পশ্চিমবঙ্গের রক্তক্ষয়ী পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩ প্রত্যাশামতো শাসক দলের বিপুল জয় দিয়েই সমাপ্ত হল। —ফাইল চিত্র।
দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘জয় করে তবু...’ (১৩-৭) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। পশ্চিমবঙ্গের রক্তক্ষয়ী পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩ প্রত্যাশামতো শাসক দলের বিপুল জয় দিয়েই সমাপ্ত হল। এই জয়ের কতটা বৈধ আর কতটা অবৈধ, তা আদালতের বিচার্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখন নির্বাচন ও হিংসা একে অপরের পরিপূরক। এই হিংসার দুটো দিক। রাজনৈতিক দিক হল, শাসক দলের সর্বগ্রাসী মনোভাব, যা বিরোধীকে সামান্য পরিসর দিতে প্রস্তুত নয়। সেই কারণেই মনোনয়নে বাধা, ছাপ্পা ভোট, গণনাকেন্দ্র থেকে বিরোধী এজেন্টদের মারধর করে বার করে দেওয়া, ব্যালট পেপার চিবিয়ে খেয়ে ফেলার মতো ঘটনা দেখা গেল। যেখানেই এই অগণতান্ত্রিক কাজের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করেছে জনসাধারণ, বা বিরোধী দলগুলো, সেখানেই হিংসার ঘটনা ঘটেছে।
আর অর্থনৈতিক দিকটা হল, পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম-শহরের রাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিটা এলাকায় শাসক দলেরনেতা-নেত্রীদের কেন্দ্র করে একটা বিরাট সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এরা কেউ পঞ্চায়েত বা পুরসভায় ঠিকাদারি করে, আবার কেউ নেতা-নেত্রীদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। এই বিশাল অংশের সুবিধাভোগীরা তাদের পেশা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে যেন তেন প্রকারেণ নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করে। সেই কারণেই হিংসা আজ লাগামছাড়া। প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই উল্লেখ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল রহস্যাবৃত। নির্বাচন কমিশন যদি সক্রিয় এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করত, তা হলে হয়তো গণতন্ত্রের উৎসবের নামে এই নরমেধ যজ্ঞ আমাদের দেখতে হত না।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
দায় বিরোধীরও
দেবাশিস ভট্টাচার্য কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্থাপন করেছেন। এটা যেমন সত্যি যে, বিরোধীদের তরফ থেকে, বিশেষ করে বিজেপির পক্ষ থেকে যে রকম নজিরবিহীন সন্ত্রাস, হিংসার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা সর্বৈব সত্য নয়। সত্য হলে শাসক দলের এত কর্মী-সমর্থকের মৃত্যু হত না। বাড়ির ঝগড়াও এখন নেমে আসছে রাজনীতির আঙিনায়, বলি হচ্ছেন খেটে-খাওয়া মানুষ। ২০১৩ সালেও তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করিয়েছিলেন। তাতেও রাজ্যে হিংসা, মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। বাম জমানা থেকেই বাংলার পঞ্চায়েত ভোট রক্তাক্ত বধ্যভূমিতে পরিণত হচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের অকর্মণ্যতা বহু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেন আইবি-র কাছে এই বিপুল বেআইনি অস্ত্রশস্ত্রের ভান্ডারের খবর নেই? পার্শ্ববর্তী রাজ্য অথবা দেশ থেকে অবৈধ ভাবে দুষ্কৃতীদের ঢোকানো হচ্ছে, তার খবর কেন থাকছে না? শাসক দল বা বর্তমান সরকারের দিকে আঙুল তোলা সোজা। হ্যাঁ, ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের দায় সবচেয়ে বেশি, কিন্তু দেশের বাকি রাজ্যগুলির তুলনায় (কিছুটা দিল্লির ক্ষেত্রে ছাড়া) এই রাজ্যে সম্ভবত বিরোধীরা, কেবল বিরোধিতার জন্য, রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পিছপা নয়। এমন ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রশাসকের ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল নিরপেক্ষ অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু সেই আশায় জল নিক্ষেপ করা হয়েছে। সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী যুযুধান দু’পক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্তত একটা সাহসী, ঐকান্তিক প্রয়াস ছিল। বর্তমানে তেমন উদ্যোগ দেখা গেল না। মাননীয় হাই কোর্টের কাছে অনুরোধ, ঘৃণাভাষণের ক্ষেত্রে কঠোর মনোভাব নেওয়া হোক সব ক্ষেত্রেই। কাউকে রক্ষাকবচ, কাউকে গুরুদণ্ড— এমন ভেদ না করাই শ্রেয়।
দেবরাজ সেনগুপ্ত, কলকাতা-৪০
প্রাণের দাম
এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের প্রকৃত চিত্র— বুথের ভিতর ব্যালট পেপার ছিল, বাক্স ছিল, প্রিসাইডিং অফিসার-সহ পাঁচ জন ভোটকর্মীও ছিলেন। কিছু কিছু বুথে সে সব রক্ষা করার দায়িত্বে ছিলেন বুথ-পিছু এক জন করে এক্সাইজ় ডিপার্টমেন্টের কনস্টেবল। তাঁর হাতে ছিল একটা ইনসাস, সঙ্গে দশ রাউন্ড গুলি। যদিও গুলি ম্যাগাজ়িনে লোড না হয়ে পকেটেই বিশ্রাম নিচ্ছিল। আবার অনেক বুথে গোদা বন্দুক হাতে এক জন হোমগার্ড, কোথাও বা সিভিক ভলান্টিয়ার। কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল নামমাত্র।
মজার ঘটনাটা হল, যখন ভোট শেষে শুনতে পেলাম পথে বাক্স লুট হতে পারে এবং ভোটকর্মীদের জীবনসংশয়ও হতে পারে। সঙ্গের কনস্টেবল ভাইয়ের মুখ শুকিয়ে আমচুর। বললেন, “আমাকে রাইফেল-সহ দশ রাউন্ড গুলি ঠিকঠাক জমা দিতে হবে।” অর্থাৎ বন্দুক, গুলি সঙ্গে থাকবে, কিন্তু শূন্যেও গুলি চালানো যাবে না। তা হলে তাঁদের হাতে বন্দুক দেওয়ার প্রয়োজন কি? ভোট শেষে মধ্যরাতে বাড়ি পৌঁছলাম। অনেক পরিচিতকে ফোন করে জানলাম সব জায়গায় প্রায় একই ঘটনা।
প্রশাসনের কাছে একটাই প্রশ্ন— আমরা যাঁরা ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকি, তাঁদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কেন দায়িত্বপালন করতে হবে? কেন দলাদলির মাঝে আমাদের উলুখাগড়ার মতো পড়ে মরতে হবে? ভোটপর্বে কোন স্থান কতটা স্পর্শকাতর, সে সব সম্পর্কে প্রশাসনের কাছে পাকা তথ্য থাকা সত্ত্বেও কেন যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা হল না? কেন এমন প্রহসন হবে?
কেউ ভোট ডিউটিতে না গেলে তাঁর বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ভোট নিতে গিয়ে কোনও ভোটকর্মীর দল সমস্যায় পড়লে তাঁদের জন্য ব্যবস্থা করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। প্রশাসনের বোঝা উচিত, ব্যালট বাক্সের থেকে ভোটকর্মীদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। গণতন্ত্রের বৃহৎ উৎসবের নামে এমন প্রহসন বন্ধ হোক।
সুদীপ কুমার দাস, ইংরেজবাজার, মালদহ
ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্য
কিছু দিন পূর্বে কর্নাটকে বিধানসভা নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে সামান্য দলীয় পতাকা বা ফেস্টুন দেখা যায় না। অবশ্যই রাজনৈতিক প্রচার ছিল, কিন্তু জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়নি। কর্নাটকের নির্বাচনের দিন মানুষ অভ্যস্ত জীবন যাপন করেছেন। গণতন্ত্রের উৎসব চলেছে, সঙ্গোপনে মানুষ সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। অথচ, বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখে সারা দেশ হতভম্ব। কিছু বুথে সবাইকে চমকে দিয়ে সকাল আটটার মধ্যেই ১০০ শতাংশ ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে। জাল ব্যালট পেপারের অবাধ ব্যবহার না হলে এমন হতে পারে না। মনোনয়ন এবং ভোটগ্রহণ, এই দুটো পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তৃতীয় পর্যায়, অর্থাৎ স্ট্রংরুমেও যে দুর্নীতি হতে পারে, তা কিন্তু জনগণের চিন্তাভাবনার বাইরে। ধর্তব্যের বাইরে থাকা বিষয়গুলোকে চিন্তাভাবনার মধ্যে এনেছে দুষ্কৃতীরা।
গণতন্ত্রের সুফল পেতে গেলে কয়েকটা বিষয়ে শক্তিশালী হতে হয়। তার মধ্যে ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা অন্যতম। অর্থাৎ, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করা। এই তিনটি বিভাগের একে অপরের কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপের স্বাধীনতা নেই। কিন্তু বর্তমান গণতন্ত্রে সন্দেহ হয়, এদের মধ্যে সূক্ষ্ম হলেও একটা যোগাযোগ রয়েছে। যার ফলে গণতন্ত্রকে আহত হতে হচ্ছে।
প্রশ্ন হল, প্রশাসন, পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের এই ব্যর্থতার বিচার কে করবে? এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর এবং সুবিচারের কর্তাব্যক্তি কে? নির্বাচনকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করানোর ক্ষেত্রে আদালত বেশ কয়েকটা আদেশ দিয়েছিল। সেগুলো কার্যকর হল কই? তা হলে গণতন্ত্রের লুটেরাদের কাছে আদালতের রায়ও কি মিথ্যে? ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রের সেটাই কি ভবিতব্য?
বরুণ মণ্ডল, রানাঘাট, নদিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy