Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Gender Discrimination

সম্পাদক সমীপেষু: দ্বিচারিতা কত দিন?

এমনকি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে যে নারী যত নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে পরিবারের, পুরুষের প্রতি মমত্ব দেখিয়েছেন, তিনি ততই মহান হয়েছেন।

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৪১
Share: Save:

প্রহেলী ধর চৌধুরীর ‘নারী অধিকারের ঘরে-বাইরে’ (১৫-১১) শীর্ষক প্রবন্ধ কশাঘাত করেছে আমাদের ভণ্ডামির প্রতি। সংসার, সমাজে সেই মেয়েই বেশি প্রশংসিত হন, যিনি নিজের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, অধিকারবোধ সব বিসর্জন দিয়ে অন্যদের সুবিধা দেখেন, তাঁদের পরিচর্যা করেন। নারীর হেনস্থা শুরু হয় জন্মলগ্ন থেকে, একাধিক কন্যাসন্তান থাকা সত্ত্বেও নারী আবার গর্ভধারণ করেন পুত্রসন্তানের তাগিদে। তবে, সব সময় যে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির চাপে নারী গর্ভধারণ করেন, তা ঠিক নয়। অনেক সময় মেয়েরা নিজেরাই পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষায় বার বার গর্ভবতী হন স্ব ইচ্ছায়। তাই তো প্রায়ই সদ্যোজাত কন্যাসন্তানের স্থান হয় ঝোপে, নালা, নর্দমাতে। সন্তান না হলে পুত্রবধূকে ‘বাঁজা’ উপাধিতে কিন্তু আখ্যায়িত করেন শাশুড়ি-ননদ। এক বারও ভাবেন না নিজের বাড়ির ছেলেটিরও খামতি থাকতে পারে। আর কোনও পুরুষ যদি তাঁর স্ত্রীর সুখ-সুবিধা দেখতে যান, সমাজ তাকে ‘বৌ পাগলা’ বলে হাসির খোরাক করে। নববিবাহিত মেয়ে-জামাই সিনেমা দেখতে গেলে, তাদের জুটি লক্ষ্মী-নারায়ণ আর ছেলে-পুত্রবধূ গেলে— বেহায়া! আমরা পরের বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হলে মাথা ঘামাই না, শুধু নিজের বাড়ির মেয়েরা সুরক্ষিত থাক।

মোদ্দা কথা, নারী মানেই নিজের স্বার্থ না দেখে সব সময় পরের জন্য জীবনধারণ করা। এমনকি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে যে নারী যত নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে পরিবারের, পুরুষের প্রতি মমত্ব দেখিয়েছেন, তিনি ততই মহান হয়েছেন। যে মেয়ে নিজে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত, তিনিও কিন্তু বাপেরবাড়িতে ভোল পাল্টে ভ্রাতৃবধূকে অসম্মান করেন। ভাবেন না, নিজে নির্যাতিত হচ্ছেন, আর কাউকে তিনি নির্যাতনের শিকার হতে দেবেন না। এই দ্বিচারিতা যত দিন না দূর হবে, তত দিন নারীর অধিকার বৈঠকখানার গল্পগুজবের চেয়ে বেশি এগোবে না।

সর্বানী গুপ্ত

বড়জোড়া, বাঁকুড়া

মর্যাদা বেড়েছে

‘নারী অধিকারের ঘরে-বাইরে’ অসাধারণ এক সময়োপযোগী রচনা! তবে নারী অবদমনের ধারা আজও সমানে চলছে— এমন কথা খুব বেশি বলা যায় না। আজকের দিনে তাতে অনেক পরিবর্তন এসেছে! এখন আর ‘স্ত্রৈণ’ কথা দিয়ে কাউকে তিরবিদ্ধ করার প্রবণতাও অনেক কমে গেছে!

স্ত্রীর কথামতো স্বামী চলেন, আবার স্বামীর কথামতো স্ত্রীও চললে স্ত্রৈণ ও পতিব্রতা পাশাপাশি অবস্থান করবে— এ নিয়ে কারও কৌতূহল বা দ্বিমত নেই। তবে আমি মায়ের জন্য কাপড় কেচেছি, বাটনা বেটেছি, রান্নায় সাহায্য করেছি, আবার বিছানাও করে দিয়েছি। পাশাপাশি স্ত্রীর ক্ষেত্রেও ঘরকন্নার কাজে সাহায্য করা আমার অভ্যাস। আমাকে কেউ কিছু বলল কি বলল না, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। কিন্তু যাঁরা এক সময় আমাকে আমার স্ত্রীর কাপড় ধোয়া বা রোদে মেলা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন, তাঁরাই আবার পরবর্তী কালে সেই কাজটিই করতেন! এটাই স্বাভাবিক। কাজের পরিবেশের উপর নির্ভর করে কে স্ত্রৈণ, কে পতিব্রতা— সমাজ এ ব্যাপারে আর নাক গলায় না। এই যে এক ধরনের নীরব বিপ্লব— তাকে শুভ দিক হিসাবে দেখা উচিত। স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড পরিবারের অধিকর্তা স্ত্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর অধিকর্তাও স্ত্রী। স্ত্রীর প্রতি এই মর্যাদা আরও এগিয়ে দিয়েছে সমাজকে।

মানুষ সচেতন হলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব। ভয় বা ভক্তি তো নয়ই, শুধু পরিবারের প্রয়োজনেই আজকের এই পরিবর্তন। আমরা বিবেকবান মানুষরা বহু কাল আগে থেকেই আশা করেছিলাম এই সাম্যতা। আজ যখন ফলিত রূপ দেখছি, তখন আর ‘গেল, গেল’ রব তুলে ছায়াযুদ্ধ করার কোনও অর্থ হয় না বলে মনে করি।

বিবেকানন্দ চৌধুরী

মণ্ডলহাট, পূর্ব বর্ধমান

আলোর অধিকার

আফরোজা খাতুনের ‘নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখা চাই’ (২০-১১) লেখাটি আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কেননা, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ‘রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি’র উদ্যোগে নারী নির্যাতন রোধ ও মেয়েদের অধিকারবোধের সচেতনতার আলোচনা সভা করতে গিয়ে যে দৃশ্য দেখেছি, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। জয়নগর ২ নম্বর ব্লকের চুপড়িঝাড়া অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম ও কচিমোল্লার চকে এই সমস্ত নির্যাতিতা মেয়েকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাঁদের বলি, নিজের নাম লিখতে। ৫০ জনে র মধ্যে এক জন মাত্র নাম সই করতে পারেন। বুঝলাম, নিজের অধিকার সম্পর্কে তাঁদের সজাগ করতে পরিশ্রম লাগবে।

এই সমস্ত মেয়ের দেশ-সমাজ কোনও বিষয়ে কোনও খবর রাখার উপায় নেই। বাইরের দুনিয়া অচেনা। পারভিনা নামে এক জন জানালেন, তাঁর ১২ বছরে বিয়ে হয়েছে। যখন ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন স্বামী আবার বিয়ে করে। পারভিনার সন্তানের বয়স এখন দশ বছর। এখনও পর্যন্ত তাঁর স্বামী নিজের সন্তানের মুখ দেখেননি। এঁদের উন্নয়ন এবং অধিকারবোধ কী করে জাগানো যাবে, বুঝতে পারছি না। মগরাহাট এলাকার দরিদ্র এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মেয়েদের কয়েক জন নাম সই করতে পারেন। তালাক-হওয়া মর্জিনা মাধ্যমিক পাশ। কলকাতায় নার্সিংহোমের ডিউটির কাজ পেয়েছেন মাসে মাত্র ১৫ দিন। এই সামান্য কাজেই খুব কষ্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। মাধ্যমিক পাশ তানিয়া নস্কর বললেন, “দিদি, ১৮ বছর স্বামীর ঘর করেছি। হঠাৎ স্বামী মারা যায়। শ্বশুর জীবিত। শরিয়তের মতে ৩ মাস ১০ দিন আমাকে থাকতে দিয়েছে। তার পর তারা ছেলেমেয়ে সমেত আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে। আমার তো দিদি নিজের গড়া সংসার। নিজের ঘর। এখন মোড়লদের বিধানে আর ঢোকা যাবে না।”

নিসার মোল্লার বয়স বছর ত্রিশেক হবে। ফুটফুটে এই তরুণী দুই সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকেন। বারো বছর হল, স্বামী তাঁকে ত্যাগ করেছেন। কোনও কাজ নেই। মাসে মাত্র দশ দিন মাঠে কাজ পান। এই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে যেতে হলে প্রায় দু’শো টাকা খরচ। কোনও মতেই সম্ভব নয়। কিন্তু নিসার তার ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছেন ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে। হঠাৎ একটি মেয়ে বললেন, “দিদি আমার পিঠটা দেখবেন?” তার গোটা পিঠে কালশিটের দাগ। “স্বামী মদ খেয়ে প্রতি দিন মারে।” প্রতিবাদ করো না? “করব না আবার! সব পয়সা চলে যায় মদে। ছেলেরা না খেয়ে থাকে। বলে, ‘আমার পয়সায় খাই। তোমার না পোষায় বেরিয়ে যাও’। কোথায় যাব দিদি? বাবা যে খুব গরিব।”

স্বাধীন দেশে একবিংশ শতাব্দীতে নারীরা পরাধীন নিজের বাড়িতে। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নিজের অধিকার সে জানে না। আজও গ্রামগঞ্জ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গ্রামে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে তৈরি করেছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নারী শিক্ষা এবং সার্বিক শিক্ষা। প্রাণপাত করে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিক্ষক তৈরি করেছেন। পাঠ্যক্রম নিজের হাতে তৈরি করছেন, যাতে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যায়। তা সত্ত্বেও এই মেয়েরা অন্ধকারে। আজও শিক্ষা, সচেতনতা, অধিকারবোধ নেই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে অন্তত প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজন। সেটারও অভাব।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সে কাজ যতটুকু করেছিলেন, তার বিনিমিয়ে কিছু শিক্ষিত নারীর মুখের ভাষা ফুটেছে। স্বাধীন ভাবে তাঁরা জীবিকা অর্জন করছেন। কিন্তু আজও বাংলার গ্রামের অগণিত মেয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, নিজের অধিকার রক্ষা করতে অপারগ। তাদের শিক্ষা ও সক্ষমতার জন্য কী করা হচ্ছে?

খাদিজা বানু

সম্পাদিকা, রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি

অন্য বিষয়গুলি:

Gender Discrimination
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy