Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ভাল ছবি ক’টা হয়?

এক বার এই অর্বাচীন পত্রলেখক তাঁকে ‘তিরস্কার’ করেছিল ‘থার্ড গ্রেড কমার্শিয়াল’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য।

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২০ ০১:৪৯
Share
Save

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালি জীবনে একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে কলেজের দিনগুলিতে এই কিংবদন্তির কাছ থেকে তাঁর স্বহস্তে লেখা একাধিক চিঠি প্রাপ্তির সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

এক বার এই অর্বাচীন পত্রলেখক তাঁকে ‘তিরস্কার’ করেছিল ‘থার্ড গ্রেড কমার্শিয়াল’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য। বিনীত ভাবে তিনি লিখেছিলেন, “আপনার চিঠির শেষে আপনি আমাকে থার্ড গ্রেড কমার্শিয়াল ফিল্মে অংশ না নিতে যে অনুরোধ করেছেন সে বিষয়ে আমার একটু বক্তব্য আছে। আপনারা আমাকে পছন্দ করেন, আমার থেকে সুঅভিনয় প্রত্যাশা করেন বলেই এ অনুরোধ করেছেন তা আমি বুঝি। কিন্তু একটু যদি ভেবে দেখেন যে পৃথিবীতে কোনও দেশে, কোনও কালে, পেশাদার অভিনেতা শুধুমাত্র ভাল ছবি, ভাল নাটকে অভিনয় করে বেঁচে থাকতে পারেন না, তাহলে আমার খারাপ ছবিতে অভিনয় করার কারণটা বুঝতে পারবেন। ভাল ছবি ক’টা হয়? সে ক’টাতে সবাই যে আমাকে ডাকবেন তার স্থিরতা কী? এবং সে ক’টা কাজ করে আমার পক্ষে জীবনধারণ করা সম্ভব নয়, পেশাতে টিকে থাকাও সম্ভব নয়। আশা করি পরনির্ভর শিল্প অভিনয়ের শিল্পী অভিনেতাদের অসহায় অবস্থাটা বুঝবেন। এবং এত বাজে ছবির ভিড়েও আমি যতটা চেষ্টা করে, ত্যাগ স্বীকার করে, যতগুলি স্মরণযোগ্য ছবিতে অভিনয় করেছি, তার সংখ্যা যে কোনও অভিনেতার থেকেই বেশি তা মনে করে আমাকে ক্ষমার চোখে দেখবেন।”

কাজল চট্টোপাধ্যায়, সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

স্বাধীন চিন্তা

সময়টা ২০০৭ সালের নভেম্বর। রাজ্য উত্তাল সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম কাণ্ড নিয়ে। ‘কৃষি বনাম শিল্প’ বিতর্কে রাজ্যের বেশির ভাগ কবি, লেখক, মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের শিল্পীরা তৎকালীন রাজ্য সরকারের বিরোধিতায় সংবাদপত্রে লিখছেন, রাজপথে মিছিল করছেন। মুষ্টিমেয় মেধাজীবী ব্যতিক্রম ছিলেন, যাঁরা তৎকালীন রাজ্য সরকারের কাজের সমর্থক ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি ছিল তাঁদের আস্থা। এঁদের মধ্যে দু’টি নাম উল্লেখযোগ্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

আমি কৃষিজমি বলপূর্বক অধিগ্রহণ করে সেই জমিতে শিল্প স্থাপনের বিরোধী ছিলাম। তাই হতাশ হয়েছিলাম, রাগ হয়েছিল অতি প্রিয় এই দুই মানুষের প্রতি। এক দিন ক্ষোভে ফোনই করে ফেললাম সৌমিত্রবাবুকে। আমার উষ্মা মন দিয়ে শুনলেন। তার পর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানালেন অননুকরণীয় কণ্ঠে— ‘‘আমি চিন্তার স্বাধীনতায় আস্থা রাখি। আপনি একটি ঘটনায় এক রকম ভাবতে পারেন, আমি অন্য রকম ভাবতেই পারি। এটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। রাজ্য সরকারের শিল্পনীতিতে স্বল্প মেয়াদে স্বল্প সংখ্যক মানুষের অসুবিধা বা কষ্ট হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ কালের হিসেবে বেশির ভাগ মানুষেরই উপকার হবে। এটা আমার মত।” এর পর অনেক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। গড্ডলিকা প্রবাহে না-ভেসে যাওয়া সৌমিত্রবাবুর কথাগুলি আজ মনে পড়ছে। ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ ও ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ’- এর বড্ড দৈন্য এই দুর্ভাগা দেশে। অসুবিধাজনক অবস্থানেও নিজের বোধে আস্থা রাখা ও নিজ চিন্তায় স্থিত মানুষের বড় অভাব। সৌমিত্র পরবর্তী কালে বর্তমান রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান না করে সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কেবল উঁচু দরের শিল্পীই নয়, মানুষ হিসেবেও অনেক উঁচুতে তাঁর স্থান।

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

শেষযাত্রায় উত্তম

‘শেষ নাহি যে... বিদায়ে মেলালেন সৌমিত্র’ (১৬-১১) দেখে মনে পড়ছে আশির দশকে মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যু। আজকের মতো সে দিন কিন্তু দলমত নির্বিশেষে সবাই মহানায়কের মৃত্যুতে পাশে দাঁড়াননি। উত্তমকুমারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে ছিল না কোনও সরকারি ব্যবস্থাপনা। তৎকালীন বাম সরকার তাঁকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করা তো দূর, রীতিমতো উপেক্ষা করেছে। এক জন মহান শিল্পীর যে সম্মান প্রাপ্য ছিল, তার ছিটেফোঁটাও সে দিন সরকারি ভাবে দেখা যায়নি। রবীন্দ্র সদনে তাঁর মরদেহ পর্যন্ত রাখতে দেওয়া হয়নি।

রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

শালবনিতে

‘ধরা থাক বসন্তের স্মৃতি’ (মেদিনীপুর সংস্করণ, ১৬-১১) প্রসঙ্গে বলতে চাই, বসন্ত বিলাপ ছবির শুটিং মেদিনীপুর শহরে হলেও, এতে যে ফুটব্রিজ থেকে অনুরাধা (অপর্ণা সেন) নেমে শ্যামকে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) দেখে, তা মেদিনীপুর নয়, শালবনি স্টেশনের ফুটব্রিজ ছিল। এই ফুটব্রিজ থেকেই শেষ দৃশ্যে রবি ঘোষ, অনুপ কুমার, চিন্ময় রায়-সহ অন্যরা নেমেছিলেন। যে রিকশাতে শ্যাম স্টেশনে এসেছিল, সেটি ভৈরব নামে এক রিকশাচালক শালবনির রাস্তায় চালিয়েছিলেন। আমার বয়স তখন আট কি নয়।

প্রদীপ মহাপাত্র, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

সার্থক বাঙালি

এক সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আগে যদি আমায় কেউ জিজ্ঞেস করত, আপনি বাইরে গেলে কী নিয়ে যান? বলতাম গীতবিতান আর মহাভারত। এখন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে তো বলি, গীতবিতান আর আবোল তাবোল।” এই গভীর জীবনদর্শনের তল পাওয়া এখনকার কেরিয়ার-সর্বস্ব, সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ বাঙালির পক্ষে সম্ভব কি? তাঁর মতো কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা সযত্নে বাংলা ও বাঙালিয়ানা বজায় রেখেছিলেন। এঁরা চলে গেলে কেমন একটা অস্তিত্বের সঙ্কট কাজ করে।

দেবলীনা ঘোষ, কলকাতা-৭৯

ক্ষিদ্দা

যে সময়ে সিনেমা জগতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব, তখন বাংলা সিনেমার মাথার উপর প্রতিভাত উত্তমকুমার। এ ছাড়াও রয়েছেন কমল মিত্র, পাহাড়ী সান্যাল, ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কালজয়ী অভিনেতারা। সেই সময়েও বাঙালি দর্শকের নজর আলাদা করে কেড়েছিলেন সৌমিত্র। যাঁকে বাঙালি দর্শক চিনেছিল দেবী, সমাপ্তি-র মতো ছবির নায়ক হিসেবে, তপন সিংহের ঝিন্দের বন্দী-তে তিনিই হয়ে উঠলেন ময়ূরবাহন। যার রূপ ছিল যত চোখ ঝলসানো, ভিতরটা ছিল ততটাই ক্রূর। সত্যজিৎ রায় তাঁকে ফেলুদার চরিত্র দিলেন, আর বাঙালি পেল নতুন ফ্যাশন, পাঞ্জাবির সঙ্গে প্যান্ট। ১৯৮৪-তে মুক্তি পেল কোনি। তনুজাকে দেখে রাস্তায় টুইস্ট নাচা তরুণ তখন মধ্যবয়সি ক্ষিদ্দা, সাঁতার শেখাচ্ছেন বস্তির মেয়ে কোনিকে, দিচ্ছেন জীবনযুদ্ধে ট্রেনিং। ছবির শেষ কয়েক মিনিটে তরোয়ালের মতো ঝলসে উঠেছিল সৌমিত্রের প্রতিভা।

সুকমল দালাল, খণ্ডঘোষ, পূর্ব বর্ধমান

তাঁর হাত

সালটা ২০১৮। শনিবারের দুপুরে অ্যাকাডেমিতে একটা নাটক দেখে হল থেকে বেরোচ্ছি। দেখতে পেলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আমাদের আশৈশবের নায়ক ‘ফেলুদা’-কে। যত দূর মনে পড়ে, পর দিন ফেরা-র শো ছিল। যথারীতি তাঁকে ঘিরে ভিড়। উনি প্রেক্ষাগৃহের দিকে আসছিলেন, আমি ভিড় দেখে বেরোতে না পেরে এক পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। উনি যাওয়ার মুহূর্তে হাতজোড় করে নমস্কার করতে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিলেন, আলতো ছুঁয়ে গিয়েছিলেন কাঁধটা! সামান্য ঘটনা, কিন্তু আমি আপ্লুত। পরে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি ফেরা-র অভিনয়। দেখা হয়নি লিয়র, আর হবেও না।

অরিত্র মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামপুর, হুগলি

Soumitra Chatterjee Death

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}