অ্যাম্বুল্যান্স ছিল না তাই পাঁচ মাসের সন্তানের মৃতদেহ ব্যাগে ভরে বাসে পাঁচ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছেছেন বাবা। ফাইল ছবি।
‘অ্যাম্বুল্যান্স মিলল না, ব্যাগে সন্তানের দেহ’ (১৫-৫) শীর্ষক সংবাদে জানলাম, পাঁচ মাসের সন্তানের মৃতদেহ ব্যাগে ভরে বাসে পাঁচ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছেছেন বাবা। যে কারণগুলি জানা যাচ্ছে, সেগুলি হল— ১) পুরসভা এলাকা নয় বলে, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শববাহী গাড়ির ব্যবস্থা নেই। ২) মৃত রোগীর দেহ বাড়িতে ফেরানোর ব্যাপারে রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা সম্পর্কে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট ধারণা নেই। ৩) উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ থেকে কালিয়াগঞ্জের মুস্তাফানগরের ডাঙিপাড়ায় যেতে আট হাজার টাকা দর হেঁকেছিল অ্যাম্বুল্যান্স সিন্ডিকেট। ৪) সদ্য সন্তান হারানো বাবা যথাযথ জায়গায় দরবার করেননি।
অর্থাৎ, প্রশাসন ঘটনার দায় মৃতের বাবার অজ্ঞানতার উপর চাপিয়ে দেয়। শোকার্ত, দরিদ্র বাবাকে আবেদনপত্র লিখতে বলে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়ার নিদান দেয়। দলীয় রাজনীতি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, এর আগে কবে কোন দলের শাসনে এ রকম ঘটনা ঘটেছিল, তার নথিপত্র খুঁজে বার করতে। এই যে, আমরা সম্মিলিত ভাবে অপমানের বোধটাই হারিয়ে ফেললাম, পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম— এটা শুধু এটুকুই বোঝায় যে, রাষ্ট্র আর সমাজ দু’তরফেই আমরা ব্যর্থ। আমরা সভাঘরে বিতর্ক করতে জানি, কিন্তু এক জন সন্তানহারা পিতার কাছে জনপরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা অপরিমিত দর হাঁকলে তার মোকাবিলা করতে জানি না। কারণ, এমন নানা কু-বন্দোবস্তের সঙ্গে সহাবস্থানে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
রাষ্ট্র নিজে এগিয়ে এসে নাগরিকের প্রয়োজন বুঝতে চাইবে, এই প্রত্যাশাটা আমরা নিজেদের কাছেই আর করতে পারি না। শিশু সুরক্ষা কমিশন, রোগী কল্যাণ সমিতি এই সমস্ত বন্দোবস্ত কেন কাজে লাগল না, সে প্রশ্ন উঠছে না। বরং প্রশ্ন উঠছে, আর কী-ই বা করার ছিল? স্বজন-বন্ধু-প্রতিবেশীরা শোকসন্তপ্ত বাবার সঙ্গে থাকবেন, এই সাধারণ চেনাটাও কেমন অবাস্তব হয়ে উঠেছে। পেটের টানে বিভুঁইয়ে কাজ করা বাবা তাঁর সমাজ হারিয়েছেন। ফলে, ঘর-বাড়ি, পাড়া, পঞ্চায়েত সব আছে, কিন্তু পাঁচ মাসের শিশুটি মারা গিয়ে প্রমাণ করল, এগুলো কিছুই আর বেঁচে নেই।
শবদেহ ঢাকার জন্য সেই সাদা কাপড়ের জোগানদার মানুষটিকে খুঁজছি। কোভিডের সময়ে ওই চূড়ান্ত অব্যবস্থার মধ্যেও যিনি যত্ন করে সাদা কাপড় দিয়ে শবদেহ ঢেকে দিতেন।
রত্নাবলী রায়, কলকাতা-২৯
নিখরচার নমুনা
কালিয়াগঞ্জের অসীম দেবশর্মা তাঁর মৃত সন্তানকে ব্যাগে ভরে শিলিগুড়ি থেকে কালিয়াগঞ্জে ফিরেছেন— তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ একে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি পরিবারের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছেও পৌঁছে গিয়েছে এই প্রকল্পের নামাঙ্কিত ইলেকট্রনিক কার্ডটি। আক্ষেপের বিষয়, সরকারি হাসপাতালে ওই কার্ডটির কোনও উপযোগিতা নেই, কারণ দামি ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নগদ টাকায় কিনে দিতে হয় সরকারি হাসপাতালেও। অসীমবাবু সাংবাদিককে জানিয়েছেন, তিনি পরিযায়ী শ্রমিক এবং তাঁর সন্তানের চিকিৎসা করানোর জন্য তাঁর কাছে থাকা ১৬,০০০ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। মনে রাখতে হবে, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও তাঁর নগদ অর্থ খরচ করতে হয়েছে। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য পরিষেবায় সবটাই নিখরচায় মেলে, কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেও স্বাস্থ্যসাথী কার্ড কার্যত হাতির দাঁতের মতো, থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাজে লাগে না। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর নির্ভর করে, পরিষেবা দেওয়া হবে কি না।
মৃত রোগীর ক্ষেত্রে অ্যাম্বুল্যান্সে পরিবহণের বেলায় স্বাস্থ্যসাথী কার্ড কোনও কাজেই আসে না। একমাত্র ‘মাতৃযান’ ছাড়া অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবায় ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’। অসীম দেবশর্মার পরিবারের কাছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ছিল কি না জানি না, থাকলেও তাঁকে মৃত সন্তানকে ব্যাগে ভরে শিলিগুড়ি থেকে কালিয়াগঞ্জে ফিরতেই হত। পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা পরিষেবার উন্নয়ন অনুভব করতে হলে হাসপাতালগুলির নবনির্মিত সুদৃশ্য বহুতলগুলি দেখেই বিমোহিত হয়ে থাকতে হবে। জয়কৃষ্ণ দেওয়ান, অসীম দেবশর্মা— এঁদেরকে ভুলে যেতে হবে।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
সহায়তা কেন্দ্র
‘অ্যাম্বুল্যান্স অমিল, ব্যাগে পুত্রের দেহ’ খবরটি পড়ে বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে ধারণার ফোলানো বেলুনটি চুপসে গেল। এমন অমানবিক ঘটনা আগেও ঘটেছে এ রাজ্যে। প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ করে থাকলে নতুন করে এখন কালিয়াগঞ্জের মোস্তাফানগর পঞ্চায়েতের ডাঙিপাড়ার বাসিন্দা অসীম দেবশর্মার ঘটনা ঘটে কী করে? হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা কি থাকার কথা নয়? প্রান্তিক বহু পরিবার দূর দূর গ্রাম, জেলা থেকে উন্নত চিকিৎসা নিতে আসেন শহরের বড় হাসপাতালে। যে কোনও হাসপাতালে মৃত রোগীর বাড়ির লোকজনদের জন্য একটি সহায়তা কেন্দ্র থাকাটাই তো সুষ্ঠু প্রশাসনের নিদর্শন। সেখানে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া বেঁধে দিলে সমস্যার সমাধান হতে পারে সহজে।
হাসপাতাল চত্বরে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যারা আট হাজার টাকা চেয়েছেন শিশুহারা বাবার কাছে, তাঁরা তাঁদের এই ব্যবসা চালান কী করে? তাঁদের উপর প্রশাসনিক কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই কেন? হাসপাতালের সুপারও তো দেখবেন, তাঁর হাসপাতালের সব রকমের পরিষেবা জনগণ পাচ্ছেন কি না! রাজনীতি নিয়ে যে রাজসূয় যজ্ঞ চলে, যে খরচের বহর দেখা যায়, তা দিয়ে মানবিক অনেক কাজ করা যায়। উন্নয়ন তো পরিষেবার অঙ্কেই মাপা উচিত। হাসপাতালে যথাযথ সহায়তার ব্যবস্থা যাতে জনগণ পায়, তার একটা বন্দোবস্ত সরকারি তরফে থাকুক। যথোচিত মূল্যের বিনিময়ে রোগী, বা মৃত রোগীর স্বজনদের জন্য পরিবহণের এমন একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকার কথা সরকার ভাবলে তা অনেক বেশি মানবিক হবে।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
কৌশলী
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সুপার বলেছেন, তাঁদের শববাহী গাড়ি নেই! হাসপাতাল থাকলে রোগী মৃত্যু হবেই। মৃতদেহ বহনের জন্য সরকারি হাসপাতালের নিজস্ব কিছু গাড়ি কেন থাকবে না? কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলোর বাইরেও বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স, শববাহী গাড়ির রমরমা চলে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকার যেখানে সুপার স্পেশালিটি তকমা দিচ্ছে, বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের ঢাক পেটাচ্ছে, সেখানে নিজস্ব শববাহী গাড়ি কেন কিনছে না? অজুহাত শুনতে হচ্ছে, অ্যাম্বুল্যান্স মৃতদেহ বহনের জন্য নয়! অথচ অনেক সময়ই অ্যাম্বুল্যান্সই সদ্যমৃতদের বাড়ি অবধি পৌঁছে দেয়।
আরও খারাপ লাগল এক প্রথম সারির তৃণমূল নেতা যখন বললেন যে, শিশুর বাবার হাতে মোবাইল থাকার পরও উনি কেন কোনও লোক, আত্মীয়দের সাহায্য পেলেন না। এই নেতারা হয়তো ভুলে গিয়েছেন যে, হতদরিদ্র এই বাবার আত্মীয়, পরিজন থাকলেও তাঁদের অবস্থাও হয়তো শিশুর বাবারই মতো। অত টাকা দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করার মতো ক্ষমতা হয়তো তাঁদেরও ছিল না।
শাসক দলের মতে, দুয়ারে সব পরিষেবা পৌঁছে যাচ্ছে। তা হলে হাসপাতাল থেকে একটি মৃত শিশুকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যেত না? অনুরোধ করব, কৌশলী হওয়ার চেষ্টা না করে, জানা অসুখগুলো দ্রুত সারানোর চেষ্টা করা হোক।
অরিত্র মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামপুর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy