অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘যদি আমরা চুপ করে থাকি’ (২৬-১০) শীর্ষক প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলিম সমস্যাটিকে সাধারণ ভাবে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছিলেন। তিনি এই সমস্যাকে রাজনৈতিক কোণ থেকে যে দেখেননি, এমন নয়। তবে রাজনৈতিক প্রশ্নটি তাঁর কাছে প্রধান হয়ে ওঠেনি। বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে ১৯০৫ সালে তিনি বলেছিলেন, “কৃত্রিম বিচ্ছেদ যখন মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইবে তখনই আমরা সচেতন ভাবে অনুভব করিব যে, বাংলার পূর্ব-পশ্চিমকে চিরকাল একই জাহ্নবী তাহার বহু বাহুপাশে বাঁধিয়াছেন, একই ব্রহ্মপুত্র তাঁহার প্রসারিত আলিঙ্গনে গ্রহণ করিয়াছেন, এই পূর্ব-পশ্চিম হৃৎপিণ্ডের দক্ষিণ-বাম অংশের ন্যায় একই পুরাতন রক্তস্রোতে সমস্ত বঙ্গদেশের শিরা-উপশিরায় প্রাণবিধান করিয়া আসিয়াছে।”
সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সমাজ চিরকালই তাঁদের ভাবনাগুলি সমাজে ভাগ করে নিয়েছেন। সমকালও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এক শ্রেণির সুবিধাভোগী বুদ্ধিব্রতীকে এই সময়ের বহু রাজনৈতিক দলই যথার্থ ভাবে কাজে লাগায়। দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে এক শ্রেণির রাজনীতির ধ্বজাধারী হয়ে ওঠেন তাঁরা। অথচ ধর্মীয় মৌলবাদ— তা সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সমাজের সকল স্তরে ক্ষতিসাধনই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। লাল-নীল-সবুজের চৌখুপি জুড়ে আশ্রয় নেওয়া কতিপয় বুদ্ধিব্রতী যে সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন, তা বলা বাহুল্য। শম্ভু মিত্র কিংবা শঙ্খ ঘোষের ন্যায় বুদ্ধিব্রতীরা আজ হয়তো বিরল। তবুও সম্প্রতি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসা সম্পর্কিত প্রতিবাদে মুখরিত সমাজ আশার আলো জাগায়। নিরপেক্ষ সাধারণ নাগরিক থেকে বুদ্ধিব্রতীর দল— সুবিধাবাদের খোলস ছেড়ে একই মঞ্চে মৌলবাদের বিরুদ্ধে মুখরিত হওয়াই কিন্তু এই সময়ের দাবি।
সঞ্জয় রায়
দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
প্রতিবাদের ভাষা
‘যদি আমরা চুপ করে থাকি’ শীর্ষক লেখাটি পড়ে একটি দৃশ্য চোখে ভাসছে। গত নবমীতে খাসির মাংস কিনতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, বেশ কয়েকটি খাসিকে একটি খুঁটিতে বেঁধে রেখেছে। ছাগলগুলো কাঁঠাল পাতা খেয়েই যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে এক জন কসাই এসে একটা করে খাসি নিয়ে গিয়ে জবাই করছে। ছাগলগুলোর সামনেই এই জবাই পর্ব চলছে। কিন্তু তারা কাঁঠাল পাতা খেয়েই যাচ্ছে, কোনও হেলদোল নেই। সাধারণ মানুষের অবস্থা অনেকটা ওই রকম। আমরা দেখছি, জানছি যে সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ কতটা ভয়ঙ্কর। তা সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা আজও ঐক্যবদ্ধ হতে পারলাম না। আমরা জানি, সমাজে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়া বা দাঙ্গা করা মানুষের সংখ্যা খুবই কম, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ সম্প্রীতির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। কিন্তু আমরা সবাই যেন বিচ্ছিন্ন! যদি এমন একটি সমাজ হত, যেখানে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে হাজারে হাজারে মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতেন, তা হলে প্রশাসন ও হামলাকারী, উভয়েই সতর্ক থাকত। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ মানুষকে দেখা যায় নিজেরা চুপ থেকে বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে বসে থাকতে ভালবাসেন।
এটা সত্যি যে, সমাজ যাঁদের আদর্শ মেনে নিজেদের তৈরি করে, তাঁদের নীরব থাকাটা অবশ্যই সমাজের পক্ষে ভাল নয়। পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ এ বার বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে যে মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেন, তাতে ‘নিরপেক্ষ’ হিসাবে তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন কি? ইতিপূর্বে ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের পর বা অন্যান্য দেশে সাম্প্রদায়িক ঘটনার বিরুদ্ধে এঁদের প্রতিবাদী স্লোগান নিয়ে রাস্তায় নামতে দেখা গিয়েছে। এটাই নিয়ম যে, মানবতা-বিরোধী কোনও ঘটনা ঘটলে তার বিরোধিতা করতে হয়। জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। এর আগে আমাদের দেশেও যেগুলি ঘটেছে, সেগুলির বেশ কয়েকটি ছিল পরিকল্পিত। ফলে এমন সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে যদি বুদ্ধিজীবী বা সাধারণ মানুষ ‘নিরপেক্ষ’ হয়ে চুপ থেকে যান, সেই বার্তা কি সমাজের পক্ষে ভাল হবে?
প্রতিবাদের ভাষা একটাই। সেটা কোনও দেশ কাল পাত্র নয়, ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। আগামীতে কোনও রাষ্ট্রে বা আমাদের দেশে কিংবা সমাজে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটলে কি পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ একই ভাবে চুপ করে থাকবেন?
তাপসকুমার সরকার
কলকাতা-১২৫
গণতন্ত্রে দুর্যোগ
‘যদি আমরা চুপ করে থাকি’— এই ‘আমরা’ কারা? স্পষ্ট করেছেন নিবন্ধকার। যাঁরা সস্তার রাজনীতি করেন না, মননচর্চায় কিঞ্চিৎ উচ্চবর্গীয়, বিশ্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল; বংশানুক্রমে, জনগণের টাকায় ভাল স্কুল কলেজে পাঠ শেষে চাকরিবাকরি করেছেন, তাঁরা। কোনও অমানবিক ঘটনা প্রবাহে বা যখন কোনও পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে, তাঁরা পথে নেমেছেন।
ধর্মান্ধরা চায় তাদের ধর্মকেই শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে। ভিন্নধর্মীরা তাদের পদলেহন করে সব অপশাসন, হুলিয়া মেনে নেবে, তারা দলিতদের পিষে মারবে, আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করবে, নারী ধর্ষিতা হবে, প্রতিবাদীদের হত্যা করা হবে। বাংলাদেশের এ বারের দুর্গোৎসবে এ সবের পরোক্ষ প্রতিফলনে লজ্জাজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। এটাই ‘দুর্যোগ’, যা রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন বহু আগে। সুযোগসন্ধানীরা সব সময় মুখিয়ে থাকে শান্তিভঙ্গ করতে। তখন বুদ্ধিব্রতীদের দায়বোধ এড়ানো অসম্ভব। হ্যাঁ, ঘটনাক্রম তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করে, ব্যঙ্গাত্মক শ্লেষ ঝরে পড়ে তাঁদের রুখে না দাঁড়ানোর প্রতিক্রিয়াহীনতায়। আবার ভাবতে বাধ্য হই, বুদ্ধিব্রতীদের প্রতিবাদ যে হেতু নম্র-মানবিকতাবোধের উদাহরণ, ধর্মোন্মাদ নরপিশাচরা তাই তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করতে পিছপা হয় না। ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও প্রতিনিয়ত ঘটে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার। প্রতিবাদীদের কারাবন্দি করা হয়। সত্য যে, গণতন্ত্রে প্রতিবাদীর কথা না শুনলেও যদি সরকারের কিছু না আসে যায়, তা হলে গণতন্ত্র গুরুত্ব হারায়। সেই প্রতিবাদহীন, নিশ্চুপ, অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার পূর্বে যেন
মান-হুঁশ সম্পন্ন সর্বোত্তম জীবটি তার সংজ্ঞা হারায়।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি
কলকাতা-১২৫
বিজ্ঞানমনস্কতা
দেশে দেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসের সুযোগ নেয় ধর্ম ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও দাঙ্গাবাজরা। কয়েক দিন আগে আমাদের এক জন নেতা তো বলেই দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের এই ঘটনা আগামী উপনির্বাচনে তাঁদের দলকে জিততে সাহায্য করবে। আশার কথা, সাম্প্রদায়িক হিংসার মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতায় ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশের তথ্য দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী মুরাদ হাসান।
শুধু ধর্মনিরপেক্ষ হলেই হবে না, রাষ্ট্র যাতে কোনও ধর্মকেই উৎসাহ না দেয়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় আরও মনোযোগী হতে হবে এবং সম্প্রীতি নষ্ট হয় এমন যে কোনও প্ররোচনামূলক কাজ কড়া হাতে দমন করতে হবে। যুক্তিবাদের নিরলস চর্চা এবং মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণার মাধ্যমে মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে হবে। একমাত্র তখনই মানুষ ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক হিসাবে দূরে সরিয়ে রাখবে ও সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ হবে।
আশিস রায়চৌধুরী
শিলিগুড়ি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy