার শুরু লৌহযুগ (আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে। ইতিহাসবিদদের মতে সমাধিস্থ প্রত্নবস্তুর অতিসমৃদ্ধ বৈচিত্র এবং সমাধি সামগ্রীর বৈচিত্র থেকে বোঝা যায় যে সেই যুগেই ভারতে একটি বিধিবদ্ধ সমাজের সূত্রপাত হয়েছিল, যা অবশ্যই তৎকালীন রাজনৈতিক দর্শনসঞ্জাত। স্বভাবতই, ভারতের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল তার নিজস্ব দর্শনের ভিত্তিতে। সেই ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল ২২ জানুয়ারি ১৯৪৭-এ। কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি-তে গৃহীত আটটি প্রস্তাবের পঞ্চমটিতে ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় এবং আইনের চোখে সমানাধিকারের কথা। সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসুর মতে, এই রেজ়লিউশনটিই ভারতের সংবিধানের ভিত্তি। এটি পাঠ করলে বোঝা যাবে বিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস ও উপাসনার স্বাধীনতার কথা শুরু থেকেই ছিল। সুতরাং ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে ‘সেকুলার’ শব্দটি সংবিধানের প্রস্তাবনায় সংযোজিত হওয়া নিয়ে প্রবন্ধকার যতই তির্যক শ্লেষে বলুন, সংবিধান প্রণেতারা ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা উল্লেখ করেননি, অথচ সেই ধর্মনিরপেক্ষতা এখন হয়ে গেল সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ! ধর্মনিরপেক্ষতা আদতে ভারতের সংবিধানের নিজস্ব দর্শনেই ছিল। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে সক্রেটিসের বয়ানে, প্লেটোর ‘প্রোটাগোরাস’ ডায়ালগের এই অংশ, “মাংস ও পানীয় কেনার থেকে জ্ঞান কিনতে যাওয়া ঢের বেশি বিপজ্জনক!”
তবে প্রবন্ধকারের একটি প্রশ্ন যথার্থ— “একটা সময়ের প্রেক্ষিতে রচিত গ্রন্থ কি সর্বকালে প্রযোজ্য হতে পারে?” সেই জন্যেই তো সংবিধানের অভ্যন্তরে সংবিধান সংশোধন করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কোনও সংশোধন; রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়ের পরিপন্থী হতে পারবে না। সমানাধিকার এবং চিন্তা-বিশ্বাস-মত প্রকাশ-উপাসনার স্বাধীনতার বিরুদ্ধতা করতে হবে না। ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতার অধিকার সংরক্ষণ আমাদের সংবিধানের মূল দর্শন। এই দর্শন কি সময়ের প্রেক্ষিতে রচিত, না কি এ-দর্শনই আবহমান ভারতকথা?
অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা-১০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy