শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব সারা বাংলার মানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই রাজ্য তো বটেই, এমনকি গোটা বিশ্বে সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত এই আশ্রম বিদ্যালয়ের সর্বত্র গাছগুলি ফুলে পরিপূর্ণ, প্রকৃতি আজ ঐশ্বর্যময়, বসন্তে যেন তার বুকে নতুন করে প্রাণসঞ্চার ঘটছে।
অথচ, এই আনন্দময় পরিবেশে ছায়া ফেলছে এক পুরনো উদ্বেগ— পলাশ ফুলের নিধন। রবীন্দ্রনাথের সময়কালে পলাশ ফুল ব্যবহারের উপর কোনও বাধা ছিল না। সেই সময় বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গণে পলাশ গাছ লাগান হত প্রচুর, ফুলেরও অভাব ছিল না। এখন ঘন জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে পলাশ ফুলের গাছের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। বসন্ত উৎসবের আগেই দেখা যাচ্ছে এক দল পর্যটক শান্তিনিকেতনের আশেপাশে পলাশ ফুল চুলের খোঁপায় লাগাচ্ছেন, গলায় মালা করে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রতি বছর বসন্ত উৎসবের আগে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সভা, কর্মিসভা, আশ্রমিক এবং ছাত্রছাত্রীরা পলাশ ফুল রক্ষার জন্য বিভিন্ন ভাবে প্রচার অভিযান চালান। আশ্রম প্রাঙ্গণ-সহ বিভিন্ন জায়গায় লেখা হয় পোস্টার, ‘পলাশ বাঁচান’।
এমন লাগাতার প্রচারের ফলে ০১৮ সালে অনেক কম পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে পলাশ ফুল। তবু এই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই অনেকে দোলের দিন লাগামছাড়া ভাবে পলাশ ফুল ব্যবহার করছেন। কিছু অসাধু লোক পলাশ ফুল এবং তার মালা নিয়ে চড়া দামে ব্যবসা শুরু করে দেন। কিছু উচ্ছৃঙ্খল পর্যটক পলাশ ফুল নিয়ে উল্লাস করেন। পলাশ ফুল বসন্তের সম্পদ, তাকে এ ভাবে নষ্ট করলে প্রকৃতির সৌন্দর্যহানি হয়, এ কথা তাঁরা বোঝেন না। সকলের কাছে একান্ত অনুরোধ, পলাশ ফুলকে রক্ষা করুন।
সুকমল দালাল
শান্তিনিকেতন, বীরভূম
রঙের বিপদ
মনের রংকে প্রকৃতির রঙের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেয় দোল উৎসব। কিন্তু কেমন হবে দোল খেলার ফাগ, বা আবির? আবির রাসায়নিক হতে পারে, কিংবা ভেষজ হতে পারে। দুইয়ের মধ্যে চেনার সুবিধে হল, রাসায়নিক মেশানো রং গাঢ় চকচকে ও উজ্জ্বল হয়। আর ভেষজ রঙের গুঁড়োয় হাত দিলে মোলায়েম পাউডারের মতো লাগে।
রাসায়নিক আবির অত্যন্ত ক্ষতিকর। গাঢ় সবুজ রঙে থাকে কপার সালফেট, যার স্পর্শে চোখে ও গায়ে নানা রকম অ্যালার্জির সৃষ্টি হয়ে সাময়িক দৃষ্টিহীনতাও দেখা দিতে পারে। গাঢ় বেগুনি রঙে ক্রোমিয়াম আয়োডাইডের মিশ্রণ পাওয়া যায়, যা থেকে হাঁপানি ও অন্যান্য অ্যালার্জি হতে পারে। রুপোলি রঙে থাকে অ্যালুমিনিয়াম ব্রোমাইড, যার থেকে ক্যানসার হতে পারে। অনেকে রং খেলার সময়ে মুখে ভূতের মতো কালো রং লাগিয়ে মজা পান। কালো রঙে লেড অক্সাইড থাকে, যার ফলে কিডনি ও মস্তিষ্কের ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা। গাঢ় নীল রঙে পাওয়া যায় প্রুশিয়ান ব্লু, যেটা চর্মরোগের অন্যতম কারণ। গাঢ় লাল রঙে থাকে মার্কারি সালফেট, যার জন্য ত্বকের ক্যানসার, মিনামিটা-সহ অনেক রোগ হতে পারে।
রঙের স্পর্শ প্রথম যে যে অঙ্গে লাগে, সেটা হল ত্বক ও চোখ, এবং এর পরে মুখ। চোখে বা ত্বকে ক্ষতিকর রাসায়নিক রং লাগলে জ্বালা করবে, চিড়বিড় করবে, চোখ দিয়ে জল গড়াবে, চোখ লাল হবে, ত্বকে চুলকানি ও লালচে জ্বালাময়ী র্যাশ বেরোতে পারে। এমন লক্ষণ দেখলে চটজলদি ঠান্ডা, পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা দরকার। পরে নরম সাবান, শ্যাম্পু ব্যবহার করা যেতে পারে। খুব বেশি চোখ বা ত্বক জ্বালা করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। রঙের ক্ষতিকর দীর্ঘকালীন প্রভাব লিভার, কিডনি, মস্তিষ্কে দেখা দিতে পারে। ক্যানসারেরও আশঙ্কা থাকে। সেই কারণে রাসায়নিক রঙের পরিবর্তে ভেষজ রং ব্যবহার করতে পারলে অনেকখানি নিরাপদে থাকা সম্ভব।
আর ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে হলে দোলের আগের দিন স্বল্প নারকেল তেল মাথায় দেওয়া, দোল খেলার দিনে টুপি বা কাপড়ের ফেট্টি মাথায় বাঁধা, ফুলহাতা জামা-প্যান্ট পরে রং খেলা, চোখে পাওয়ারলেস চশমা পরা, কনট্যাক্ট লেন্স না পরে দোল খেলার চেষ্টা করতে হবে। এবং খেলার পরে সাবান, শ্যাম্পু ব্যবহার করে ও বেশি না ঘষে রং তুলে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। এক দিনে বেশি সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহার করে রং তোলার চেষ্টা না করাই উচিত। স্নানের সময় হালকা গরম জল ব্যবহার করলে ভাল হয়।
কুমার দাস
শ্রীরামপুর, হুগলি
দোলের মিঠাই
দোলের রং খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিষ্টিমুখ। তবে দোলের মিষ্টি বলতে রসগোল্লা, সন্দেশ, পান্তুয়া, কমলাভোগ নয়, আমরা চিনির তৈরি মঠ ও ফুটকড়াইকেই বুঝি। এই মঠ ও ফুটকড়াই তৈরি করে সাধারণত বাতাসা প্রস্তুতকারীরা। ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মঠ ও ফুটকড়াই প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়।
প্রস্তুতির পদ্ধতিটাও দেখার মতো। প্রথমে গরম কয়লার উনুনে কড়াইয়ের মধ্যে চিনি ও জল মিশিয়ে চিটচিটে আঠালো লেই প্রস্তুত করা হয়। চিনি ও জলের আঠালো মিশ্রণে যে ‘মঠ’ তৈরি হয়, তাকে নানা রঙে রঙিন করে তোলার জন্য খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত গোলাপি, লাল, বাসন্তী প্রভৃতি বিভিন্ন রং মেশানো হয়। চিনির তৈরি গরম অবস্থায় রঙিন আঠালো লেইকে ছোট ফুটো করা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে ঢালা হয়। এই হাঁড়িটিকে ধরার জন্য একটি কাঠের হাতল করা থাকে, তার সাহায্যেই গরম হাঁড়িটিকে ডান হাতে ধরে, একটি এক ফুট আকারের সরু লাঠি দিয়ে গুলিয়ে গুলিয়ে ফর্মার মধ্যে ঢালা হয়।
কাঠের তৈরি এই ফর্মাগুলির নানা আকার হয়— রথ, পাখি, হাঁস, গাছ প্রভৃতি। কিছু ক্ষণ, অর্থাৎ মিনিট পাঁচেক ফর্মার মধ্যে রেখে ঠান্ডা হলেই ফর্মা খুলে মঠগুলি বার করে রেখে দেওয়া হয়। ফর্মাগুলি জলে ধুয়ে পুনরায় মঠ তৈরির কাজে লাগানো হয়। খরিদ্দারের চাহিদা অনুযায়ী নানা রঙের এবং নানা আকারের মঠ তৈরি করা হয়।
ফুটকড়াই তৈরি করতে গরম কড়াইয়ে চিনিমিশ্রিত ফুটন্ত জলে ভাজা ছোলা দিয়ে নাড়তে থাকেন কারিগর। চিনির রস যখন ফুটে ফুটে ছোলার গায়ে আঠার মতো লেগে যায়, তখন তা নামিয়ে ঠান্ডা করা হয়। এ ভাবেই ফুটকড়াই প্রস্তুত করা হয়। মঠ ও ফুটকড়াই উৎপাদন করতে কারিগররা দিনরাত পরিশ্রম করেন। কারিগরদের কাছে পাইকারি, খুচরো দোকানদাররা ভিড় করেন, সাধারণ খরিদ্দাররাও আসেন।
শ্রীমন্ত পাঁজা
গঙ্গাধরপুর, হাওড়া
বিলে ভাত
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হাওড়ার গ্ৰামে গ্ৰামে এক অভিনব উৎসব দেখা যায়। স্থান ভেদে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম। আমতা-জয়পুর-উদয়নারায়ণপুরে এই উৎসবের নাম ‘হাটে কিনে মাঠে রান্না’। বাগনানে এর নাম ‘রেঁধে খাওয়া’। শ্যামপুরে একে বলে ‘বিল রান্না’ বা ‘বিলে ভাত’।
তবে উৎসবের রীতিনীতি সবার এক। শীতলা পুজোর দিন বাড়িতে উনুন জ্বালা ও রান্না করা বারণ, তাই ওই দিন গ্ৰামের বা পাড়ার সব মানুষ বনভোজনের মতো মাঠে, ডাঙায় বা বিলের ধারে রান্না করে খান। আগের দিন করে রাখা হয় দোকান-বাজার। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মাঠ বা বিলের ধারে তৈরি হয় সারি সারি উনুন। আনাজ কাটা, রান্না করা, খাওয়া দাওয়া হয় মাঠেই। কলাপাতা পেতে ভাত, বিউলির ডাল, আলু পোস্ত, চাটনি খাওয়া হয় পেটপুরে। ডাঁটা চচ্চড়ি হবেই হবে। চলে তরকারি আদান-প্রদান।
এই উপলক্ষে ঘরে ঘরে আসে কুটুম। আমন্ত্রিত-অনাহূত এখানে সবাই সমান। উৎসবের সময় কোথাও কোথাও বসে মেলা। পরিবেশিত হয় শীতলার গান। উৎসব শেষে উনুন ভেঙে, জল ঢেলে, নমস্কার জানিয়ে বাড়ি ফেরেন সবাই।
দীপংকর মান্না
চাকপোতা, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy