বিপন্ন: পুলিশভ্যান দেখে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল জনতা, শ্রীনগর, ৩১ মে। এপি
প্রিজ়ন ভ্যানের একেবারে ধারে বসে আসিফ সুলতান। হাতকড়ার এক প্রান্ত তাঁর ডান হাতের কব্জি আঁকড়ে রেখেছে। আর এক প্রান্ত ধরে রেখেছে নিরাপত্তা রক্ষীর বজ্রকঠিন মুঠি। আসিফের পরনে হলদেটে সবুজ রঙের গোল গলা গেঞ্জি।
তাঁর বুকের উপরে ইংরেজিতে লেখা, ‘জার্নালিজ়ম ইজ় নট আ ক্রাইম’!
আসিফ সুলতান ‘কাশ্মীর ন্যারেটর’-এর সাংবাদিক। তাঁকে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ গ্রেফতার করেছিল ২০১৮-র ২৭ অগস্ট। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি জঙ্গি সংগঠনকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। ২০১৭-র একটি সংঘর্ষের ঘটনাতেও তাঁকে জড়ানো হয়।
এর মাসখানেক আগে ‘কাশ্মীর ন্যারেটর’-এর সম্পাদক শওকত এ মট্টা-র কাছে জম্মু-কাশ্মীর সিআইডি-র মিডিয়া সেলের একটি মেল আসে। তাতে ‘কাশ্মীর ন্যারেটর’-এ প্রকাশিত দু’টি নিবন্ধের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হয়। জানতে চাওয়া হয়, হিজবুল কমান্ডার, সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত বুরহান ওয়ানির ছবি প্রকাশ করে কি তাঁকে ‘রোম্যান্টিসাইজ়’ করা হয়নি? এ ব্যাপারে দু’দিনের মধ্যে তাঁকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
২০১৮-র জুনে আসিফ এক দীর্ঘ প্রচ্ছদ নিবন্ধ লেখেন বুরহান ওয়ানিকে নিয়ে। সেখানে বিভিন্ন জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে, তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন আসিফ, কবরে শুয়ে থাকা বুরহান কেন বাড়ির বৈঠকখানায় থাকা জীবিত বুরহানের থেকে বেশি বিপজ্জনক? বুরহানের মৃত্যু হয়েছিল ২০১৬-র জুলাইয়ে।
আসিফের সম্পাদক, বাড়ির লোকজন, স্থানীয় মিডিয়া, সকলেরই অভিযোগ, তাঁকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। না, এই নিবন্ধ জম্মু-কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে নয়। তা হলে উপত্যকার এক সাংবাদিকের গ্রেফতারি নিয়ে এই দীর্ঘ কথনের প্রয়োজনটা কোথায়?
বিপুল জনাদেশ নিয়ে দ্বিতীয় বার দিল্লির মসনদে নরেন্দ্র মোদী বসার পরে চতুর্দিকে এখনও উৎসবের আবহ। বস্তুত, এই আবহে কাশ্মীর নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলার অর্থই হল, নিজেকে স্বেচ্ছায় ‘দেশদ্রোহী’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা! বিশেষত যেখানে অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরেই কাশ্মীর ‘শান্ত’ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে, পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে একেবারে পাঁচ বছরের জন্য পুনর্নিয়োগ করা হয়েছে সেই অজিত ডোভালকে, যিনি কড়া পদক্ষেপ করতেই পছন্দ করেন। এবং অমিত শাহও চরমপন্থী ধাঁচের মানুষ বলেই পরিচিত।
ফলে শপথ নেওয়ার পরে একটুও সময় নষ্ট না করে অমিত শাহ দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিককে। সেই বৈঠকের পরে জঙ্গিদের একটি তালিকা বানিয়ে ফেলেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত মিলছে, তাতে উপত্যকায় শেষ কথা যে বলবে রাইফেলের নলই, তা-ও স্পষ্ট। অর্থাৎ, কাশ্মীরি জনতার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
এই আশঙ্কা রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু দেখার, কথায় কথায় থানায় বা সেনা ব্যারাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার, এই আশঙ্কা আচমকা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার, বিক্ষোভে পেলেট গানের নির্বিচার ব্যবহারের, এই আশঙ্কা রাজনৈতিক প্রভুদের ছাড়পত্র পাওয়ার পরে উর্দিধারীদের বাড়বাড়ন্ত ঘটার। আশঙ্কা পদে পদে মানবতার অপমানের। কয়েক জনের দুষ্কর্মের দায় গোটা সম্প্রদায়ের উপরে চাপিয়ে সারা পৃথিবীর কাছে তাদের জঙ্গি বলে দাগিয়ে দেওয়ারও!
এই রাষ্ট্রেরই এক ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ কাশ্মীরকে বশে রাখতে রাষ্ট্রশক্তি কী ধরনের পীড়ন চালাতে পারে, সাংবাদিক আসিফের গ্রেফতারি তার একটি নিদর্শন মাত্র। আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বুধবার, ১২ জুন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল শ্রীনগরে সাংবাদিক সম্মেলন করতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য, জম্মু-কাশ্মীর জনসুরক্ষা আইনে (পাবলিক সিকিয়োরিটি অ্যাক্ট বা পিএসএ) বিনা অভিযোগে বা বিনা বিচারে আটকদের উপর তাদের রিপোর্ট প্রকাশ। কিন্তু, ‘বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি’র কথা ‘বিবেচনা’ করে প্রশাসন তাদের সাংবাদিক সম্মেলন করার অনুমতি দেয়নি।
এই জনসুরক্ষা আইন এক কথায় দেশের আরও একটি কালা আইন। সরকারি তথ্য বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২,৪০০ জনেরও বেশি লোককে এই আইনে আটক করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও এর অন্তত ৫৮ শতাংশ নির্দেশ পরে আদালতে খারিজ হয়ে যায়। নিরাপত্তা বাহিনী বা পুলিশের কাছে এই আইন খুবই প্রিয়। এর প্রয়োগ করে কাউকে এক বার জেলে পুরে দিতে পারলে এক থেকে দু’বছরের মধ্যে তাঁর বেরোনোর আশা খুবই ক্ষীণ। এই সময়কালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাল-হকিকত পুলিশ প্রশাসন না জানালেও পারে।
উপত্যকার মানুষের আশঙ্কার আরও কারণ আছে। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবিতে বিজেপি দীর্ঘ দিন ধরেই সরব। এ বারের নির্বাচনী ইস্তাহারেও সে কথা তারা সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে। আছে সংবিধানের ৩৫এ ধারা বিলোপের কথাও। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই অমিত শাহও সে কথা আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন।
আশঙ্কার আরও একটি কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। দ্বিতীয় মোদী সরকার যত চরমপন্থার দিকে এগোচ্ছে, সরকারেরই নিয়োগ করা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা ততই গৌণ হয়ে পড়ছে। এমনিতেই বিভিন্ন সময়ে দিল্লি বহু মধ্যস্থতাকারী পাঠিয়েছে কাশ্মীরে। তাঁরা যে সুপারিশ বা পরামর্শই দিন না কেন, তা যে মেনে চলেছেন দিল্লির কর্তারা, এমনটা নয়। তা ছাড়া, দিল্লি মধ্যস্থতাকারী পাঠালেই যে তা কাশ্মীরের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল মেনে নিয়েছে, সেটাও নয়। কারণ, দিল্লির পছন্দের তালিকায় অগ্রাধিকার পেয়েছেন প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান বা আমলারা। যেমন, কিছু দিন আগে প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান দীনেশ্বর শর্মাকে বিশেষ দূত হিসাবে নিয়োগ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু সে সময়ে হুরিয়ত নেতারা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা দীনেশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নন। তাঁদের দাবি ছিল, তার আগে ভারত সরকারকে স্বীকার করে নিতে হবে যে কাশ্মীর বিতর্কিত এলাকা।
বিপুল জনাদেশের আশীর্বাদ নিয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য ভারত শাসনের অধিকার পেয়েছে বিজেপি। বিরোধীরা কার্যত ছন্নছাড়া, ছন্দহীন। কিন্তু, এত বড় গণতান্ত্রিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এলেও ভারতীয় গণতন্ত্রের আজ বড়ই দুর্দিন। শাসককুল রাজনৈতিক বিরোধিতা সহ্য করতে পারেন বটে, কিন্তু বিরুদ্ধ স্বর একেবারেই সহ্য করতে পারেন না!
তাই ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের তালিকা বানাতে হয়। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের, দেশের নানা প্রান্তে বিদ্বজ্জন বা নাগরিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে শামিল মানুষজনদের। কিন্তু তাঁদেরও এ বার বুঝতে হবে, স্রেফ সংখ্যার বিচারেই বড় হওয়া যায় না। বড়ত্বের জন্য একটা সহজাত উদারতা লাগে, দু’হাত দিগন্ত-প্রসারিত করে, নমনীয় বুকে আশ্রয় দিতে হয় পাথর ছোড়া যুবকদেরও।
সম্রাট যেমন জানতে চান তাঁর সাম্রাজ্যের প্রান্তসীমায় পড়ে থাকা প্রজাটিরও অসন্তোষের কারণ, তেমনই দিল্লীশ্বরকেও জানতে হবে, গোয়েন্দার চোখ-কান দিয়ে নয়, একেবারে সরাসরি বুঝতে হবে কাশ্মীরের মানবজমিনের কথা। সেনাবাহিনীকে দূরে রেখে অনুভব করতে হবে উপত্যকার অন্তরাত্মাকে।
আর সে দিনটি এলে ভারতীয় গণতন্ত্র হয়ে উঠবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy