পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘যে রক্তে বাঙালিয়ানা নেই’ (১৪-৪) প্রবন্ধের প্রতিবাদে এই পত্র। সাধারণ বাঙালি পরিবারে মহাপুরুষদের যে সব ছবি দেখে বড় হয়েছি, তার মধ্যে ছিল দেশের প্রথম তিন জন রাষ্ট্রপতি, প্রথম দুই প্রধানমন্ত্রী এবং গাঁধীজি ও নেতাজির ছবি। এই ছবিতে নেতাজি ছাড়া কোনও বাঙালি নেই। এমন পোস্টার, ক্যালেন্ডার তখন বাঙালি দেওয়ালে টাঙাত। এঁদের ক’জন বাঙালি, তার বিচার বা ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব তখনও বাঙালির উঠোনে আসেনি। কিন্তু তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা যখন মহা উৎসাহে জাতীয় সঙ্গীত ‘বন্দে মাতরম্’-এর শতবর্ষ, স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার শতবর্ষ, ভগিনী নিবেদিতার ১২৫তম এবং ১৫০তম জন্মজয়ন্তী, নেতাজি শতবর্ষ পালন করে, বা তাদের প্রতি দিনের চর্চায় বাঙালি মনীষার লালন-পালন করে, বাংলার সংবাদমাধ্যম তা প্রচার করে না।
রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির প্রকাশন বিভাগ ‘সেবিকা প্রকাশন’ ২০০৩ এবং ২০০৫ সালে স্মরণীয়-বরণীয় বাঙালি মহিলাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী, বরণীয়াদের পদপ্রান্তে ও বঙ্গ নারীর চরিত্ কোষ নামে দু’টি বই প্রকাশ করেছিল। একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনও বাংলা কাগজ তা পড়ে দেখার আগ্রহ দেখায়নি। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তার সূচিপত্র দেখেই আন্দাজ করতে পারবেন, সেখানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেত্রীরাও বাদ পড়েননি। পার্থবাবু লিখেছেন, “কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস বৃত্তে আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, লীলা মজুমদারের নাম কেউ শোনেনি, শুনলেও পাত্তা দেয়নি।” এই লেখিকাদের জীবনীও স্বমহিমায় সেখানে জ্বলজ্বল করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের জীবনী অগ্নিযুগের বঙ্গ ললনা-ও আমাদের আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা।
পার্থবাবু লিখেছেন, “আরএসএস শাখায় জাতীয় পতাকা ওড়ে না। ওড়ে শিবাজির ভগোয়া ঝান্ডা।” রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি সনাতন গৈরিক ধ্বজকে সাংস্কৃতিক ধ্বজ মনে করে, গুরুরূপে মানে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে সসম্মানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি আমরা। যে কোনও সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন সারা বছর তার নিজস্ব পতাকা ওড়ায়, আমরাও ব্যতিক্রম নই। একটা ঘটনা দেখানো যায় কি, যেখানে জাতীয় পতাকার অবমাননা হয়েছে?
শিবানী চট্টোপাধ্যায়
রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি
শ্যামাপ্রসাদ
মোহিত রায় ‘বাঙালির বিস্মৃত নেতা ফিরলেন’ (২১-৪) নিবন্ধে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রসঙ্গে লিখেছেন, “পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন তিনি।” ঐতিহাসিক তথ্য বলে, অরাজনৈতিক শ্যামাপ্রসাদ রাজনীতিতে এসেছিলেন দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে নয়। বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের কথায়— বাংলায় তখন শ্যামাপ্রসাদের সামনে দু’টি লক্ষ্য— কংগ্রেসের মোকাবিলা করা এবং মুসলিম লীগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইতে হিন্দুদের নেতৃত্ব দেওয়া। অর্থাৎ, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা নয়, তাঁর নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ শাসকের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করেছিল। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময়ে শ্যামাপ্রসাদ অর্থমন্ত্রী হিসেবে এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে একে দমনের জন্য ২৬ জুলাই, ১৯৪২ সালে গভর্নর হারবার্টকে এক লম্বা চিঠি লিখেছিলেন। আবার যখন অধিকাংশ প্রথম সারির কংগ্রেস নেতা জেলবন্দি, তখন গোপনে বড়লাটের সঙ্গে দেখা করে হিন্দু মহাসভাকে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করতে দেওয়ার অনুরোধ জানান ও প্রত্যাখ্যাত হন।
প্রবন্ধ লেখক ঠিকই ধরেছেন যে, শ্যামাপ্রসাদ রাজনৈতিক হিন্দু না হয়ে যদি এক জন স্রেফ হিন্দু ধর্মীয় নেতা হতেন, তা হলে সমস্যা হত না। আসলে বাঙালি ধর্ম এবং দেশপ্রেম দুটোকেই গ্রহণ করেছিল, ভোটসর্বস্ব, বিভেদকামী রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে পরিহার করে।
প্রত্যুষ দত্ত
গল্ফ গ্রিন, কলকাতা
ইতিহাসে
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের যে মূল্যায়ন করেছেন মোহিত রায়, তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তিনি সখেদে মন্তব্য করেছেন, “বাংলার ইতিহাসে শ্যামাপ্রসাদ অস্পৃশ্য।” এই প্রসঙ্গে জানাতে চাই যে, রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশের ইতিহাস (চতুর্থ খণ্ড) গ্রন্থে শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবনের যে মূল্যায়ন করেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, কৃষক প্রজা দলের “ফজলুল হক মন্ত্রীসভায় নয়জন মন্ত্রীর মধ্যে চারিজন হিন্দু ছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে ছিলেন হিন্দুমহাসভার প্রসিদ্ধ নেতা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি অর্থ দপ্তরের ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন।... নবগঠিত মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদেরই প্রাধান্য ছিল। এই কারণেই অপরপক্ষ বলিত, ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদের হাতের মুঠোয় ছিলেন।... চিত্তরঞ্জন ও সুভাষচন্দ্রের পরেই তখন বাংলার রাজনীতিতে তাঁহার (শ্যামাপ্রসাদের) স্থান। তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনীতিক ছিলেন।... ফজলুল হকের নবগঠিত মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদের তুল্য বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনচেতা আর কোন মন্ত্রী ছিলেন না, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে।”
শ্যামাপ্রসাদ জানতেন যে, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে ব্রিটিশ সরকার তার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট থাকবে। সেই কারণে তিনি অপেক্ষাকৃত অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ফজলুল হকের আমন্ত্রণে মন্ত্রী পদ গ্রহণ করেন।
অন্নদাশঙ্কর রায় যুক্তবঙ্গের স্মৃতি গ্রন্থে শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “এ বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না যে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস নেতারা তাঁকে (শ্যামাপ্রসাদকে) রাতারাতি উপরে উঠতে দিতেন না। তবে পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে তাঁর যেমন যোগ্যতা, একবার কংগ্রেস টিকিটে আইনসভায় যেতে পারলেই তিনি নিজগুণে নিজের স্থান করে নিতেন। ... কিন্তু জেলে না গেলে কেউ কংগ্রেস নেতা হয় না। হিন্দুমহাসভাই সেদিক থেকে শ্রেয়।”
প্রসন্নকুমার কোলে
শ্রীরামপুর, হুগলি
পরিত্যক্ত
শ্যামাপ্রসাদ অস্পৃশ্য, বা বিস্মৃত নন। মুক্তচিন্তার বাঙালির মনে শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর রাজনীতি পরিত্যক্ত হয়েছে। অহেতুক চেষ্টা করে গলা ফাটালে সাময়িক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাঙালি রতন চেনে, সঠিক মূল্যায়ন করে শ্যামাপ্রসাদকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে।
শ্যামল দানা
কলকাতা-৯৪
ফেরার পথ
তপতী মুখোপাধ্যায়ের ‘কে আমার আপনজন’ (সম্পাদক সমীপেষু, ২৭-৪) পত্রের প্রেক্ষিতে বলি, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক দশক আগে। পত্রলেখক অত্যন্ত ব্যথাতুর হৃদয়ে সেই যৌথ পরিবার-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারগুলি ফিরে আসার জন্য তিনি যে মাধ্যমের উপর ভরসা করেছেন, তা বাস্তবোচিত নয়। টিভি সিরিয়ালে শুধুই দেখি বিবাহ-বহির্ভূত একাধিক সম্পর্কে জড়িত নায়ক কিংবা নায়িকা, খলনায়কের নিষ্ঠুর আস্ফালন, রাত বাড়তেই টেবিল সাজিয়ে মদ্যপানের আসর, সর্বোপরি প্রতিটি চরিত্র অত্যন্ত পরিপাটি হয়ে গৃহ পরিবেশেও টিভির পর্দায় উদ্ভাসিত— যা কোনও অর্থেই মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খায় না। আমিও চাই একান্নবর্তী পরিবার ফিরুক স্বমহিমায়, পরিবারের শিশু সদস্যদের নিঃসঙ্গতার অবসান ঘটুক। কিন্তু টিভি সিরিয়ালগুলির মাধ্যমে নয়, চিরাচরিত প্রথা মেনে সহমর্মিতার ভিত্তিতে।
রাজা বাগচি
গুপ্তিপাড়া, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy