‘দেশভাগ ভুলিয়ে দিয়েছে এই সঙ্গীত-প্রতিভাকে’ (রবিবাসরীয়, ৩০-৫) বিস্মৃতপ্রায় সঙ্গীতজ্ঞ আবদুল আহাদকে তুলে ধরেছে। অংশুমান ভৌমিকের এই নিবন্ধে কয়েকটি তথ্যপ্রমাদ চোখে পড়ল। সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথমত, আবদুল আহাদের জন্ম ১৯২০ সালে নয়, তিনি জন্মেছেন ১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি। এ তথ্য জানিয়েছেন আবদুল আহাদের মাসি ও বোনের নামাঙ্কিত, ঢাকার ‘মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, হামিদা খানম স্মৃতি পরিষদ’-এর সম্পাদক নিশাত জাহান রানা। দ্বিতীয়ত, লেখকের ভাষায়, “বাইশে শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণসংবাদ শান্তিনিকেতনে এলে শোকার্ত শৈলজারঞ্জন আহাদের হাতেই ‘সমুখে শান্তিপারাবার’ গানটির স্বরলিপি তুলে দিয়ে বৈতালিক পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন।” তাই কি? তাঁর আত্মজীবনী আসা যাওয়ার পথের ধারে-তে আবদুল আহাদ স্বয়ং লিখছেন, “২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮, ৭ আগস্ট ১৮৪১ সাল। সেদিন কবিগুরুর মৃত্যুসংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছল, শৈলজাদা আমাদের ডেকে পাঠালেন নাট্যঘরে। খামের থেকে একটি কাগজও বের করলেন স্বরলিপি করা। এতদিন এই গানটির কথা কাউকে বলেননি। ‘ডাকঘর’ নাটকের জন্য কবিগুরু এই গানটি লিখেছিলেন, গানটি আমাদের শেখালেন। সেই বিখ্যাত গানটি— ‘সমুখে শান্তি পারাবার’। ঐদিন সন্ধ্যায় প্রার্থনা ঘরে সবাই মিলে আমরা গানটি গেয়েছিলাম।”
তৃতীয়ত, নিবন্ধে আছে, “১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১২৫তম বার্ষিকীতে যে বিরাট আয়োজন হয়, তার উদ্বোধক ছিলেন তিনি। মঞ্চে তাঁর পাশে বসেছিলেন সুফিয়া কামাল, সনজীদা খাতুন, রামেন্দু মজুমদার ও লাইসা আহমেদ লিসা।” আবদুল আহাদ ওই আয়োজনের (রবীন্দ্রসঙ্গীত মেলা) উদ্বোধক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর পাশে নিবন্ধে উল্লিখিত ব্যক্তিরা ছিলেন না। ছিলেন শান্তিনিকেতনের নীলিমা সেন, ওয়াহিদুল হক, হাসান আজিজুল হক, আলি আনোয়ার, সনৎকুমার সাহা, অমলেন্দু গঙ্গোপাধ্যায় (ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি), শিবানী চট্টোপাধ্যায় (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়) প্রমুখ। কিশোরী লিসার ওই মঞ্চে থাকার কথাও নয়। তিন দিনের ওই আয়োজন হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ২৯-৩১ জানুয়ারি। এই সব তথ্যই পাওয়া যাবে মেলায় প্রকাশিত স্মারক পুস্তিকায় এবং ১৯৮৮ সালের গোড়ায় প্রকাশিত নাজিম মাহমুদ সম্পাদিত চিরনূতনের ডাক স্মারক গ্রন্থে। শেষোক্তটি ওই মেলার বিস্তৃত ডকুমেন্টেশন। দুটোর কোনওটিতেই উক্ত তিন জনের নাম নেই। এই মেলার প্রাণপুরুষ ছিলেন নাজিম মাহমুদ। আমিও ওই মেলায় উপস্থিত ছিলাম, সেই মহতী আয়োজনের উত্তাপ অনুভব করেছিলাম।
সুশীল সাহা, হৃদয়পুর, উত্তর ২৪ পরগনা
সুরকার আহাদ
আবদুল আহাদ শুধু সুচিত্রা মিত্রের (তখন মুখোপাধ্যায়) প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডের প্রশিক্ষকই ছিলেন না, তিনি সুচিত্রার প্রথম বাংলা আধুনিক গানের রেকর্ডে সুরও দিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের মার্চে প্রকাশিত সেই রেকর্ডে (জিই ২৮৯৬) আহাদের সুরে সুচিত্রা গেয়েছিলেন তাঁর পিতা, সাহিত্যসেবী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘তোমায় আমায় ক্ষণেক দেখা’ এবং ‘ফিরে তুমি আসবে না’। রেকর্ডে নাম ছিল কুমারী সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়।
স্বপন সোম, কলকাতা-৩৭
পথিকৃৎ
বাঙালির ঘরে ঘরে সঙ্গীতের প্রবেশ ঘটানোর ক্ষেত্রে যাঁরা যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিলেন, সুরস্রষ্টা আবদুল আহাদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে ছিলেন সুরকার, প্রশিক্ষক, সংগঠক ও গায়ক। এ দেশে রবীন্দ্রনাথের গান প্রচার ও চর্চায় তিনিই প্রথম উদ্যোগী হন। শুধু তা-ই নয়, তিনি আধুনিক ও দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের প্রধান পথিকৃৎ। ছাত্রাবস্থায় কলকাতায় অবস্থান কালে তিনি সঙ্গীত জগতের দিকপাল সুধীরলাল চক্রবর্তী, আব্বাস উদ্দিন প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। স্কুলে বন্ধুদের নিয়ে প্রতি দিন টিফিনের সময় আবদুল আহাদ গানের আসর বসাতেন। এই গানের আসরে তিনি ও হীরেন ভাদুড়ি গান গাইতেন আর বেঞ্চের উপরে বসে তবলা বাজাতেন রাধিকামোহন। ধীরে ধীরে স্কুলে তাঁদের গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে হাফিজের একটি ফারসি গজল ‘দোশ দিদামকে মালায়ে দাও মায়ে খাজা জাদানদ’ গেয়েছিলেন আবদুল আহাদ ও হীরেন ভাদুড়ি। গানের সুর দু’বন্ধু মিলে প্রচলিত গজলের সুরে ঠিক করে নিয়েছিলেন। তাঁদের পরিবেশিত এই গজল ওই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত অনুরাগীদের বিপুল প্রশংসা লাভ করে। ১৯৩৬ সালে অল বেঙ্গল মিউজ়িক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে আবদুল আহাদ তৎকালীন সঙ্গীত জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে শিক্ষা নিয়েছিলেন, যখন শান্তিদেব ঘোষ ও শৈলজানন্দ মজুমদার ছিলেন তাঁর শিক্ষক। শিক্ষা জীবনে আহাদ বৈতালিক ও মন্দির সঙ্গীতের পরিবেশনে বেশির ভাগ সময়ে দায়িত্বে থেকেছেন। তখন শ্যামা, চণ্ডালিকা, তাসের দেশ প্রভৃতি নাটকের মহড়া চলত উত্তরায়ণে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে। এই সময় কবিগুরুর সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয় আবদুল আহাদের। তাঁর সুরারোপিত প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড এইচএমভি থেকে বার করেন সন্তোষ সেনগুপ্ত।
গান-বাজনার প্রতি আবদুল আহাদের আকৃষ্ট হওয়ার মূলে ছিলেন তাঁর মামা। মামার প্রভাবেই তিনি সঙ্গীত জগতে বিচরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাড়িতে ব্যবহারের জন্যে মামা একটি অর্গান কিনেছিলেন। পাশাপাশি বাড়িতে ছিল আঙুরবালা ও ইন্দুবালার অজস্র গ্রামোফোন রেকর্ড। অবসর সময়ে সেই গান শুনে, মামার অর্গান বাজিয়ে, তাঁর স্বপ্নের জীবনের জন্য নিজেকে ধাপে ধাপে তৈরি করেছিলেন আবদুল আহাদ। যদিও তাঁর বাবার তেমন ইচ্ছা ছিল না যে, তিনি গানবাজনা শিখে গায়ক হবেন। তাঁর মা তাঁর এই ইচ্ছায় সহমত প্রকাশ করেছিলেন। আর সেই আশীর্বাদই হয়তো তাঁর পরবর্তী কালে এক জন প্রথিতযশা শিল্পী হওয়ার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। গত বছর নীরবে এই সঙ্গীত-প্রতিভার শতবর্ষ পেরিয়ে গেল, এটা বড়ই আক্ষেপের কথা। অংশুমান ভৌমিক যথার্থই বলেছেন, তাঁর অবদান স্থায়ী স্বীকৃতি দাবি করে।
উৎপল মুখোপাধ্যায়, চন্দননগর, হুগলি
ছবির গান
আবদুল আহাদ সম্পর্কে অংশুমান ভৌমিকের প্রতিবেদনটি অনেক পুরনো স্মৃতি জাগিয়ে তুলল। এই প্রসঙ্গে কিছু সংযোজন করতে চাই। ১৯৪৪ সাল, বিখ্যাত চিত্র পরিচালক বিমল রায় পরিচালিত জ্যোতির্ময় রায় লিখিত উপন্যাস উদয়ের পথে অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবি মুক্তি পেল। নবাগত রাধামোহন ভট্টাচার্য ও বিনতা রায় অভিনীত এই ব্যতিক্রমী ছায়াছবি প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশ পত্রিকায় ছবিটির উপসংহারে পঙ্কজ দত্ত লিখলেন, “একটি ভাল ছবি দেখে বাড়ি ফিরলাম।” ছবিটিতে একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশিত হয়। ‘ওই মালতীলতা দোলে’, ‘বসন্তে ফুল গাঁথল’, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ ইত্যাদি। এই গানের রেকর্ডিংয়ের সময় বিমল রায় তাঁর সহকারী অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়কে আবদুল আহাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নির্দেশ দেন। বস্তুত, গানগুলি তাঁরই নির্দেশনায় গৃহীত হয়। এইচএমভি-র পুরনো ৭৮ আরপিএম রেকর্ডে আবদুল আহাদের নামোল্লেখ আছে।
সিতাংশু শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা-৯৭
রাজশাহীর মেলা
অংশুমান ভৌমিকের লেখায় ১৯৮৬ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত তিন দিনের রবীন্দ্রসঙ্গীত মেলার উল্লেখ দেখে স্মৃতিকাতর হলাম। ওই মেলায় দত্তপুকুরের ‘ময়ূখ’ সাংস্কৃতিক সংস্থা আমন্ত্রিত হয়েছিল, ২৫ জনের একটি দল যোগ দিয়েছিল। আমিও সেই দলে ছিলাম। বর্ষীয়ান শিল্পী আবদুল আহাদ ওই মেলার উদ্বোধন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মঞ্চে লেখক-উল্লিখিত কাউকেই দেখিনি। অন্য অনেকের সঙ্গে নীলিমা সেন ও ওয়াহিদুল হক অবশ্যই ছিলেন।
গৌতমবরণ অধিকারী, কলকাতা-৬৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy