—ফাইল চিত্র।
‘জাতিগণনাই কি সমাধান’ (১৬-৬) প্রবন্ধে ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় উচ্চবর্ণ হিন্দুর প্রবল আধিপত্য দেখে তাকেই ‘নন্দ ঘোষ’ করেছেন, যা আপত্তিকর। উচ্চবর্ণ হিন্দুর আধিপত্য প্রবল হয়েছে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক, দুই কারণেই। এ কথা সত্যি, আরএসএস-বিজেপি যৌথ ‘সোশ্যাল এঞ্জিনিয়ারিং’ হিন্দু আধিপত্যের নেতিবাচক দিকটিকে প্রবল করেছে। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতার ইতিবাচক দিকের বাস্তবতার প্রভাব উল্লেখ করতেই হবে। এই ইতিবাচক দিককে সংরক্ষণের জটিলতা ও ব্যর্থতা দিয়ে আক্রমণ করেছেন প্রবন্ধকার। জাতিগণনার অসম্পূর্ণতা, মুসলিম অশিক্ষা, অদক্ষতার জন্য কেন হিন্দু আধিপত্য দায়ী হবে?
এত অসুবিধা ও জটিলতা সত্ত্বেও সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে জোর করে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ভারতের অর্থনীতিতে অস্বস্তি বেড়েছে, রাজনীতি আরও জটিল হয়েছে। সাম্যের বদলে অদক্ষতা প্রশ্রয় পেয়েছে। উৎপাদনশীলতা, বেকারত্ব, দারিদ্র-সহ বিভিন্ন জাতীয় পরিসংখ্যান অস্বচ্ছ, অনুজ্জ্বল। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে ভারত উন্নয়নশীল হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। স্বাধীন ভারতে শিক্ষার এত সুযোগ সত্ত্বেও অশিক্ষা ও কুশিক্ষার কারণে স্বল্পশিক্ষিতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক শিক্ষা জরুরি, যা মানুষকে দক্ষ করতে পারে। সেখানে মানুষের সংরক্ষণের সুযোগ নেওয়ার জন্য কোনও অনৈতিক, অন্যায্য ব্যবস্থার দরকার হবে না। এর জন্য অবশ্য সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে হবে। অথচ, এর ঠিক উল্টোটাই হচ্ছে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
নিষ্প্রয়োজন
‘জাতিগণনাই কি সমাধান’ শীর্ষক প্রবন্ধটির প্রসঙ্গে জানাই, স্বাধীনতা লাভের ৭৭ বছর পরেও যে এই দেশে জাতিগত সংরক্ষণ প্রথা বহাল তবিয়তে চালু আছে, সেটাই নিদারুণ লজ্জার। ভাবতে অবাক লাগে, আদর্শগত ভাবে সংরক্ষণ প্রথা জারি থাকার বিরুদ্ধে হলেও এখনও পর্যন্ত কোনও নির্বাচিত সরকারই, সম্ভবত ভোটব্যাঙ্কের কথা চিন্তা করেই, সংরক্ষণ ব্যবস্থাটিকে বাতিল করতে আগ্রহ দেখায়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সংরক্ষণের হার বাড়াতে সচেষ্ট থেকেছে। এতে যে প্রকৃত মেধাবীদের অবদমন করা হয়েছে, সেটা তারা বুঝেও বুঝতে চায়নি। সরকারি চাকরি পাওয়া, পদোন্নতির বিভিন্ন পর্যায়ে জাতিগত পরিচয়কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছে মেধা। স্বাধীনতার এত বছর পরে যা কখনও কাম্য না। বিশ্বের এমন বহু দেশ আছে যেখানে কোনও সংরক্ষণ প্রথা নেই। ভারতেই বা তা দীর্ঘ কাল ধরে জিইয়ে রাখতে হবে কেন? সংরক্ষণ রাখতেই হলে সীমাবদ্ধ থাক শুধুমাত্র আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা জনজাতিদের জন্য।
সমীর কুমার ঘোষ, কলকাতা-৬৫
ধর্মের ভূমিকা
মোহিত রায় ‘সংবিধান কেন পবিত্র গ্রন্থ’ (১৪-৬) প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, একেবারে স্থায়ী ভিত্তির সংবিধান কি একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হয়ে দাঁড়ায় না? আমার প্রশ্ন, একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নাম করতে পারেন যেটি ৭৫ বছরে ১০৬ বার সংশোধন করা হয়েছে? পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সংশোধন করা যায় কি? প্রধানমন্ত্রীর রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠাতে দেশের চার প্রধান ধর্মগুরুই তো সায় দেননি। দেবতায় প্রাণ সঞ্চারেই বিশ্বাসযোগ্যতা নেই, আর পুস্তকে দেবত্ব আরোপ করে ‘পবিত্র ধর্মগ্রন্থ’ বানিয়ে ফেলবেন?
প্রবন্ধকার বলেছেন ভারতীয়রা ধর্মপ্রবণ, তাই গণতন্ত্রও তাদের কাছে একটি ধর্ম। বলেছেন, ধর্মের অর্থ ধারণ করা। ‘ধর্ম সমাজকে ধারণ করে আছে’— এ তত্ত্বের উৎস কোথায়? এটি কোন মার্গের ধারণা? ‘ধারণ’ শব্দের অর্থ কী? হস্তে বা অঙ্গে গ্রহণ, বা পরিধান। যেমন গর্ভে সন্তান ধারণ, অঙ্গে বস্ত্র গ্রহণ বা ধারণ করা। জলের পাত্র যেমন জল ধারণ করে, পৃথিবীর জল, বাতাস, মাটি, গাছপালা হল আমাদের পরিবেশ যা সমস্ত জীবকুলকে ধারণ করে আছে। মানুষ পশুপালন ও চাষবাস শুরু করেছে আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে। তার আগে তো প্রস্তর যুগে পাথরের অস্ত্র বানিয়ে শিকারি জীবন। তখন ধর্মের কোনও ধারণার কথা জানা যায়নি। তখন থেকেই মনুষ্যত্ব অর্জনের নিরলস পরিশ্রমের ইতিহাস। মানুষের এই আদি ইতিহাসকে ‘ধর্ম মানব সমাজকে ধারণ করে’ এমন এক ভুল ধারণার আড়ালে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ধর্ম একটি ধারণা, বিশ্বাস। ধারণা দিয়ে অস্তিত্ব ধারণ করা যায় না। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান হল মৌলিক উপাদান, জীবনের আধার, জীবনকে ধারণ করে, ধরে রাখে। আর মানুষে-মানুষে সহযোগিতা ছাড়া শিকার থেকে কৃষি, কোনওটাই সম্ভব ছিল না। সহযোগিতা ও পরিশ্রমের সাহায্যে মানুষ প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ করে বেঁচে আছে। এর মধ্যে ধর্মের ধারণের ইতিহাস নেই।
ভারতীয় সংবিধান ধর্ম পালনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার বলে চিহ্নিত করলেও কর্মের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়নি। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা সংবিধান নির্দেশমূলক নীতিতে উল্লেখ করেছে। তার ফলে অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়েছে মৌলিক চাহিদা। ভারতে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হলেও বহু শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, বহু মানুষ অনাহারে বা এক বেলা খেয়ে দিন কাটায়, খোলা আকাশের নীচে বাস করে।
প্রবন্ধকার উপসংহারে বলেছেন, বহুমতের সহাবস্থানে সমাজকে ধারণ করার ধর্ম এ দেশের কয়েক সহস্র বছরের ঐতিহ্য। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক বিজ্ঞান বলে মানবের ইতিহাস লক্ষ লক্ষ বছরের পুরনো। ঐতিহ্যের দাসত্ব বহন করাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমাদের সংবিধানের ৫১(ক) ধারায় বলা হয়েছে, বৈজ্ঞানিক মনোভাব ও মানবিকতার বিকাশ প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।
শান্তনু গুহ, কলকাতা-১৯
শাশ্বত মূল্যবোধ
মোহিত রায় সংবিধান সংশোধনী আইনকে বাতিল করবার অথবা মান্যতা দেওয়ার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের থেকে। প্রবন্ধকারের এই প্রস্তাব আমার মতে অযৌক্তিক। ন্যায়ালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় বিচারপতিদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে সংসদের সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনা হয় না। সংসদে যে কেউ নির্বাচিত হতে পারেন। বর্তমানে এমন অনেক সাংসদ আছেন, যাঁরা নানা গুরুতর অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত। তাঁদের কাছে দেশের প্রতি আনুগত্যের আশা মূর্খামি।
তাই পবিত্র সংবিধানে সংশোধনের প্রয়োজন হলে তার গুরুদায়িত্ব বিচারালয় ও সংসদ উভয়কেই দেওয়া হয়েছে। এ ভাবে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা পরীক্ষিত এবং বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত। শাসক যদি গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো আমাদের শাশ্বত মূল্যবোধগুলোকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, তা হলে ন্যায়ালয়ই আমাদের রক্ষা করতে পারে।
জাতের নামে অনেক বজ্জাতি এ দেশ দেখেছে। হাজার হাজার বছর ধরে মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বর্ণবিভাজন, শোষণের রাজনীতির ভার বহন করেছে কোটি কোটি দলিত, নিপীড়িত মানুষ, ভারবাহী পশুর মতোই। আম্বেডকর সংবিধান রচনার সময় সেই শোষণের বিরুদ্ধেই সচেতন থেকেছেন। এতে প্রবন্ধকারের ক্লেশের কারণটি বোধগম্য হল না।
একটি নির্দিষ্ট সংবিধানের কোনও বিকল্প নেই। এর অপ্রয়োজনীয়তার অনুভবের পিছনে নৈরাজ্যের দুরাচার উঁকি দিতে পারে। সমাজের উচ্চকোটির বুদ্ধিজীবীদের এই আকাঙ্ক্ষা খেটে-খাওয়া জনসমাজ প্রত্যাখ্যান করবে। প্রবন্ধকার স্থায়ী ভিত্তির সংবিধান চান না। প্রস্তাবটায় হয়তো অভিনবত্ব আছে। কিন্তু মানবিকতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্য, স্বাধীনতার মতো কিছু মূল্যবোধও আছে, যা মানবজাতির কাছে শাশ্বত।
তৈয়েব মণ্ডল, হরিপাল, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy