—ফাইল চিত্র।
‘প্রতিনিধির সন্ধান’ (১৬-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে স্বাতী ভট্টাচার্য প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের কিছু সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল যে ভাবনাকে ভিত্তি করে, তা আজ ভূলুণ্ঠিত। ফি-বছর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দিয়েই আমরা তা টের পাচ্ছি। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের যে মৌলিক ভাবনাকে ভিত্তি করে মানুষ নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল, সেই ধারণা— মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য, মানুষের সরকার (বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অব দ্য পিপল) আজ কার্যত জাদুঘরের সামগ্রীতে পরিণত। যেখানে লোকসভার ৮৭ শতাংশ সাংসদ কোটিপতি (যাঁদের গড় সম্পত্তি ২১ কোটি টাকা), সেখানে এটা কি আশা করা যায় যে, তাঁরা সংসদে আমজনতার কথা তুলে ধরবেন? আর এখন নির্বাচনকে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাতে তো কোটিপতিদেরই জেতার কথা। যেন তেন প্রকারেণ জেতার লক্ষ্য নিয়ে যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তারা কোটিপতিদেরই প্রার্থী নির্বাচিত করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তাই ভোটের প্রচারে জনতার কথা থাকে, নেতাদের বক্তৃতায় ও দলীয় ইস্তাহারে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি থাকে। কিন্তু ওই পর্যন্তই! যাঁরা প্রতিশ্রুতি দেন এবং যাঁদের জন্য দেন, তাঁরা সকলেই জানেন, এগুলো সব ‘জুমলা’— নেহাতই কথার কথা।
প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন যে, সমাজের নীচের তলার মানুষ, যাঁরা দেশের আশি শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁদের জীবনের সমস্যার কথা বড় বড় দল ও নেতাদের ভাবনায় থাকে না। তাঁদের জীবনের সমস্যার সমাধান একমাত্ৰ লড়াই করেই আদায় করতে হয়। নির্বাচন যেন একটা প্রহসনমাত্র। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পাল্টাতে পারলেও মানুষের জীবনের সমস্যার সমাধান হয় না। তা যদি হত, তা হলে বিগত ৭২ বছর ধরে যে নির্বাচন হয়ে আসছে, তাতে আমরা অন্য এক ভারতের চেহারা দেখতে পেতাম। নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরে আজ এটা বুঝতে কি অসুবিধা হওয়ার কথা যে, যাঁরা সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনে লড়াই করেন, তাঁদের প্রত্যেকের দলীয় তহবিল ভরে দেন মালিকরা! কেন? কারণ, এটা এক ধরনের বিনিয়োগ। তা হলে কি আমজনতার জীবনে কোনও পথ নেই? আছে, একটাই পথ আছে। তা হল সংগ্রামের পথ। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষ যতটুকু অধিকার অর্জন করেছে, তা কেবল লড়াইয়ের পথেই অর্জিত হয়েছে। এই সহজ সত্যটা বুঝতে যত দেরি হবে, ততই বিলম্বিত হবে মানুষের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি।
সুব্রত গৌড়ী, কলকাতা-১২
জরুরি কথা
যে মানুষরা খেত-খামার, চা-বাগান, চটকল, ইটভাটায় উদয়াস্ত দিনমজুরি করেন, যাঁরা বিড়ি, জরির কাজ করেন, কিংবা পাঁচ বাড়ি দৌড়ে-বেড়ানো ‘কাজের লোক’, আনাজ বিক্রেতা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী, বা মিড-ডে মিল কর্মী, তাঁদের কথা শোনার কেউ নেই। অথচ, এঁদের বলার কথা অজস্র। প্রত্যেকটিই জরুরি কথা। শোষণ-বঞ্চনার, অত্যাচার-অবিচারের কাহিনি। এ সব তাঁদের নিজেদেরই বলতে হবে, শোনাতে হবে। তা না হলে তাঁরা কেবল শাসক দলের ভোটব্যাঙ্ক হয়ে থেকে যাবেন। ৫০০-১০০০ টাকার ‘বেনিফিশিয়ারি’ বা সুবিধাভোগী হয়ে, অধিকারভোগী হয়ে নয়।
কেন একই কাজে ছেলে ও মেয়ের মজুরির এত তফাত, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্রেফ অর্ধেক? কেন যথেষ্ট শৃঙ্খলা, দক্ষতা, দায়িত্ববোধের সঙ্গে কাজ করেও মেয়েরা চিরকালের কম পয়সার ‘শিক্ষানবিশ’? কখনও শুনেছেন চটকলে মেয়ে সুপারভাইজ়ার-এর কথা? তাঁরা তো অধিকাংশ স্থায়ী কাজই পান না। শুনেছেন কোনও মেয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন? ‘হেল্পার’-এর কাজ করে তাঁরা জীবন কাটান। খাবার দোকানের মতো কিছু ব্যবসা ছাড়া মেয়েরা কতগুলি স্বাধীন ব্যবসায় মূল দায়িত্বে রয়েছেন? আজন্ম এত বৈষম্যের মাঝে থেকে মেয়েরা স্বাধীন ভাবে নিজেদের কথা বলবেন কী করে?
তবে স্বাতী ভট্টাচার্য বলেছেন, জনগোষ্ঠী প্রতিনিধি বা নেতা তৈরি করেন না, নেতাই নিজস্ব জনগোষ্ঠী তৈরি করেন। এখানে বলার আছে। এই প্রক্রিয়াটি পরস্পরের পরিপূরক— দু’জনই দু’জনকে তৈরি করেন। নেতা হয়ে ওঠার প্রস্তুতি পর্বে এক জন নানা সমস্যার সঙ্কটে আগে এসে সামনে দাঁড়ান, মানুষকে জড়ো করেন। মানুষ তখন জড়তা কাটিয়ে এগিয়ে আসেন, প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। মানুষ জয়ের মুখ দেখেন, বা তার খুব কাছে পৌঁছে যান। আবার, নেতার সব জোরই তো এই সম্মিলিত জনশক্তির। না হলে নেতা কোথায়? সমস্যা হয়, যখন গোষ্ঠী তার নেতা নির্বাচন করেই দায় সারে। ভাবে, এ বার নেতাই সব করে দেবেন।
শিবপ্রসাদ দাস, আন্দুল মৌরি, হাওড়া
বৈষম্য-বিশ্ব
‘প্রতিনিধির সন্ধান’ শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই বলা হয়েছে, কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মেয়েরা ভারতের বৃহত্তম নির্বাচকমণ্ডলী। তাঁদের শ্রমশক্তির চূড়ান্ত শোষণ চলছেই। ভারতে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সঙ্কট রয়েই গেছে। আজও শ্রমজীবী মেয়েদের ভোটব্যাঙ্ক গড়ে তুলতে পারেনি এ-দেশের রাজনীতি। কিন্তু প্রশ্ন, এই সঙ্কট কি শুধুই ভারতে, না কি বিশ্ব জুড়ে একই অবস্থা? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-র গ্লোবাল রিপোর্ট বলছে— শুধু ভারতে নয়, বিশ্বে পুরুষের তুলনায় নারীরা গড়ে ২০ শতাংশ কম মজুরি পান। মজুরি বৈষম্য ভারতের সব রাজ্যেই কম বেশি প্রকট। আশ্চর্য যে, এ দেশে এগিয়ে থাকা রাজ্য কেরলেও বঞ্চনা চলে। সেখানে পুরুষ-শ্রমিক দৈনিক মজুরি পান ৮৪২ টাকা, মহিলারা পান ৪৩৪ টাকা। কেন এই বৈষম্য, স্পষ্ট নয়।
একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, নারী ঘরে-বাইরে পুরুষদের তুলনায় বেশি শ্রম দেন। প্রশ্ন হল, তা হলে মেয়েদের উপেক্ষা করে মালিকরা পুরুষ-শ্রমিক নিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কেন? আর রাজনীতিতে ‘প্রতিনিধির সন্ধান’ ব্যাপারটাও একটা ধোঁয়াশা তৈরি করছে। নারী নিজে কেন প্রতিনিধিত্বের অধিকার অর্জনে সমর্থ হচ্ছেন না, এর উত্তরও খুঁজতে হবে।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
বিচ্ছিন্ন প্রার্থী
‘প্রতিনিধির সন্ধান’ রাজনীতিতে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব বিশ্লেষণ করেছে। কেউ বলতে পারেন, বহু মহিলা পঞ্চায়েত, সংসদ, বিধানসভার সদস্য, তা হলে কেন মহিলা প্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? পঞ্চায়েতের মহিলা সদস্যদের অনেকের পিছনে তাঁদের স্বামী, অথবা বাড়ির অন্য পুরুষ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ আছে। যে মহিলা নিজে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, বা পারলেও তাঁকে তা করতে দেওয়া হয় না, প্রতিবাদ করলে পরিবার থেকে চাপ আসে, তিনি কী করে অন্য মহিলাদের জন্য কাজ করতে পারবেন! আবার, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মহিলাদের প্রতিনিধি হয়ে বিধানসভা বা সংসদে যাচ্ছেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, এমনও দেখা যায়। সেই প্রার্থী কতটা জানেন ওই এলাকার মহিলাদের জীবনযাপন সম্পর্কে? মেয়েরা কত কষ্ট করে হয়তো দু’মাইল দূর নদী থেকে বালি সরিয়ে পানীয় জল নিয়ে আসেন, কাঠকুটো জোগাড় করে জ্বালানির ব্যবস্থা করেন। শুধু এক দিন এলাকায় কারও বাড়িতে ভাত খেলেই তাঁদের দৈনন্দিন সংগ্রাম বোঝা যায় না। ন্যূনতম মজুরিও পান না শ্রমজীবী মেয়েরা। কর্মক্ষেত্রে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক সময় সমঝোতা করতে হয়, এমনকি নিজের দেহটি পর্যন্ত নিজের অধিকারে থাকে না।
এর সমাধান হল— নিজেদের মধ্যে থেকেই নিজেদের প্রতিনিধি খুঁজে নিতে হবে মেয়েদের। কর্মক্ষেত্রে নিজে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বাবা-স্বামীর চাপ দূর করতে হবে। তবেই প্রকৃত মহিলা প্রতিনিধি হয়ে ওঠা যাবে।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy