Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: মহাকাব্যের অনুবাদ

রামায়ণ নয়, মহাভারতের বঙ্গানুবাদে কোনও কোনও মুসলমান শাসক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

‘সমবায়ের ঐতিহ্য’ (৭-৯) শীর্ষক ভাষণে অমর্ত্য সেন বলেছেন: ‘‘রামায়ণ ও মহাভারতের সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু হয় বাংলার মুসলমান শাসকদের নির্দেশে, মোটামুটি চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ায়। মহাকাব্য দু’টির সেই অনুবাদগুলোই এখনও বাংলায় সর্বাধিক পঠিত।’’ তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হতে পারছি না।

প্রথমে রামায়ণের কথাই ধরা যাক। এই আদি মহাকাব্যের প্রথম অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝাই শ্রেষ্ঠ অনুবাদক। তাঁর অনূদিত ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ নামে সমধিক পরিচিত এবং বহুল পঠিত। তাঁর ‘আত্মবিবরণ’ থেকে জানা যায় তিনি গৌড়েশ্বরের সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। কে এই গৌড়েশ্বর? ইতিহাস দ্বিধান্বিত। কারও মতে হিন্দু রাজা গণেশ, কারও মতে রুকনুদ্দিন। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে, গণেশ হওয়ারই কথা। যা-ই হোক, কৃত্তিবাস সভাকবি ছিলেন না, কোনও রাজার পৃষ্ঠপোষকতা তিনি গ্রহণ করেননি। মা-বাবার আশীর্বাদে গুরুর কল্যাণে জনসাধারণের জন্য সাতকাণ্ড রামায়ণ অবলম্বনে তিনি ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ রচনা করেন।

রামায়ণ নয়, মহাভারতের বঙ্গানুবাদে কোনও কোনও মুসলমান শাসক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই কার্যে তাঁদের বিদ্যোৎসাহিতা ও উদারতার প্রকাশ ঘটেছে। যেমন, চট্টোগ্রামের শাসক লস্কর পরাগল খাঁ। তাঁর সভাকভি পরমেশ্বর। পরাগল খাঁর নির্দেশে তিনি মহাভারতের খুব সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেন। সময়ের বিচারে তিনিই প্রথম মহাভারতের অনুবাদক। কিন্তু অনুবাদ সরল হলেও কাব্যগুণের অভাবে মহাকাব্যের কোনও আস্বাদ তাঁর রচনা থেকে পাওয়া যায় না।

পরগল খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ (ছোট খাঁ?) চট্টগ্রামের শাসক হন। বাবার মতো তিনিও হিন্দুর কাব্যাদি শুনতে ভালবাসতেন। তাঁর সভাকবি ছিলেন শ্রীকর নন্দী। ছুটি খাঁর নির্দেশে তিনি বেদব্যাসের ‘মহাভারত’ পরিত্যাগ করে জৈমিনি নামে এক কবির মহাভারতের ‘অশ্বমেধ’ পর্বের অনুবাদ করেন যা সুখপাঠ্য হলেও জনবল্লভতা অর্জন করতে পারেনি।

রামায়ণের যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ অনুবাদক কৃত্তিবাস, তেমনই মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস। বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার সিঙ্গি গ্রামের এই কবির নাম কৃত্তিবাসের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে বাঙালির কাছে নিত্য স্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু হিন্দু বা মুসলিম কোনও শাসকের নির্দেশে নয়, কবি ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে মহাভারতের বঙ্গানুবাদ ‘ভারত পাঁচালী’ রচনায় প্রবৃত্ত হন তাঁর গুরু অভিরাম মুখোটির উপদেশে তথা তাঁর স্বীয় প্রতিকার প্রেরণায়।

উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল, শেওড়াফুলি, হুগলি

সতর্ক পদক্ষেপ

‘অনেকে বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক আখ্যা দিয়েছেন’’, এর উত্তরে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ‘‘নাস্তিক হলে কি চিঠির উপর নিয়মিত লিখতে পারতেন ‘শ্রীশ্রীহরিঃশরণম্’?’’ (‘বড় কাজ একাই করতে হয়’, ২৬-৯) শিক্ষাপ্রসার ও সমাজসংস্কারের মধ্য দিয়ে মানুষকে সামন্তযুগীয় কূপমণ্ডূকতা ও অন্ধতা থেকে মুক্ত করে আধুনিক মানুষে পরিণত করাই ছিল বিদ্যাসাগরের জীবনের লক্ষ্য। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন, সমাজে এই অন্ধকারের শক্তি কত গভীর! তাই তাঁকে প্রতিটি পদক্ষেপ করতে হয়েছে অতি সাবধানে। এমন কোনও হঠকারিতা করেননি, যাতে হিন্দু সমাজপতিরা বৃহত্তর সমাজ থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।

ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিনিধিরা ধর্মীয় এবং সামন্তী বন্ধন ভেঙে ফেলা সত্ত্বেও, উগ্রতার জন্য কী ভাবে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তা তিনি দেখেছিলেন। তাই সামাজিক আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। সমাজে মিশে থাকার প্রয়োজনে অহেতুক উগ্রতা পরিহার করেছেন। এই জন্যই তিনি পৈতা রেখেছেন, চিঠির উপর শ্রীশ্রীহরিঃশরণম্ লিখেছেন।

কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে, প্রতিটি আচার-আচরণে তিনি পুরোপুরি খাঁটি হিউম্যানিস্ট হিসাবেই থেকেছেন। কোনও ধর্মীয় আচার পালনের দিকে যাননি। এমনকি কাশীতে গিয়ে বিশ্বেশ্বর মন্দিরেও যাননি। বিদ্যাসাগর দেখালেন, ধর্মকে বাদ দিয়েও উন্নত সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে উঠতে পারে এবং সমাজে আজ এই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। একজন বলিষ্ঠ সেকুলার হিউম্যানিস্ট হিসাবে বিদ্যাসাগর মনে করতেন, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় এবং ধর্মবিশ্বাসীর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর আঘাত করা উচিত নয়। কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে, সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক মূল্যবোধের আর কোনও প্রয়োজন নেই। বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস প্রসঙ্গে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য বলেছিলেন, বিদ্যাসাগর ‘নাস্তিক’ ছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ওই এক রকমের নাস্তিক ছিলেন, যাকে বলে অজ্ঞেয়বাদী। নিজে নিজে বলেছেন, ধর্ম যে কী, তাহা মনুষ্যের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোনও প্রয়োজন নাই।

বিদ্যাসাগর নিজে ধর্মবিশ্বাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন কিন্তু তাঁর মধ্যে ধর্মবিদ্বেষ ছিল না। ব্রাহ্ম, খ্রিস্টান, মুসলমান নির্বিশেষে সকলকেই মানুষ হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদা তিনি দিতেন। সেকুলার মানবতাবাদীদের এইটিই নীতি। শিবনাথ শাস্ত্রী ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম হয়ে গেলেও বিদ্যাসাগরের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি। মাইকেল খ্রিস্টান হয়ে গেলেও তা-ই। রামমোহন ধর্ম সংস্কারের মধ্য দিয়েই সংস্কারমুক্ত একটা জীবনচর্চা প্রতিষ্ঠা করার, ধর্মের কাঠামোর মধ্যেই যত দূর সম্ভব বিচারমূলক যুক্তিবাদ ও মানবকেন্দ্রিক মূল্যবোধ আনার চেষ্টা করেছিলেন। রামমোহন বেদান্তের শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করে তার ভিত্তিতেই ধর্মসংস্কার করতে চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় মূল্যবোধকে বাদ দেননি। বিদ্যাসাগর চিন্তাক্ষেত্রে এই জায়গায় ছেদ ঘটালেন। তিনি বললেন, সাংখ্য বেদান্ত দর্শন হিসাবে ভ্রান্ত। এইখানেই রেনেসাঁসের পরিমণ্ডলের মধ্যে একটা গুণগত পরিবর্তন আনলেন বিদ্যাসাগর। সত্য সম্পর্কে যুক্তিবাদী ধারণা প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। তাই তিনি জন স্টুয়ার্ট মিল এর লজিক পড়াতে বলেছিলেন। মিল ছিলেন মূলত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। সংস্কৃত কলেজে ছাত্রদের মিলের লজিক পড়ানো এবং পাশ্চাত্যের অধ্যাত্মবাদী বিশপ বার্কলের দর্শন না পড়ানোর জন্য সুপারিশ করার মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগর নিজের চিন্তা ও ভাবধারার একটি বিশেষ পরিচয় রেখেছেন। দ্বিশতজন্মবর্ষে তাকে স্মরণ করতে গিয়ে তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি যেন আমরা ভুলে না যাই।

সমরেন্দ্র প্রতিহার, কলকাতা- ৪

স্বচ্ছ ভারত?

‘মৃত্যুর ধারাবিবরণী’ (২৭-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে এই চিঠি। ভারতের উন্নয়নের ‘সাফল্য-কথা’য় অনেক নতুন সংযোজনের মধ্যে ‘প্রকাশ্য মলত্যাগ মুক্ত এলাকা’ একটা। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই এই প্রহসন চলছে এবং দুদ্দাড় করে এই ঘোষণা করা হছে। হিসাব করলে হয়তো দেখা যাবে, যে-বিরাট অঙ্কের টাকা সরকারি কর্তাব্যক্তিদের পরিবহণে আর আপ্যায়নে খরচ হয় তা দিয়ে আরও কিছু শৌচাগার তৈরি হয়ে যেত।

এ দেশে ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’র তো দেখা নেই-ই, উল্টে অতি ধনীদের কর ছাড় দেয়া হল। তার একটা অংশ দিয়ে অথবা সেলেব্রিটিদের গ্রাম দত্তক দিয়ে এ কাজ করা যেত। মনে রাখা দরকার, ‘চন্দ্রযান’-এর যেমন প্রযোজন আছে, তেমনই ব্যবহারযোগ্য শৌচাগারেরও। ২০২২ সালের মধ্যে প্রতি ঘরে নলবাহিত জল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে, আর শৌচাগার থাকবে না?

মধ্যপ্রদেশের যে গ্রামে দুটি ছেলে মেয়েকে পথের ধারে মলত্যাগ করার অপরাধে উচ্চবর্ণেরা পিটিয়ে মেরেছে, সে গ্রামেও ওই ঘোষণা হয়েছে শুধু নয়, তাদের পরিবারের বরাদ্দকৃত টাকা পঞ্চায়েত প্রধান দেননি। দেশকে ‘দুর্নীতিমুক্ত’ না করলে দেশ ‘স্বচ্ছ’ হবে কি?

তপোময় ঘোষ, শিবলুন, পূর্ব বর্ধমান

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

অন্য বিষয়গুলি:

Amartya Sen Religion Ramayana Mahabharata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy