শুভময় মৈত্র-র ‘গর্ব এবং সুবিধাবাদ’ (১১-২) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। এ কথা ঠিক যে, জুনিয়র ডাক্তারদের এমন অভূতপূর্ব আন্দোলনের পরেও রাজ্যে পালাবদলের দাবি তোলা যাচ্ছে না। সত্যিই কি দাবি তোলার মতো রসদ নেই, না কি আজকের সময় ও সমাজ বুঝে আন্দোলন-সচেতন নেতানেত্রীরা প্রতিরোধমূলক রাজনীতি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন? আর জি কর কাণ্ড থেকে উদ্ভূত নাগরিক আন্দোলন সচ্ছল মধ্যবিত্তদের মধ্যে তুমুল প্রভাব বিস্তার করলেও, গরিব মধ্যবিত্তদের সে ভাবে শামিল করতে পারেনি। সমাজের সর্ব স্তরে সাড়া জাগাতে পারেনি বলেই এ আন্দোলন আর জি কর-কেন্দ্রিক হয়েই আছে। সীমাবদ্ধতার অন্য কারণও আছে। নাগরিক আন্দোলনের উর্বর জমিতে রাজনীতির ফসল ফলাতে পারেন এমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতাই বা কোথায়? বুদ্ধিজীবীদের উপর এমনিতেই মানুষের আস্থা নেই। তা ছাড়া ডিজিটাল দুনিয়ার প্রভাবে সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে যে বদল এসেছে, তার ধাক্কায় প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী রাজনীতির রসায়নও বদলে যাচ্ছে। ভোক্তা তথা ভোটার-মানসিকতায় অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। খামখেয়ালি ভোক্তার মনবদলের চরিত্র বুঝতে না পারলে ভোটারদের মন জয় করা যাবে না।
শাসক দলের প্রসঙ্গে আসা যাক। তৃণমূল একটি নেত্রীকেন্দ্রিক দল। এ দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বময় কর্তৃত্ব অটুট বলা যায়। মুখ্যমন্ত্রী পার্টিযন্ত্রের মাধ্যমে আজও দল এবং সরকারের রাশ নিজের হাতে ধরে রাখতে সক্ষম। আর যে-হেতু পৃষ্ঠপোষক-অনুগামী সম্পর্কের ভিত্তিতে শাসক দলটি পরিচালিত হয়, এই যুক্তিতে এ দলের সংগঠনকে মজবুত বলাই যায়। সংগঠনের কার্যপ্রণালীতে তেমন কোনও জটিলতা নেই— পৃষ্ঠপোষক অনুগামীদের কাছে সুবিধা পৌঁছে দেন, বিনিময়ে অনুগামীরা পৃষ্ঠপোষকের প্রতি অনুগত থেকে ভোটব্যাঙ্ক রক্ষার কাজ সুনিশ্চিত করেন। সম্পর্কের এই ভিত সহজে টলে যায় না, দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা সরকারি স্তরের ভয়াবহ দুর্নীতি সত্ত্বেও অটুট থাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সংগঠন-মেশিনারির শক্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে বিরোধীদের, নয়তো লড়াই শেষে তাঁদের বার বার বিফল মনোরথ হয়েই ফিরতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী ভোট-রাজনীতির ময়দানে বিরোধীদের চেয়ে কেন এগিয়ে? প্রশাসন হাতে থাকার বিষয়টি মেনে নিয়েও বলতে হয়, রাজনীতির গতিপ্রকৃতি আগাম বুঝে চটজলদি ব্যবস্থা গ্রহণের মতো সহজাত বুদ্ধি আছে বলেই তিনি টালমাটাল পরিস্থিতিকে সামলে দিতে পারেন। তা ছাড়া, অনুদান-নির্ভর রাজনীতির সাফল্য ছাড়াও মুখ্যমন্ত্রীর জনসংযোগ-ক্ষমতাকে ঈর্ষণীয় বলেই মানতে হবে। এমন দুঁদে রাজনীতিককে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পালাবদলের রাজনীতির হাওয়া বইয়ে দেওয়া সহজ নয়।
শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪
ভাসমান হয়েও
শুভময় মৈত্রের প্রতিবেদনটি বর্তমান এ রাজ্যের মধ্যবিত্ত সমাজের রাজনৈতিক জীবনের এক প্রতিচ্ছবি। রাজনীতি ও সমাজনীতির আঙ্গিকে দেখা যায় এ রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণটি মধ্যবিত্ত সমাজের এক শ্রেণির মানুষের দ্বারা সম্পাদিত হয়। এঁরা পার্টির কট্টর সমর্থক বা ক্যাডার নন। এঁদের আমরা ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসাবে অভিহিত করলেও, নির্বাচনের ক্ষেত্রে এঁরাই হলেন নির্বাচনে জয় বা পরাজয়ের নির্ণায়ক। অর্থাৎ, ‘ফ্লোটিং ভোটার’। এঁরা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর রাজ্যের শাসক সরকারের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি প্রভৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধ্বজা ধরে রাজপথে আন্দোলন করে গলা ফাটান কিংবা তিলোত্তমার মতো পড়ুয়া-ডাক্তারের খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে সারা রাত জেগে রাস্তা অবরোধ, রাত দখল, ভোর দখল করে জন জাগরণে শামিল হয়ে সেই বিদ্রোহ আন্দোলনকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেন। অথচ, এঁরাই আবার নির্বাচন এলে সব ভুলে গিয়ে ক্ষুদ্র সুবিধা কিংবা পদের লোভে বিধানসভার উপনির্বাচনে ছ’টির মধ্যে ছ’টি আসনেই জিতিয়ে সরকারের কাছে নিজেদের কৃতজ্ঞতা বোধের পরিচয় দেন।
চৌত্রিশ বৎসর বাম আমলেও খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, চূড়ান্ত দুর্নীতি— সবই ছিল। কিন্তু তথাকথিত মধ্যবিত্ত বাম-বুদ্ধিজীবীরা সরকারকে নিজেদের সততা ও নিষ্ঠার বেষ্টনী দিয়ে শুধু আগলেই রাখতেন না, বিভিন্ন সময়ে সু-পরামর্শ দিয়ে ও নৈতিক দায়িত্বের মাধ্যমে পরোক্ষ ভাবে সরকারকে মদত জোগাতেন। কিন্তু ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জন-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য বাম সরকারের অধঃপতন বুদ্ধিজীবীদের বিবেকে আঘাত করে এবং তাঁরা সরকারের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসেন। এর জন্যই শেষ পর্যন্ত বাম সরকারের পতন ঘটে।
যদিও এ রাজ্যে আগামী দিনে, অর্থাৎ ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে সরকারের পতন দূর অস্ত্। কারণ, এ রাজ্যের বুদ্ধিজীবী নামক ব্যক্তিরা, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অনুদান গ্রহণ এবং উচ্চপদে আসীন হওয়ার লোভে গান্ধারীর মতো চোখে কাপড় বেঁধে শাসকের কৌরববাহিনীর রাজ্যে দুর্নীতি, খুন, জখম, রাহাজানি দেখতে পান না। অথচ, এই সুবিধাভোগী ব্যক্তিরাই বীরদর্পে দিবালোকে রাস্তায় বুক ফুলিয়ে সরকারের সাফল্য প্রচারে ব্যস্ত থাকেন, আবার কখনও কখনও লোকদেখানো সরকারবিরোধী রসদবিহীন আন্দোলনে শামিল হন।
আর এঁদের মতো লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী মানুষ, যাঁরা বিধবাভাতা, বার্ধক্য ভাতা, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রভৃতি ক্ষণিকের স্বল্পপ্রাপক উপভোক্তা, তাঁরাই হলেন এ রাজ্যের ‘ফ্লোটিং ভোটার’। তাঁদের জন্যই এই সরকারের অস্তিত্ব আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
গাঁটছড়া কই
শুভময় মৈত্র তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, সিপিআইএম-কংগ্রেস স্বভাবতই বিজেপি-তৃণমূল গাঁটছড়া তত্ত্ব আওড়ায়। কিন্তু তাদের বন্ধু বুদ্ধিজীবীরা কিছুতেই বললেন না যে, এই সেটিং তত্ত্ব মেনে নিয়েও রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তৃণমূল ও বিজেপি। তা ছাড়া, গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে, এমনকি ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই একই ধারার গাঁটছড়া সিপিএম আর কংগ্রেসের মধ্যেও ছিল।
বাম রাজত্বের চৌত্রিশ বছরে কেন্দ্রের ক্ষমতায় একটানা কোনও দল মসনদে থাকেনি। রাজ্যে তখন প্রধান দু’টি দল। বামফ্রন্ট এবং বিরোধী কংগ্রেস। বামেরা ক্ষমতায় টিকে ছিল সংগঠনের জোরে। স্বজন-পোষণের অভিযোগ ছাড়া কোনও দুর্নীতির দায় সেই আমলে কোনও নেতার বিরুদ্ধে ছিল না। তাই কোনও সিবিআই তদন্তের প্রয়োজন হয়নি। অপর দিকে কংগ্রেস ক্ষীণ হয়েছে গোষ্ঠী কোন্দলে। তবে এ কথা ঠিক, কংগ্রেসের রাজ্য স্তরের কয়েক জন নেতা সিপিএম-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ক্ষমতা ভোগ করার সুবাদে ‘তরমুজ’ উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু ‘সেটিং’ করে দল ভাঙিয়ে নেওয়ার কোনও ঘটনা ঘটেনি। সুতরাং, কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও ‘সেটিং’ থেকে সিপিএম-এর কী লাভ হয়েছিল, বোধগম্য হল না।
উল্টে, বর্তমানের তৃণমূল-বিজেপির গাঁটছড়া তত্ত্বের চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তৃণমূল সরকারে আসার অব্যবহিত পর থেকেই কেন্দ্রে টানা রয়েছে বিজেপি সরকার। এক দিকে এ রাজ্যে বিজেপির ক্রমবিস্তারের যেমন প্রয়োজন, অন্য দিকে তৃণমূলের দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়া নেতা-মন্ত্রীদের সিবিআই তদন্তের হাত থেকে রেহাই, এই দুইয়ের পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য গাঁটছড়া তত্ত্বের যৌক্তিকতাকে স্বাভাবিক ভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
সুতরাং, যে গাঁটছড়া তত্ত্ব মেনে নিয়ে রাজ্যের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল তৃণমূল-বিজেপি, সেই একই ধারার সেটিং সিপিএম-কংগ্রেসের মধ্যে ছিল, এই যুক্তি ধোপে টেকে না।
দেবব্রত সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)