মোহিত রায় তাঁর নিবন্ধে (১৮-৫) দুঃখপ্রকাশ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অসমকে দেখে শিখলেন না। কী শেখার উপদেশ দিচ্ছেন তিনি? তাঁর নিজেরই ভাষায় অসমে বিজেপির নির্বাচনী সঙ্কল্পপত্রে প্রতিশ্রুতি ছিল, “...অভারতীয় সংস্কৃতি থেকে অসমকে বাঁচানো, লাভ জেহাদ বন্ধ করা, মৌলবাদকে প্রতিহত করা।” এই ‘অভারতীয় সংস্কৃতি’ বিষয়টি ঠিক কী? আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি তো বহুত্ববাদী, সারা বিশ্ব থেকেই আমরা যা কিছু গ্রহণযোগ্য, তা নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করি, তা মার্ক টোয়েনের গল্প থেকে চাউমিন খাওয়া, স্কটিশ সঙ্গীতের সুর থেকে রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী মানবতার আখরস্বরূপ উপন্যাসসমূহ, সবই। আমাদের শিশুদের হাতে গোপাল ভাঁড় ও মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প একই সঙ্গে অবস্থান করে। শোনা যায় যে, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নাকি রুশ ঔপন্যাসিক তলস্তয়ের লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে মেসবাড়ির পরিচারিকাকে তাঁর উপন্যাসের নায়িকা করেন। সুকুমার রায় নিঃসঙ্কোচে বিজেপির আরাধ্য ‘ভারতীয় দেবদেবী ও মহাপুরুষদের’ নিয়ে ব্যঙ্গকৌতুক রচনা করেন, আর হাস্যরসের আড়ালে দেখিয়ে দেন ওই সনাতন আদর্শের পিছনে লুকিয়ে-থাকা কৃষ্ণগহ্বরগুলিকে। মাইকেল তাদের আরাধ্য রামকে সরাসরি ‘তস্কর’ বলতেও দ্বিধা করেন না। লেখক কোন ভারতীয় সংস্কৃতি শিক্ষার উপদেশ দিচ্ছেন আমাদের?
লেখক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, “বামেরা চূড়ান্ত হারলেও শিক্ষাজগতে তাদের ভারতীয় সংস্কৃতিবিরোধী চিন্তাই শাসন করবে।” কোনটা ‘ভারতীয় সংস্কৃতিবিরোধী চিন্তা?’ ইতিহাসে ইউরোপীয় নবজাগরণের অবদান? গালিলেও, ব্রুনোদের চিন্তা, রুশো-ভলতেয়ারের চেতনার সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর চেষ্টা? উপমহাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো? বিজ্ঞানের শুকনো তথ্যের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের জীবনী? কোনটা?
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মহান কীর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সাধারণ বাঙালির স্মৃতিতে তা দেশভাগ, দাঙ্গা, কোটি কোটি মানুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ এবং উদ্বাস্তু হয়ে ওঠার, জীবন-জাতি-মানবিকতার চরমতম সঙ্কটের আখ্যান, যার মূল্য এখনও বাঙালিকে দিতে হচ্ছে। লেখকের ‘আদর্শ’ রাজ্য অসম যার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ।
অরিন্দম মৈত্র, চুঁচুড়া, হুগলি
সংস্কৃতির শক্তি
মোহিত রায়ের নিবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, অসমকে দেখে শিখেছে বলেই বিজেপিকে ক্ষমতায় এ বার আনেনি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। অসমে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বাঙালি বিদ্বেষকে কেন্দ্র করে, যা অসমের জাতিসত্তা বা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে বহু দিন ধরে। বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামও হয়েছে। বিজেপির ইস্তাহারে ইসলাম মৌলবাদের উল্লেখ না থাকলেও, এ রাজ্যে তিনটি আসন পাওয়ার পর থেকে বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণের কাজটি করে আসছে। নয়তো বামেদের মগজধোলাই করে তাদের ভোট ঝুলিতে ভরল কী করে?
লেখক বলেছেন, ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি-বিরোধী চিন্তা ও মৌলবাদীরা প্রভাব বিস্তার করবে। আমরা জানি, ভারতীয় সংস্কৃতি অনেক গভীর, ব্যাপক ও বিস্তৃত। বৈচিত্রে ভরপুর। সেখানে তসলিমা নাসরিনের মতো লেখিকা যেমন স্বাগত, মকবুল ফিদা হুসেনের মতো শিল্পীও তা-ই। দু’জনের কাউকে আমরা আশ্রয় দিতে পারিনি।
ত্রিদিব হালদার, ভ্যাবলা, উত্তর ২৪ পরগনা
অহেতুক ভয়
মোহিত রায় বলেছেন, বিজেপির উচিত ছিল উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গে মেরুকরণের তাসটি খেলার, যার মধ্যে বিভেদকামী মননের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। তিনি ৮০ কোটি হিন্দুর দেশে হিন্দুদের অস্তিত্ব সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন, যা হাস্যকর। তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে ২৭% (২০১১) মুসলিম রয়েছে। কিন্তু উল্লেখ করেননি যে, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। সুতরাং, এই ভাবে অহেতুক ভয় দেখানো অযৌক্তিক।
জাতীয় নাগরিকপঞ্জির লাঞ্ছনার পরও যে ভাবে অসমের বাঙালি হিন্দুরা কেবল ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, সে ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুদেরও ঐক্যবদ্ধ ভাবে বিজেপিকে ভোট দেওয়া উচিত বলে তাঁর মনে হয়েছে। অর্থাৎ, তিনি ধর্মীয় মেরুকরণের ঊর্ধ্বে বাঙালির যে প্রগতিশীল রায়, তা মানতে পারছেন না। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে ‘ইসলামি মৌলবাদী’দের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে মৌলবাদীরা কোনও ধর্মেরই প্রতিনিধি নয়।
ওয়াকার নাসিম সরকার, পান্ডুয়া, হুগলি
আদর্শ অসম?
মোহিত রায় পরিতাপ করেছেন, বিজেপির নেতারা কেন অসমকে দেখে শিখলেন না, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যার শতকরা হিসাব পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও, “শাসক দল বিজেপি নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই মাদ্রাসা শিক্ষা অবলুপ্ত করে।” অসমের নির্বাচনে বিজেপির উদ্দেশ্য ছিল, “অভারতীয় সংস্কৃতির হাত থেকে অসমকে বাঁচানো।” আর তাই পুরুষ, নারী, শিশু নির্বিশেষে, ১৯ লক্ষ অধিবাসীকে বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয় শাসকের পছন্দমতো কাগজপত্র জমা না দিতে পারার কারণে, যেখানকার ভয়াবহ অমানবিক পরিস্থিতি দেখে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন। চার দশক আগে এই অসমেরই নেলীতে কয়েক হাজার পুরুষ, নারী, শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল বহিরাগতদের হাত থেকে স্থানীয় সংস্কৃতি ও জনসংখ্যার ধর্মীয় অনুপাত রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। সত্যিই এই রাজ্যের বিজেপি নেতাদের অনেক কিছু শেখার বাকি।
আত্রেয়ী মিত্র, কলকাতা-১০৬
যা কিছু সম্পদ
আমাদের গ্রাম আমগেছিয়া দক্ষিণ পাড়া, হিন্দু অধ্যুষিত। ছোটবেলা কাটিয়েছি ওই পাড়ায় আমার হিন্দু সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাতেও হিন্দু বন্ধুবান্ধব ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। শিক্ষকতা করেছি উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে। কখনও সঙ্কীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার মানুষের সান্নিধ্যে আসিনি। বর্তমানে, আমি দু’টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। এখানেও ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে আগত এবং শান্তিপূর্ণ ভাবেই তাঁরা সহাবস্থান করছেন। যে কোনও মৌলবাদী ধারণা মানবজাতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্তরায়। তাই মৌলবাদকে সমূলে উৎপাটিত করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।
মোহিত রায় অসমে মাদ্রাসা শিক্ষা অবলুপ্ত করার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, যেন পশ্চিমবঙ্গেও তেমনটি করা হয়। অথচ, মুসলমানদের মোট ছাত্রসংখ্যার মাত্র ৪% মাদ্রাসায় যায়। পশ্চিমবঙ্গের কিছু মাদ্রাসায় মুসলমান ছাত্রের থেকে হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা বেশি, এবং মাদ্রাসা বোর্ডে ও মাদ্রাসায় অনেক অমুসলিম কর্মীও আছেন। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, মোট মুসলমান জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হয় নিরক্ষর, আর নাহয় প্রাথমিক বা উচ্চপ্রাথমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া শিখেছেন।
আবশ্যক পণ্যে মুসলমানদের মাথাপিছু ব্যয় ৩২.৬৬ টাকা, যা অন্য সকল সম্প্রদায়ের থেকে কম। কোনও দেশের বিশেষ কোনও নাগরিক সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠী যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে, তা হলে সেই দেশ কি কখনও একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত হতে পারে? এদের পশ্চাৎপদতা কি একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পশ্চাৎপদতার কারণ নয়? এটা কি দেশের মানবসম্পদের অপচয় নয়?
ইউ মেনুন খান, নন্দীগ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy