বয়স্কদের চিকিৎসার ভার বহন করা রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব। ফাইল চিত্র।
সোনালী দত্তের ‘বয়স বাড়ার দেশে কয়েকটি প্রশ্ন’ (১১-২) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলতে চাই, প্রবীণদের অনুকূলে রাষ্ট্রের আইন বা প্রকল্প মোটেই যথেষ্ট নয়। যেমন— বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রের কোনও ‘পেরেন্ট কেয়ার লিভ’ নেই, যা নিয়ে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন। প্রবীণদের চিকিৎসার ব্যয় বর্তমানে অস্বাভাবিক চড়া, যা বহু সন্তানের সামর্থ্যের বাইরে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বয়স্কদের চিকিৎসার ভার বহন করা রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব। এ ব্যাপারে হাই কোর্টের অভিমত— প্রবীণ এবং অসুস্থ নাগরিকের যত্ন নিতে না-পারার দেশ আসলে অসভ্য— একেবারেই যথার্থ। তবে শুধু আইন করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্নেহ এমনই যে, সন্তানের দ্বারা নির্যাতিত হয়েও তাঁরা ছেলেমেয়েকে বাঁচিয়ে চলেন। সেই সুযোগ অনেক সন্তান গ্রহণও করে। তেমনই, শারীরিক ও মানসিক ভাবে তাঁরা অশক্ত হওয়ায় আইনের দীর্ঘ লড়াই অনেকের পক্ষে অসম্ভব। তা ছাড়া, আইনের আশ্রয় এক বার নিলে সম্পর্কের ফাটল ক্রমশ চওড়া হতে থাকবে। সন্তানদের অসহযোগিতামূলক আচরণ তাঁদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে, আইনের দ্বারা যার সুরাহা অসম্ভব।
প্রাণীদের সন্তানের প্রতি স্নেহমমতা প্রকৃতিরই অভিপ্রায়। নইলে জগৎ-সংসারে প্রাণ বাঁচে না। বিপরীতক্রমে তা হওয়ার কথা হয়তো নয়, কিন্তু মানুষ তো অন্যান্য প্রাণীর মতো নয়। তার বোধশক্তি থাকার কথা, সংসারে প্রত্যেক সদস্যের মানুষের মতো বেঁচে থাকার কথা। অথচ, বৃদ্ধদের কথা সে ভাবে ভাবা হয় না। সেই জন্য হয়তো নীতিকথায় বা মহাপুরুষদের বচনে থাকে ‘পিতা-মাতা গুরুজনদের শ্রদ্ধাভক্তি করবে’। ‘সন্তানকে স্নেহ করবে’— এটা বলার প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেননি, হয়তো প্রাকৃতিক নিয়ম বলে।
সমাজে-সংসারে প্রবীণদের গুরুত্ব বা মান্যতা দেওয়ার নামই হল শ্রদ্ধাভক্তি। অবশ্য এতে প্রবীণদেরও শ্রদ্ধাভক্তি অর্জনে সহযোগিতা থাকা দরকার। ‘নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাইয়ে বড় করেছি, ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় তাদের মানুষ করেছি’— এ সব কোনও বাহাদুরির কথা নয়। সব প্রাণীই তা-ই করে প্রকৃতির নিয়মের বশবর্তী হয়ে। তাই আমাদের সন্তানকে মানুষ করার সময় শুধু সিলেবাসের শিক্ষায় আবদ্ধ থাকলে চলবে না। তাদের নীতিশিক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে, নিজেদেরই দীক্ষিত জীবনযাপন দিয়ে।
দুর্গেশকুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
পরিকল্পনা নেই
সোনালী দত্তের প্রবন্ধটি বয়স্ক নাগরিকদের দেখাশোনার বিষয়ে কিছু অতি প্রয়োজনীয়, অথচ অপ্রিয় প্রশ্ন তুলে ধরেছে। সংবাদ ও সমাজমাধ্যমে প্রতিনিয়ত দেখা মেলে সন্তান-পরিত্যক্ত বাবা-মায়েদের, যেন পথঘাট ও স্টেশনে ফেলে আসা পানীয়ের বোতলের মতো। লেখকের মতে, তথাকথিত আধুনিক সমাজে গৃহপালিত পশুপাখির চেয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অধিক দুর্দশাগ্ৰস্ত। ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের প্রতি পাঁচ জন নাগরিকের মধ্যে এক জন ষাটোর্ধ্ব হয়ে বার্ধক্য ছুঁয়ে ফেলবেন। তাই সামান্য কিছু ভাতা বা ব্যাঙ্কে সঞ্চয়ের উপর একটু বেশি সুদ বরাদ্দ করার বাইরেও এই প্রবীণ নাগরিকদের কথা এখনই ভাবা দরকার রাষ্ট্রের। শুধুমাত্র সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা দিয়ে অশক্ত শরীর ও মনের অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। বিপুল সংখ্যক বয়স্ক নাগরিকের সামাজিক ও আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য সমাজসেবী সংস্থাগুলিও প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।
সম্প্রতি স্কুলগুলিতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিধান কর্মসূচির সফল রূপায়ণে বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। খুবই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, সন্দেহ নেই। অথচ, অপত্যস্নেহ ও শ্রম উজাড় করে যাঁরা আজ বৃদ্ধ হয়েছেন, তাঁদের জন্য ‘জেরিয়াট্রিক কাউন্সেলিং ও রিহ্যাবিলিটেশন’-এর কোনও উদ্যোগ আজ অবধি পঞ্চায়েত বা পুরসভা স্তরে নজরে এল না। সকলেরই অনুভব করা উচিত, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সমাজের দায় নন, দায়িত্ব। প্রয়োজনে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মানসিক সাহচর্য, পরিবেশগত ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সহায়তা নিশ্চিত করা দরকার। লেখকের সঙ্গে সহমত হয়ে বলা যায়, সন্তানের অসুস্থতা বা পরীক্ষার জন্য সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মায়েরা যদি ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’ পেতে পারেন, তবে মা-বাবার জন্য নয় কেন? বৃদ্ধদের প্রতি সন্তান ও রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য এখনই জোরালো দাবি তুলতে হবে।
তন্ময় মণ্ডল, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
কর্তব্যের বোধ
‘বয়স বাড়ার দেশে কয়েকটি প্রশ্ন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। যে মানুষটি তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়ই সন্তানকে তৈরি করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন, সেই মানুষটি বৃদ্ধ বয়সে কেন অবহেলার শিকার হবেন? যে সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যায়, তাকে প্রকৃত মানুষ বলা যায় কি? বৃদ্ধ বয়সেই মানুষের দরকার সাহায্য। সরকার এই ব্যাপারে কতটা ভেবেছে? প্রবীণরা প্রয়োজনীয় সাহায্য না পেলে সেটা রাষ্ট্রের পক্ষে লজ্জার। আজকাল মানুষ যতটা অধিকার-সচেতন, ততটা কর্তব্য-সচেতন কি? বয়স্করা কেন সন্তানদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন? সর্বাগ্রে দরকার মূল্যবোধের শিক্ষা। এ ছাড়াও বয়স্কদের জন্য সরকারের সঠিক নীতি প্রণয়ন করা দরকার। তাঁদের ভাল রাখার উপরই সমাজের সুস্থতা অনেকটা নির্ভরশীল, এ কথা আমরা কবে বুঝব?
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
ইন্দির ঠাকরুন
অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লক্ষ করা যায় যে, এ দেশের পথে-প্রান্তরে অসংখ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অবহেলিত পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর জীবন যাপন করছেন। অথচ, খোঁজ নিলে দেখা যায়, অনেকের সন্তানেরই নিজস্ব ঘর-বাড়ি, সম্পদ সবই আছে। আজ তাঁরা পরিজনদের দ্বারাই বিতাড়িত। সোনালী দত্ত তাঁর প্রবন্ধে ঠিকই বলেছেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী-র ইন্দির ঠাকরুনদের সংখ্যা আজও বেড়ে চলেছে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় নিঃসঙ্গ মানুষদের শেষ দিনগুলি অতিবাহিত হওয়ার মর্মস্পর্শী দৃশ্য পৃথিবীর আর কোনও দেশে এত বেশি দেখা যায় কি না, জানা নেই। বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা যে রায় দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
অরবিন্দ মিত্র, কল্যাণী, নদিয়া
নির্ভয় বার্ধক্য
‘বয়স বাড়ার দেশে...’ প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন, গৃহপালিত পশুপ্রাণীর চেয়েও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অধিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। রেল শহরে বড় হয়েছিলাম। বাবার এক পরিচিত আধিকারিক অবসরের পর একই শহরে বিশাল আবাস নির্মাণ করে বাস করেন। ছেলেকে উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন, ছেলে আরও উচ্চপদে কলকাতায় নিযুক্ত, আরও বিশাল ফ্ল্যাটের অধিকারী। এ-হেন ছেলের কাছে বাবা এক মাসের জন্য থাকতে গিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে ফিরে এলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিচু স্বরে বললেন— তাঁর যাওয়ার জন্য ছেলের পালিত পোষ্যের থাকার ও শোয়ার অসুবিধা হচ্ছিল। তাঁর জন্য সন্তানের অসুবিধা হবে, এ এক প্রকারের আশঙ্কা। আর এক ভয় নিত্য পীড়া দেয় নিঃসন্তানদের, অথবা যাঁদের সন্তান দূর দেশে রয়েছে, তাঁদের। এই সমস্ত প্রবীণ নাগরিক নিত্য শারীরিক ও মানসিক শঙ্কায় দিন যাপন করছেন। আইনি সাহায্য ছাড়াও, এঁদের মানসিক শক্তি বাড়ানোর জন্য সরকারি সাহায্য প্রয়োজন মনে করি।
দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৬৩
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy