—প্রতীকী ছবি।
ঈশানী দত্ত রায়ের ‘আমাদের আমল কবে আসবে’ (২৯-৭) প্রবন্ধটি সময়োপযোগী। লেখক এমন কিছু কঠোর বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যেগুলি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিপন্থী। সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রায় ৫৭টি মৃত্যু ঘটেছে। জয়ী প্রার্থীরা শপথ নিয়ে গ্রামোন্নয়নের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। কিন্তু এই নির্বাচনে কি জনগণের ভোটাধিকার সত্যিই প্রতিফলিত হল? না কি বাইকবাহিনীর অস্ত্রশক্তির, আর পেশি সঞ্চালনের প্রভাবে, তাদেরই ইচ্ছামতো প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হয়েছে? এমন নির্বাচন কি কাঙ্ক্ষিত ছিল? আর একটি অশুভ প্রবণতা গণতন্ত্রের তথাকথিত ধারক-বাহকদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তা হল, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির উপভোক্তাদের প্রাপ্তিকে ‘দয়ার দান’ বলে দেখানো। নেতারা অর্থহীন, নির্লজ্জ আস্ফালন করছেন যে, তাঁরাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি তাঁদেরই কাছে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা মূল্যহীন। এ তো ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর! প্রবন্ধকার কিছু উদাহরণ দিয়েছেন যা থেকে বোঝা যায়, সর্বস্তরের নেতাদের ক্ষমতার আকাশচুম্বী দম্ভের প্রভাবে গণতন্ত্রের মূল শর্তগুলি ভূলুণ্ঠিত। এ এক অশনিসঙ্কেত!
মণিপুরের জনগোষ্ঠীগুলির উপর অকথ্য নির্যাতনের কথা এবং রাষ্ট্রশক্তির নিন্দনীয় শৈথিল্য প্রদর্শন আইনের শাসনের উপর অনাস্থা তৈরি করছে। দুর্ভাগ্য, মহিলাদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে লাঞ্ছনা করার মধ্যযুগীয় বর্বরতা! এ ধরনের ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টাও সমান ভাবে নিন্দনীয়। যে রাজ্যেই এমন ঘটনা হোক না কেন, রাষ্ট্রশক্তি তাকে কড়া হাতে দমন করবে, এটাই বাঞ্ছনীয়। এ ধরনের ঘটনার ভয়াবহতা বা গুরুত্বের তুলনা করে দায় এড়ানোর চেষ্টা অবশ্যই হাস্যকর এবং অযৌক্তিক। স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও গণতন্ত্রের মূল্যবোধ দেখা যাচ্ছে না বাস্তবের অলিন্দে।
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি
চেয়ার সরবে
যুবা বয়সে সিনেমার পর্দায় নায়কের হাতে খলনায়ককে পর্যদুস্ত হতে দেখে করতালি দিয়ে উঠতাম। ঈশানী দত্ত রায়ের ‘আমাদের আমল কবে আসবে’ লেখাটি পড়ে ঠিক তেমন অনুভূতি হল। বছর কয়েক আগে ভোট চাইতে এসে, রাজনৈতিক সুবিধাভোগী, হাওয়া-মোরগ এক নেতার লেজুড়-বাহিনীর মধ্যে থেকে জনৈক অনুগামী আমাকে বলেছিল, “দাদা, এ বার অন্তত ভোটটা আমাদের দিয়ো।” অর্থাৎ, আমি তাদের দলকে ভোট দিই না! অন্তর্দৃষ্টির এমন অলৌকিক শক্তি তারা কোথা থেকে পেল, ভেবে অবাক হয়েছিলাম। বহু অভিযোগে বিদ্ধ হয়ে, নিজের দলের কূটনৈতিক চালে পরাভূত হয়েছেন একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই নেতা, রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা এখন নামমাত্র, কেবলই এক জন জনপ্রতিনিধি। ফলে, বর্তমানে তাঁর অনুগামী সংখ্যা কার্যত শূন্য। প্রবন্ধে উল্লিখিত ‘একটা চেয়ার সরতে সময় লাগে না’ (সেটা যে কারণেই হোক) কথাটি যথার্থ।
ভাবতে অবাক লাগে কৃষি, শিল্প, পরিষেবা ও অন্য ক্ষেত্রগুলোতে দিনরাত মেহনতে সম্পদ সৃষ্টিকারীদের জন্য সরকার যা দিয়েছে তা হল ভিড়ে-ঠাসা লোকাল ট্রেন, বাদুড়ঝোলা বাস, রেশনের মোটা চাল, আর্সেনিক-যুক্ত জল, বিশেষ ক্ষেত্রে যৎসামান্য মাসিক অনুদান ইত্যাদি। যাঁদের শ্রম ও করের (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) টাকায় দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরে, তাঁরা ধরে নিতে বাধ্য হন যে, এর বেশি আর কিছু পাওয়ার নেই নেতাদের থেকে। আর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জন্য বরাদ্দ বিমান, পাইলট কার, পরিশোধিত পানীয় জল, সার্কিট হাউস, পেনশন আরও কত কী!
বর্তমানে দেশে সাংসদ, বিধায়ক, পুর ও পঞ্চায়েতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সুরক্ষায় যে পরিমাণ সরকারি সুরক্ষাকর্মী নিয়োজিত আছেন, সেটা হয়তো বহু দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাকেও ছাপিয়ে যাবে। প্রশ্ন জাগে, জনসমর্থন লাভ করে জনপ্রতিনিধি হওয়া মানুষগুলো যদি নিজেদেরই অসুরক্ষিত মনে করেন, তাঁরা সাধারণ মানুষকে সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন কী ভাবে?
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
দম্ভের পরিণাম
‘আমাদের আমল কবে আসবে’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার বর্তমান রাজনীতির সারমর্ম তুলে ধরেছেন। মোগল যুগের আনারকলির সাহসিকতার কাহিনি আজ আমাদের এই গণতন্ত্রে ম্লান হয়ে গিয়েছে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিতা মেয়ের মায়েদের নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ বিফলে যায়।
আজকাল অভিযুক্তকে ধরার আগে ধর্ষিতাকেই ধরপাকড় করা হয়। ধর্ষকরা প্রমাণের অভাবে জামিনে মুক্তি পায়, ফুলের মালায় বিভূষিত হয়। নবম শ্রেণির ছাত্রী অসুস্থ হয়ে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে ঘরে ফিরছিল। দুষ্কৃতীরা উপযুক্ত সময় বুঝে তাকে ধর্ষণ করে খুন করল। দুই দল তার পরিবারকে নিয়ে টানাটানি শুরু করল, যেন এই সুযোগ, ফয়দা লুটে নিতে হবে। দরকারে ওদের পরিবারের এক জনকে ভোটে দাঁড় করিয়ে দাও, অবলীলায় জিতে যাবে। আমার দল, তোমার দল দিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা শুধু নির্ধারিত হয় তা নয়, সেই সংখ্যাটাকে পর্যন্ত কাটাকুটি করে দেওয়ার চেষ্টা থাকে।
‘যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক’ বাক্যটি একটা বাধ্যবাধকতা থেকে ব্যবহার করা হয় মাত্র। বিপক্ষকে আক্রমণ করার সূচনা হিসাবেও একটা মোক্ষম বাক্য হিসাবে ব্যবহার করে কাটাকুটির খেলা চলে। এই খেলা বন্ধ করতে সুপ্রিম কোর্টকে বলতে হয় মণিপুর-বঙ্গ তুলনা নয়, হাই কোর্টকে বলতে হয় বাড়ি ঘেরাও করা চলবে না। দুর্নীতি-দুষ্কর্ম আজ এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, এ ধরনের অভিযোগে বিদ্ধ নন, এমন ভুঁইফোঁড় নেতাকেও প্রণম্য ব্যক্তি মনে হয়, সমাজে, রাজনীতিতে তাঁর তেমন কিছু অবদান না থাকলেও।
‘আমি দিচ্ছি’ কথাটির মধ্যে যে অগণতান্ত্রিক মনোভাব পোষিত হয়, সে কথা কি নেতারা জানেন না? যারা মোটর সাইকেল দিয়ে ভয় দেখায়, ক্ষমতা বদল হলে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা ক্ষমতাসীন দলে ভিড়ে যায়। কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার দম্ভ মানায় না। যা মানায় না, কোনও কৌশলে তা দীর্ঘ দিন টেকার কথা নয়। তাই বুঝি ভারতের কোনায় কোনায় প্রতিবাদ জোরদার হচ্ছে। বিভাজনের রাজনীতি আজ ক্ষমতার উৎস, তা না বুঝে মানুষের উপায় নাই। এ সব অপকৌশল ব্যর্থ হবেই।
দুর্গেশ কুমার পাণ্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
এবং তসলিমা
ঈশানী দত্ত রায় আবার ‘মনোরমা’ নামে মেয়েটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। ইরম চানুর প্রতিস্পর্ধী মনোভাবের কথাও মনে করালেন। এরই পাশে মনে পড়ে গেল একটি মেয়ের কথা, যাঁকে বাম আমলে প্রায় এক কাপড়েই কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। নিজভূম ছেড়ে নির্বাসিত সেই মেয়ে, তসলিমা নাসরিন, আর ফেরেননি। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই সমাজে নারীর অবস্থানটিকে প্রত্যক্ষ করায়। তাই নারীদেহের নগ্ন প্রতিবাদ, কিংবা বর্বরোচিত ধর্ষণের পরেও সমাজে শুধুই পরস্পর বিরোধী মতামত তৈরি হয়। বসে থাকি পরের ঘটনার প্রতীক্ষায়। সমাজ বয়ে চলে। গণতন্ত্র ভেসে যায়।
জনগণের গণতন্ত্রে তাই জনগণের আমলই আসে না। খালি এই আমলের থেকে অতীত আমল কত দুর্বিষহ ছিল, সেই কুতর্ক চলে। সুবিধাবাদীরা প্রভাবশালীদের পা জড়িয়ে খোশমেজাজেই দিনযাপন করেন। বেকার সন্তানকে বাবা-মা বলতে থাকেন, “তুই একটা অপোগণ্ড। দেখছিস, ও পাড়ার পিন্টু পার্টিবাজি করে কেমন নিজেকে গুছিয়ে নিল।” সমাজও ঠিক এই ভাবেই একটু একটু করে শুকিয়ে যায়। শুধুমাত্র বেড়ে ওঠে রাজনৈতিক বৃক্ষটিকে জড়িয়ে ধরে থাকা আগাছার দল।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy