Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Politics

সম্পাদক সমীপেষু: শোনার আগ্রহ

বাম রাজত্বের শেষ দিকে, ঔদ্ধত্য এবং স্বেচ্ছাচারিতা দেখে মানুষ যখন তিতিবিরক্ত, তখনও আলিমুদ্দিনের কর্তারা বিবৃতি দিয়ে চলেছেন— মানুষের কাছে যেতে হবে, তাঁদের বোঝাতে হবে।

বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছে।

বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছে। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২২ ০৫:৩৬
Share: Save:

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় খুব সহজ করে খুব জরুরি এবং যথাযথ কথাটি উচ্চারণ করেছেন— প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি গড়ার পথে জনসমাজের আস্থা ফিরে পাওয়ার কাজটা কঠিন, কিন্তু কাজটা বামপন্থী রাজনীতির পক্ষেই সম্ভব। এবং সে রাজনীতি ‘কথা শোনার রাজনীতি’ (২৫-১০)।

এখনকার রাজনীতির শাস্ত্রে ‘কথা শোনা’ কথাটা প্রায় বিলুপ্ত। রাজনীতি শুধুই বলতে চায়, বোঝাতে চায়। সে শুনতে চায় না, বুঝতে তো ঘোষিত ভাবেই চায় না। অবস্থা কিন্তু বরাবর একই রকম ছিল না। অগ্নিযুগ থেকে আশির দশক পর্যন্ত বাংলায় একটা বামপন্থার ঐতিহ্য ছিল, প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করার একটা সংস্কৃতি ছিল। বামপন্থা মানেই সিপিএম— ব্যাপারটা ঠিক তেমন ছিল না। যে কোনও পন্থাই যখন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তখন সে সমালোচনা সহ্য করে না। আত্মসমালোচনা বন্ধ হয়ে যায় তো বটেই, প্রশ্ন তোলার কণ্ঠগুলিকেও সে রোধ করতে চায়। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নামই বামপন্থা, অন্তত এককালে এই বাংলায় তেমনটাই ছিল। আশির দশকে বাম সরকারের প্রথম পর্বেও আমরা দেখেছি, যুবসমাজ ছাত্রসমাজ প্রশ্ন তুলত, কথা বলত এবং তৎকালের ক্ষমতাশীল মাঝারি কিংবা উচ্চ স্তরের বাম নেতারা সেই সব কথা শুনতেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুনতেন। ক্ষমতাবান শাসক পছন্দ না করলেও সেই সময় পর্যন্ত কথা শোনার একটা সংস্কৃতি, কিংবা প্রবন্ধকারের ভাষায় কথা শোনার একটা রাজনীতি ছিল। এখন যার অস্তিত্ব নেই। বহুকাল ধরেই নেই। বাম জমানার শেষ কুড়ি বছরে সেই সংস্কৃতিটা বিবিধ কূটকচালি প্রক্রিয়ায় প্রায় পুরোটাই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আমাদের কারও কথা শোনার প্রয়োজন নেই, আমরা সব জানি, আমরা শুধু বলে যাব।

বাম রাজত্বের শেষ দিকে, ঔদ্ধত্য এবং স্বেচ্ছাচারিতা দেখে মানুষ যখন তিতিবিরক্ত, তখনও আলিমুদ্দিনের কর্তারা বিবৃতি দিয়ে চলেছেন— মানুষের কাছে যেতে হবে, তাঁদের বোঝাতে হবে। তাঁরা এক বারও বলছেন না যে, “মানুষের কাছে যেতে হবে, তাঁদের বুঝতে হবে, তাঁদের কথা শুনতে হবে।” না, সেই বিবৃতির ভাষা এখনও বদলায়নি। এখনও সাধারণ মানুষ কী বলছেন, বর্তমান প্রজন্ম কী বলতে চায়, সেটা শোনার মতো কোনও আগ্রহ তাঁদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অথচ, এই মুহূর্তে সারা দেশেই বামপন্থা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।

বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছে মানে বামপন্থা হারিয়ে গিয়েছে, তেমনটা কিন্তু নয়। কংগ্রেস, তৃণমূল, এমনকি বিজেপির ভিতরেও বামপন্থী মানসিকতার নবপ্রজন্ম আছে, তাঁদের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়, এমন কোনও সুনির্দিষ্ট দিশা নেই, আশা নেই, নেতৃত্ব নেই। করোনাকালে এক ঝাঁক তরুণের দেখা মিলেছিল, আশা জেগেছিল। কিন্তু চটজলদি লাভের স্বার্থসঙ্কুল কুটিল রাজনৈতিক নির্দেশনায় এই স্বপ্নমাখানো তরুণদের ভিতরে জেগে ওঠা বামপন্থাকে ডানা মেলার সুযোগ না দিয়ে একটা বিরাট সম্ভাবনা বিভ্রান্তির পথে দিশাহীন হয়ে গেল।

কোন দল কোন গোষ্ঠী— সেটা ভাবতে চাই না, প্রতিটি দল ও প্রতিটি গোষ্ঠীতেই বামপন্থা জাগ্রত হোক, প্রশ্ন করার সুযোগ সৃষ্টি হোক, কথা শোনার রাজনীতি ফিরে আসুক— সেটাই প্রত্যাশা।

ইনাস উদ্দীন, কলকাতা-৩৭

ঘৃণার অবসান

‘ধর্মের নামে’ (২৮-১০) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে সহমত পোষণ করে কিছু বলতে চাই। সংবিধানের ৫১(ক) ধারা অনুযায়ী, এক জন ব্যক্তি, এক জন নাগরিক এবং এক জন রাষ্ট্র-অধীন ব্যক্তির কী কী স্বাধীনতা ও সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তার স্পষ্ট আন্দাজ পাওয়া যায়। কিন্তু এই কর্তব্য ও বোধ থেকে চ্যুতি ঘটে বলেই সংবিধানের বাকি নিয়মগুলির অবতারণা। তেমনই এক চ্যুতি ঘটে ঘৃণা ভাষণের ক্ষেত্রে। মানবসমাজে মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের যে সব দৃষ্টান্ত রয়েছে, সেখানে ঘৃণা ভাষণের বিরাট ভূমিকা। সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতিতেও ঘৃণা ভাষণের প্রভাব এমন তীব্র যে, এর পরিণতিতে বিগত কয়েক বছরে দেশ জুড়ে অস্থিরতা, ধর্মীয় টানাপড়েন দেখা গিয়েছে। আর তা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতেই। এবং কী প্রকার ভাষ্যের ভিতর দিয়ে এই অস্থিরতা চাগাড় দিয়েছে, সে বিষয়ে সময় সাক্ষী। কিন্তু এই পরিচয় বা বিদ্বেষ ভাষণের লক্ষ্য নিকেশ করে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত পেশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি কে এম জোসেফ ও হৃষীকেশ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ। ঘৃণা ভাষণ দেওয়াই অপরাধ। ভাষ্যকারের পরিচয়, উদ্দেশ্য বিবেচনা করার আগে তাঁর ভাষ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করতে হবে। এই আদেশ মূলত পুলিশ-প্রশাসনের উদ্দেশেই। আদেশ মানা না হলে আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে হবে তাঁদের।

দেখা গিয়েছে, মূলত পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাই ঘৃণা ছড়াতে সহায়তা করে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা এই দেশের গণতান্ত্রিকতার অন্যতম পরিচয়। সেই পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখতে দোষীকেও ধর্মনির্বিশেষে বিচার করার এই ‘অবলোকন’ নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তস্বরূপ। সমাজে ঘৃণা ভাষণের প্রচলনকে প্রতিহত করে যুক্তি-সহ সত্য তথ্যের আবাহন, এবং সুশিক্ষার মধ্যে দিয়ে ঘৃণাকে চিরতরে মুছে দেওয়ার অহিংস নীতির আভাসও পাওয়া যায় এই রায়ের মধ্যে দিয়ে। সর্বোচ্চ আদালত যে এর একটা বিহিত চায়, তা এই রায়ের মধ্যে স্পষ্ট। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে সমর্থন করছি এবং স্বাগত জানাচ্ছি।

অভিজিৎ ঘোষ, কুশপাতা, পশ্চিম মেদিনীপুর

দুঃখিনী দুর্গা

সন্দীপন নন্দী লিখিত ‘অপুষ্ট শরীরে মাতৃত্বের দায়’ (১-১১) শীর্ষক প্রবন্ধটি নাবালিকা বিবাহ-পরবর্তী ভয়াবহ দুরবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বিদ্যালয়ে আগত এক জন মা’কে এক বার নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁরা খুব গরিব। এবং অসুস্থ এই মেয়েটির চিকিৎসার ব্যবস্থা তাঁদের পক্ষে ঠিকমতো করা সম্ভব নয় বলেই মেয়ের ‘ভাল’র জন্য তাকে মাধ্যমিকের পরেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।

এমন অসুস্থ মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিজের বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি আদর-যত্নে রাখবেন— এমন ভাবনা তিনি কিসের ভিত্তিতে ভেবেছেন জিজ্ঞাসা করলে পরিষ্কার জানান, এই বিষয়টি তিনি কখনও সেই অর্থে ভেবে দেখেননি। আবার পুজোর ছুটির পরে এক জন মলিন পোশাক পরিহিতা মা যখন কাঁচুমাচু মুখে মেয়ের উচ্চ মাধ্যমিকের প্রজেক্ট জমা দেওয়ার জন্য আসেন, তখন ঘটনাক্রমে জানা যায় তাঁর মেয়ের বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার করুণ কাহিনি। নিচুতলার রাজনৈতিক চাপে ‘পরিসংখ্যানের ম্যাজিক’-এ হয়তো এই মেয়েটি ‘কন্যাশ্রী’র টাকাটাও পেয়ে যাবে। পাশাপাশি ‘পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহ ২৩ থেকে ১৯ শতাংশে নামানো গিয়েছে’ শিরোনামে সংবাদও প্রকাশিত হতে থাকবে।

সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প, দারিদ্র, অশিক্ষা বা ‘মেয়ের ভাল হওয়ার’ অনর্থক আবেগ যখন নাবালিকা ও তাদের পরিবারে জট পাকিয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়, তখন মনে হয় এর মূলে আছে ‘সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং’-এর অভাব, নাবালিকার কল্যাণের বিষয়টাকে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে না দিতে পারার ব্যর্থতা। বাবা-মা’কে ‘গুড পেরেন্টিং’-এর পাঠ দিয়ে সন্তানদের সুস্থ ও স্বাভাবিক মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে সাহায্য করা দরকার। অন্যথায় স্থান ও কাল নির্বিশেষে অপুষ্ট শরীরে নাবালিকারা দেড় বছরে দ্বিতীয় বার আঁতুড়ঘরে ঢুকতে বাধ্য হবে। শিক্ষা ও যথোপযুক্ত সরকারি উদ্যোগের মধ্যে তাই ‘সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং’ বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে জুড়ে দেওয়া দরকার। অন্যথায় অসহায় পিছিয়ে পড়া ঘরের মেয়েদের কলম ছেড়ে দুঃখিনী দুর্গা হিসেবে সর্বদা কোল পেতে বাচ্চা নিয়ে বসে থাকতে দেখা যাবে।

তন্ময় মণ্ডল, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা

অন্য বিষয়গুলি:

Politics CPM TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy