Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Religion

সম্পাদক সমীপেষু: ধর্ম ও রিলিজন

আসলে মানুষের আন্তরিক উপলব্ধি ও পূর্ব সংস্কারের কাঠামোর মধ্যে ঐশ্বরিক বা দৈবশক্তির প্রকাশ ঘটে থাকে।

religion

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৪:৫২
Share: Save:

‘ধর্ম বনাম ধর্ম’ (১৩-২) শীর্ষক প্রবন্ধে সুকান্ত চৌধুরী লিখেছেন, “‘রিলিজন’-এর মূল প্রয়োগ পশ্চিম এশিয়ায় উদ্ভূত তথাকথিত ‘আব্রাহামীয়’ আধ্যাত্মিক প্রণালীগুলি নির্দেশ করতে। সেটা প্রসারিত হয়েছে ভারতে প্রচলিত নানাবিধ আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, আচারবিচার ও জীবনদর্শনের সমষ্টি বোঝাতে, যাকে বলা হয় হিন্দুধর্ম।” এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আব্রাহামীয় বা সেমেটিক বিশ্বাসের উৎস ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয়। মূল সত্য বা বিশ্বাস আব্রাহামের কাছে উদ্ঘাটিত করেন স্বয়ং ঈশ্বর, তাই তা ছিল তর্কবিতর্ক বা বাদানুবাদের ঊর্ধ্বে। যদিও সেই বিশ্বাসের তিন রূপ— ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম। আর এই তিন ধর্মের অনুগামীরা নিজের নিজের ধর্মে বিশ্বাসী। সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুগামীদের অবশ্য সত্যের অন্বেষণে স্থায়ী ভাবে দায়বদ্ধ থাকতে দেখা গিয়েছে। সে সত্য বা বিশ্বাস স্বর্গ থেকে ঈশ্বর বা তাঁর কোনও পয়গম্বরের প্রেরিত বা উদ্ঘাটন করা সত্য নয়। প্রার্থনা, ধ্যান, সদ্ব্যবহার ও অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আন্তরিক অনুসন্ধানেই কেবল তার সন্ধান মেলে, হয়তো কেবল জীবনের শেষ প্রান্তে, আদৌ যদি তা মেলে। হিন্দুদের কাছে ধর্মের ধারণা আরও বিস্তৃত। আইনানুগ আচরণ ও ব্যবহারে তা ঘিরে রাখে সামাজিক নৈতিকতার গোটা ব্যবস্থাকে। ধর্ম তার ধ্রুপদী সংবেদনশীলতায় ঈশ্বর ও মানুষ— উভয়ের বিশ্বপ্রসারী দায়বদ্ধতায় পরিব্যাপ্ত। সহজ কথায়, ধর্ম বলতে আমরা বুঝি এমন কিছু, যা আমাদের জীবন জুড়ে থাকে। ধর্ম অনুসারে, ধর্মকে মেনে বাঁচা সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলা।

আসলে মানুষের আন্তরিক উপলব্ধি ও পূর্ব সংস্কারের কাঠামোর মধ্যে ঐশ্বরিক বা দৈবশক্তির প্রকাশ ঘটে থাকে।

“ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,/ এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।” এই আর্তিতে ঈশ্বর কর্ণপাত করবেন কি না জানি না। আদম ও ইভের দুই ছেলের এক জন যখন আর এক জনকে খুন করে, তখন থেকে বোঝা যায় কোনও দু’জন মানুষ এক রকম হয় না। পারুক, না পারুক প্রত্যেক মানুষ পৃথিবীতে নিজের মতো চলতে চায়। মানুষ দল গড়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির নিরিখে। তাদের উদ্দেশ্য অন্যদের দাবিয়ে রাখা, যাতে দুধে-ভাতে কিছুটা নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। তাই আশঙ্কা হয়, জগতে যত প্রাণ আছে, সকলেই এক আত্মারই বহুরূপ মাত্র— স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণী শুধু কথার কথা হয়ে থাকবে না তো?

মনোজ ঘোষ, কলকাতা-৬১

শুধুই আচার

সুকান্ত চৌধুরীর প্রবন্ধের সূত্রে কিছু কথা। সর্বধর্মের সারসত্য হল বিশ্বমানবতা। কবীর, নানক, চৈতন্য, রবিদাস, রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, সকলেই আত্মীয়তার সত্য দ্বারা ধর্মের বিরোধের মধ্যে সেতুবন্ধন করতে চেয়েছিলেন। লক্ষ করা গেছে, ধর্মের সাম্প্রদায়িক মোহ রাজনৈতিক স্বার্থ এবং বুদ্ধির উৎসাহ দানে উত্তপ্ত হয়ে অনেক সময় জাতীয় ঐক্য বিপন্ন করেছে। দেখা গিয়েছে, ধর্ম বিষয়ে এক ধরনের কঠিন বিরুদ্ধতা। রবীন্দ্রনাথের মতে, ধর্ম আমাদের অন্তরের জিনিস না হয়ে তার বাহ্য আচরণকে অনেক সময় মুখ্য করে তুলেছে। সেই আচার-সর্বস্ব কৃত্রিম বিধি ‘আত্মা’র ধর্মকে পীড়িত করে। তাই অনেক আগেই গৌতম বুদ্ধ থেকে মহাবীর জৈন, জিশু খ্রিস্ট ধর্মের এই আচার-সর্বস্বতাকে ত্যাগ করে ধর্মীয় চেতনাকে সকল মানুষের কল্যাণমুখী করে তুলতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “...কাজ কী আমার মন্দিরেতে আনাগোনায়/ পাতব আসন আপন মনের একটি কোণায়।” (গীতিমাল্য)। আপন হৃদয়েই যেখানে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান, সেখানে মন্দিরের আবেষ্টনে ঈশ্বর অনুসন্ধান অর্থহীন।

‘ধর্মের অধিকার’ (সঞ্চয়, ১৩২৩) শীর্ষক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ধর্মের দোহাই দিয়ে কোনও জাতি যদি মানুষকে পৃথক করতে থাকে এবং তার অধিকারকে সঙ্কুচিত করে, তা হলে সে জাতিকে হীনতার অপমান থেকে রক্ষা করার জন্য কোনও রাষ্ট্রনৈতিক ইন্দ্রজাল নেই। তিনি বরাবরই বলেছেন ধর্ম সম্বন্ধীয় সব কিছুকেই নিত্য বলে ধরে নিলে হয় না। তাই তিনি শাস্ত্রীয় অনুশাসনের প্রথাসিদ্ধ পথ পরিত্যাগ করে মুক্ত জ্ঞানের আলোকে ধর্মের মর্মানুসন্ধানে সক্রিয় হয়েছিলেন। বাউল সাধকের ন্যায় তাঁর কাছে ছিল মানুষই দেবতা, মানুষে মানুষে প্রেমই ধর্মের মূলকথা।

স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন, আচারকেন্দ্রিক ধর্ম ধর্মের গৌণরূপ। ধর্মের মুখ্যরূপ জীবপ্রেম, মানুষের সেবা। মন্দির, তীর্থ, পূজাপাঠের মধ্যে ধর্মের সার নেই, আছে নিজের অনুভূতি, উপলব্ধিতে। সেই সঙ্গে তিনি মনে করতেন, “প্রত্যেক ধর্মেরই অপর ধর্মগুলিকে স্বীকার করিয়া লওয়া আবশ্যক; ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় অপরের কোন বিশেষ ধারণাকে ভিন্ন মনে করিয়া নিন্দা করা উচিত নয়।... ধর্মসমূহের মধ্যে অতি প্রচণ্ড শক্তি নিহিত থাকিলেও ঐগুলি শুধু সঙ্কীর্ণতা ও অনুদারতার জন্যই মঙ্গল অপেক্ষা অমঙ্গল অধিক করিয়াছে।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, তৃতীয় খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, পৌষ ১৩৯৫)। অত্যন্ত দুঃখের কথা যে, আজও আমরা এই সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি।

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

মৈত্রীর বন্ধন

এ দেশে মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে যে তুঘলকি কাণ্ডকারখানা চলছে, তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে যদি এমন কথা কেউ বলেন যে, “দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের স্বীকৃত কর্তব্য ঈশ্বরবিশ্বাস প্রত্যয়িত করা”— তখন তাঁর চিন্তাধারা কত দূর মুক্ত, সেই প্রশ্ন মনে জাগে। এই ক্ষেত্রে প্রবন্ধকারের উচিত ছিল ঈশ্বরে বিশ্বাস সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যাও অন্তত উপস্থাপন করা। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে যে বিভ্রান্তি রয়েছে, সে সম্পর্কেও আরও পরিষ্কার করে বলা দরকার। আবার যিনি বা যাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, তাঁদের সম্পর্কেই বা ন্যায়ালয় কী বলবে?

তবে ঈশ্বরবিশ্বাসীরা সকলেই একটি বিষয়ে একমত হন যে, এই জগতের স্রষ্টা ঈশ্বর নামের কেউ এক জন আছেন। মাঝে মাঝে তিনি অবতাররূপে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, সাধারণ মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য। সেই মানুষের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে এক দল মানুষ নিজেকে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগস্থাপনকারী হিসাবে দাবি করেন, এবং কিছু কিছু গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় তাঁদের সমর্থন ও অনুসরণও করে থাকেন। মুক্তচিন্তার মানুষেরা এই অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলেন। ‘মনুষ্যত্বের ধর্মাসন’ নিরাপদ রাখতে যুক্তিবাদকে অগ্রাধিকার দিতে, ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের একাংশ অক্ষম। সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অধিকার আমাদের দেশের সংবিধান স্বীকৃত। অথচ সেই সংবিধানকে মান্যতা দেওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্র পরিচালকেরা ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছেন।

প্রতিটি ধর্ম নিজের ধর্মের মানুষের মধ্যেই অসংখ্য বিভাজন করে নিয়েছে, যা এক জন মানুষের সঙ্গে আর এক জনের দূরত্ব তৈরি করছে। অন্যের ধর্ম ও সম্প্রদায়কে ছোট করায় অনেকেরই দ্বিধা বোধ হয় না। একটি শিশু পরিণতমনস্ক হয়ে ওঠার আগেই তাকে একটা ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে আটকে ফেলা হয়। সেখানে যুক্তি এবং বিজ্ঞানচেতনা অনুপস্থিত। ধর্ম যদি সত্য সত্যই মনুষ্যসমাজের মঙ্গলের জন্য সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বোধের শিক্ষাকেই তো তার অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। পরে পরিণত বয়সে যে কেউ খুঁজে নিতে পারেন তাঁর পছন্দের ঈশ্বরকে। মানুষের মধ্যে সেই সহমর্মিতার শিক্ষা থাকলে মানবতাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের উপর এ ভাবে হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত না।

আজ যদি এই প্রজন্মের ছোটরা নিজের সমবয়সিদের মধ্যে একটা মৈত্রীর বন্ধন তৈরি করতে সক্ষম হত, তা হলে বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে সে কখনও জাত বা ধর্মের বিচার করত না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সম্ভাবনাটুকুও আমরা আর অবশিষ্ট রাখতে চাইছি না।

রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

অন্য বিষয়গুলি:

Religion Society Hindus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy