রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বর্তমানে অচল হতে বসেছে। ফাইল ছবি।
অধ্যাপক সুগত মারজিতের প্রবন্ধটি (তলিয়ে যাওয়াই ভবিতব্য?, ৩-৩) সময়োচিত। তিনি উপযুক্ত তথ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রের স্বরূপটি। তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণে অভ্রান্ত ভাবে ধরা পড়েছে কী ভাবে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বর্তমানে অচল হতে বসেছে। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রশাসন দিনের পর দিন নতুন শিক্ষক নিয়োগের কাজ ফেলে রাখছে, উপেক্ষা করছে ছাত্রস্বার্থ। দৈনন্দিন পঠনপাঠন থেকে গবেষণা, সব কিছুই এর জন্য মার খাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা একটু ভাগ করে নিতে চাই।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কর্তৃপক্ষ-অনুমোদিত মোট শিক্ষক পদের সংখ্যা ১৫। বর্তমানে সেখানে রয়েছেন মাত্র ছ’জন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তে বাড়তে এখন প্রতি সিমেস্টারে ৪৫০ জনে পৌঁছেছে। এ ছাড়া রয়েছেন বিভাগে ৪০-৪৫ জন গবেষক, যাঁদের গবেষণা নির্দেশনায় রয়েছেন এই অধ্যাপকরা। এমতাবস্থায় অতিথি অধ্যাপক ছাড়া বিভাগের দৈনন্দিন পঠনপাঠন সম্পূর্ণ হচ্ছে না। এমন অচলাবস্থার সূচনা ২০১১ সাল থেকে। আজ এক যুগ হয়ে গেল, বিভাগে কোনও নতুন নিয়োগ নেই। নানা সময়ে বিভাগীয় প্রধানরা একাধিক বার হন্যে হয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন করেছেন, কিন্তু বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর কোনও অজ্ঞাত কারণে সব থিতিয়ে গিয়েছে। প্রশাসনের তরফে কোনও হেলদোল নেই। আর শুধু বাংলা বিভাগই বা কেন, অন্যান্য বিভাগেরও একই অবস্থা, যার পরিসংখ্যান সম্বলিত খবর প্রকাশিত হয়েছে কয়েক দিন আগে, দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায়। এ ভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে উচ্চশিক্ষা যে মুখ থুবড়ে পড়বে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং, সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দিক থেকে আশু পদক্ষেপ করে এই অচলাবস্থা দ্রুত কাটানো উচিত। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী, সকলেই সেই দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছেন।
সনৎকুমার নস্কর, কলকাতা-১৪৪
ব্যর্থ আন্দোলন
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী (এত রক্ত কেন?, ১৩-২) একটি জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন— “প্রযুক্তি শিল্পে যদি শ্রমিক সংগঠনের উপস্থিতি থাকত, তা হলে বিশ্ব জুড়ে গণছাঁটাইয়ের কবলে পড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্দশার মাত্রা কি খানিক কম হলেও হতে পারত না?” এর উত্তর একটু তলিয়ে ভাবা দরকার। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে যেটুকু সমাজতান্ত্রিক ভাবনাচিন্তা ছিল, তা আজ উধাও। বিগত তিরিশ বছরের ট্রেড ইউনিয়নগুলির ব্যর্থতার সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে খুঁজতে হবে, তাদের কর্মপদ্ধতিতে কোন পরিবর্তনটি জরুরি।
২০১৫ সালের জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল-এ প্রযুক্তি শিল্পে গণছাঁটাই প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে ইনফোসিস-এর প্রাক্তন সিইও এন আর নারায়ণ মূর্তি বলেছিলেন যে, কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার একমাত্র নির্ণায়ক মানদণ্ড হল কর্মদক্ষতা। প্রযুক্তি সংস্থার মালিক যদি খরচ কমানোর কথা বলেও কর্মীদের ছাঁটাইয়ের নোটিস ধরায়, তখনও কর্মীর কাজের ক্ষমতার বিচার হবে তাঁর সাম্প্রতিক অতীতের কাজের মানের উপর। তাই সর্বদা নিজের কর্মদক্ষতা আরও উন্নত করার চেষ্টা করা জরুরি।
গত প্রায় পনেরো-কুড়ি বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বহু ছেলেমেয়ে প্রযুক্তি শিল্পে কর্মরত, তাঁদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ‘হোয়াইট কলার’ কর্মী, যাঁদের প্রবন্ধকার ‘দক্ষ শ্রমিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। বেশির ভাগ কর্মী বলেছেন, তাঁদের ছাঁটাইয়ের কারণ ভিন্ন ভিন্ন, তাই তাঁরা কোনও দিনই সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে মালিকের সঙ্গে সমস্যার কথা বলতে যাননি। তাঁরা ‘ব্লু কলার’ কর্মীদের (যাঁরা অফিসে বসে কাজ না করে দৈহিক শ্রমের কাজ করেন) মতো কাজের নিরাপত্তা নিয়ে অতটা আতঙ্কিত নন। কোনও সংগঠনের ছত্রছায়ায় থাকতেই হবে, এমন ভাবেন না। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের কর্মদক্ষতাই তাঁদের কাজের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট। আবার, কায়িক শ্রম দান করেন যে কর্মীরা, তাঁরাও অনেকে কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন। অর্থাৎ, মালিকপক্ষ এবং চাকরিজীবী, উভয় পক্ষই কাজের মূল্যায়নের বিচারে একই ধারায় বিশ্বাসী। বিগত সত্তর বছরের একটা বিশ্বাস কী ভাবে পাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?
প্রযুক্তি শিল্পে বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছেন ৫০ লক্ষের মতো কর্মী। সেই শিল্পে গণছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও কর্মীরা কোনও সংগঠনের ছত্রছায়ায় আসতে চাইছেন না কেন? এ বিষয়ে ইনফোসিস-এর প্রাক্তন সিএফও এবং মানব সম্পদ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান টি ভি মোহনদাস পাই বলেছিলেন যে, প্রযুক্তি শিল্পে ইউনিয়ন করার জায়গা নেই। ইউনিয়ন হল সেই কর্মীদের জন্য, যাঁরা সর্বদা কাজের নিরাপত্তা খোঁজেন, যাঁরা একই সংস্থায় দীর্ঘ দিন কাজ করে যেতে চান। প্রযুক্তি শিল্পে কর্মীরা প্রতিনিয়ত বেতন কম-বেশির উপর ভিত্তি করে নিজের ইচ্ছামতো এক সংস্থা থেকে অন্য সংস্থায় আসা-যাওয়া করেন। কাজের অনন্ত সুযোগ, তাই এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
কোনও চাপ ছাড়াই, কর্মীদের কাজ ছেড়ে দেওয়ার স্বাভাবিক হার যেখানে ১৮-২০%, সেখানে শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। তবে প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলি, তা সত্ত্বেও সংগঠনের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভাবাটা জরুরি। তা এই জন্য যে, প্রযুক্তি সংস্থার দিক থেকে খরচ কমানোর অজুহাত কতটা স্বচ্ছ, তা নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার কর্মীদের আছে। দীর্ঘ দিন কাজ করেন যে কর্মীরা, তাঁদের বর্ধিত হারে বেতন দিতে হবে বলেই ছাঁটাই হয় কি না, সে প্রশ্ন ওঠে। ‘এটাই এই পেশার সংস্কৃতি’, বলে কত দিন চলবে? এই পেশায় চাকরিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যে কর্মীদের মধ্যে আসা-যাওয়ার সংস্কৃতির বীজ বপন করে দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রথাটিকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানো জরুরি।
শুধু কি এই সংস্কৃতিই প্রযুক্তি শিল্পে শ্রম সংগঠনের প্রবেশ রোধ করছে? ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণের পর থেকে শ্রম-আন্দোলনের সাফল্য কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। পশ্চিমবঙ্গ গত শতকের সত্তরের দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ অবধি অবৈজ্ঞানিক এবং ধ্বংসাত্মক শ্রম-আন্দোলন দেখেছে। সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বদনাম। ভিন রাজ্যে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ছেলেমেয়েদের কম ভুগতে হয়নি। এর থেকেও প্রযুক্তি শিল্প কি শিক্ষা নেয়নি?
শুধুমাত্র নেতৃত্ব বজায় রাখার অছিলায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে টালবাহানা করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। এমনকি কোভিডের সময়ে দেখা গেল, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের পাশে এসে দাঁড়ানোর সুযোগ হেলায় হারাল শ্রমিক সংগঠনগুলি। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারতে দিনমজুর, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক এবং অনিয়মিত (ক্যাজুয়াল) কর্মীরা মোট কর্মীর ৬২ শতাংশ। তাঁদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে, লকডাউনের সময়ে তাঁদের অসহায় অবস্থায় খাদ্য, স্বাস্থ্য, আশ্রয় নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠনগুলি কোনও উদ্যোগই করল না।
এই মুহূর্তে অল্পশিক্ষিত কর্মীদের একটি বড় অংশ ‘গিগ ইকনমি’-তে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর কোনও সদিচ্ছাও দেখা যাচ্ছে না ট্রেড ইউনিয়নগুলির। অথচ, এই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়, মালিকরা তাঁদের প্রাপ্য থেকে কত ভাবে বঞ্চিত করছেন। ছাত্র-আন্দোলন থেকে শুরু করে শ্রম-আন্দোলন, সর্বত্র নেতৃত্ব বদল, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে কাজের পদ্ধতির বদল অত্যন্ত জরুরি। বিগত দশকে একমাত্র আশার আলো ২০২০-২১ সালের কৃষি বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাফল্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একটি সমীক্ষা বলছে, ১৯৯৩-৯৪ সালের তুলনায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা অনেক কমেছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা ২০ শতাংশেরও বেশি। তাই কী ভাবব, কাদের ভরসায় ভাবব, সেটাই ভাবাচ্ছে।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৭
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy