সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরীর লেখা ‘তালিবান শাসন এবং...’ (১৮-৮) প্রবন্ধটি আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন বলে মনে হয়েছে। বৈদেশিক নীতির স্বার্থে কোন রাষ্ট্র কখন যে কোন দিকে থাকবে, তা বোঝা দুষ্কর। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের সেনাবাহিনী যখন আফগানিস্তানে তাদের দখল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল, তখন তালিবানরা ছিল আমেরিকার সেনাবাহিনীর মদতে পুষ্ট। তখন চিনের অবস্থানও ছিল তালিবান-বিরোধী। ৩২ বছর পর ঠিক উল্টো চিত্র। আজকের তালিবান নামক সন্ত্রাসবাদীরা চিন, পাকিস্তান ও রাশিয়ার সরকারের দ্বারা পরিচালিত। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকায় সন্ত্রাসীদের আক্রমণে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের খোঁজে এবং গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আফগানিস্তানে আমেরিকা ও নেটোর সেনাবাহিনীর প্রবেশ এবং যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তালিবানদের পিছু হটা।
তালিবান-মুক্ত আফগানিস্তানের পরিকাঠামোর উন্নয়নে আমেরিকা, ভারত ও অন্য কিছু রাষ্ট্র লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করেছে। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পরে আমেরিকান সেনাবাহিনী আফগান সেনাবাহিনীর সদস্যদের আধুনিক অস্ত্রের জোগান ও তার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যত দিন পর্যন্ত আমেরিকার সেনা আফগান সেনার পাশে ছিল, তত দিন তারা সাহসের সঙ্গে তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওই দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন তা কার্যকর করার পর থেকেই রকেটের গতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদতে পুষ্ট তালিবানিদের উত্থান এবং তার সঙ্গে একের পর এক শহর ও প্রদেশ দখল।
দুর্নীতিগ্রস্ত আফগান প্রশাসনের আধিকারিকরা অর্থ তছরুপের উদ্দেশ্যেই এত দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছিল। যার ফলে, তালিবানদের সঙ্গে আফগান সেনাবাহিনী যুদ্ধে কখনও পেরে ওঠেনি। মুখে যা-ই বলুক, এ বারও তালিবানরা আফগানিস্তান জুড়ে ইতিমধ্যেই জঙ্গলের শাসন শুরু করে দিয়েছে। মহিলাদের বোরখা পরতে বাধ্য করা, কর্মস্থলে যেতে নিষেধ করা, স্কুল-কলেজে মেয়েদের যেতে নিষেধ করার মতো নানাবিধ ফতোয়া জারি শুরু হয়ে গিয়েছে। কত দিন এই অত্যাচার চলবে, তা সময় বলবে।
তালিবানদের কাঁধে বন্দুক রেখে চিন, রাশিয়া ও পাকিস্তান, ভারত ও আমেরিকার পরিবর্তে আফগানিস্তানে তাদের ক্ষমতা কায়েম করতে চাইছে। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলি সন্ত্রাসবাদ নামক বিষাক্ত সাপ নিয়ে খেলা করতে গিয়ে এক দিন তার বিষে নিজেই ধ্বংস হতে বাধ্য। ইতিমধ্যে অনেকগুলো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী পাকিস্তানে সক্রিয়। তার মধ্যে ‘তেহরিক-ই তালিবান’ অন্যতম।
মনে রাখা প্রয়োজন, পাশের ঘরে আগুন দিলে তার আঁচ নিজের ঘরেও লাগতে বাধ্য।
পার্থ সারথী মণ্ডল, কৃষ্ণনগর, নদিয়া
ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি
ধর্মীয় মৌলবাদকে যারা সমর্থন বা প্রশ্রয় দেয়, সেই দেশের পরিণাম কী হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফগানিস্তান। বিশ্বের অমিত শক্তিধর দেশগুলো নীরব। সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জ, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা নাকি যার একমাত্র উদ্দেশ্য, সেও ভূমিকাহীন। উল্টে সারা বিশ্বের যত জঙ্গি সংগঠন, সবাই আফগানিস্তানে এসেছে। একজোট হয়েছে। বৃহৎ কোনও লক্ষ্য নিয়ে তারা কোনও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক জঙ্গি কার্যকলাপের পরিকল্পনা করবে, এ আশঙ্কা থেকেই যায়। ধর্ম সর্বদাই প্রগতিকে রুখতে চায়। সে তার প্রাগৈতিহাসিক সৃষ্টির সময়কাল থেকেই যা রপ্ত করেছে, যা কিছু অর্জন করেছে, সেটাকেই চিরকালীন ব্যবস্থা বলে মনে করতে চায়। তাই সে যুক্তিকে অস্বীকার করে। বিজ্ঞান চেতনাকে তার পথে বাধা মনে করে। বিরুদ্ধ মত সে সহ্য করে না। এ ভাবেই তৈরি হয় ধর্মীয় মৌলবাদ।
‘মৌলবাদ’ শব্দটি অন্তর্নিহিত অর্থের কারণেই অভঙ্গুর। তাকে অন্য কোনও মতবাদ দিয়ে ভাঙা যায় না। তাই পৃথিবীতে সব ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্য এক— নারী স্বাধীনতার বিরোধিতা, পুরুষদের বহুবিবাহ, নারীদের বাল্যবিবাহ, জাতিগত বিভাজন। নানাবিধ সংস্কারে সব ধর্মই আক্রান্ত। এগুলোর যথাযথ লালন আর পালনের মধ্যেই যদি ধর্মের অস্তিত্ব নির্ভর করে, তবে তাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের এত ব্যাকুলতা কেন? যে ধর্মীয় মৌলবাদ সব সময় আমাদের পিছনের দিকে টানছে, মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করছে, আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে একটা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা দিয়ে বেঁধে রেখেছে, আমরা আজও সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারলাম না কেন?
ধর্মীয় মৌলবাদের কবলে পড়ে ভয়াবহ আতঙ্কে আফগানিস্তানের হাজার হাজার মানুষ পালাতে চাইছেন। পূর্ব অভিজ্ঞতাজনিত আতঙ্ক নিয়ে বলছেন, তাঁরা আর দেশে ফিরবেন না। তা হলে তালিবানরা তাঁদের হত্যা করবে। এ রকম একটা উদাহরণ সামনে আসার পরেও আমাদের দেশের মানুষ, রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন অদ্ভুত ভাবে প্রতিক্রিয়াহীন। ধর্মীয় মৌলবাদের চরমপন্থী রূপ তো সন্ত্রাসবাদ। যাঁরা বলেন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নত ও আধুনিক হলেই একমাত্র দেশ সুরক্ষিত থাকবে, তাঁদের অদূরদর্শী ভাবনার জন্য আফগানিস্তান একটা দৃষ্টান্ত। প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি যদি দেশের অভ্যন্তরে ক্রমাগত ধর্মীয় উন্মাদনার প্রসার ঘটানো হয়, তবে বাইরের শত্রুদের কিছু করতে হবে না। আফগানিস্তানের মতো পরিণতি আমাদের দেশেও হতে পারে। ভারতে যদিও এখন তালিবানদের মতো সশস্ত্র ধর্মীয় গোষ্ঠী নেই। তবুও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার অবকাশ নেই। কারণ, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য ধর্মীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। তাই আফগানিস্তানের পরিস্থিতি যে এখানেও তৈরি হতে পারে, তার ভিত্তিপ্রস্তর কিন্তু প্রস্তুত।
সূর্যকান্ত চক্রবর্তী, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
ভয় হয়
যে কোনও ধর্মের আচারসর্বস্বতা ও বিকৃত দিকটার চর্চাই মৌলবাদের উত্থানের কারণ। মৌলবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাম্রাজ্যবাদী এবং ফ্যাসিস্টরাই মৌলবাদকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছে। আফগানিস্তানের তালিবানি উত্থান আমাদের সবাইকে বিচলিত করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল, ইতিহাসের বিচারে যাকে মানবসভ্যতার আঁতুড়ঘর বলা যায়, সে এ ভাবে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের আঁতুড়ঘর হল কী ভাবে?
পেট্রোলিয়াম সমৃদ্ধ অঞ্চল হল পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া। তাই সাম্রাজ্যবাদীদের ব্যবসায়িক লোভ চরিতার্থ করার জন্য ওই এলাকার দখল নেওয়া অত্যাবশ্যক ছিল। মধ্যযুগীয় ইসলামিক সভ্যতা মানবসভ্যতাকে বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, রসায়ন, বিজ্ঞান উপহার দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী কালে সেখানে জন্ম নেয় গোঁড়ামি। এই গোঁড়ামিকেই কাজে লাগিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার প্রভাব যখন আফগানিস্তান-সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের উপর পড়েছিল, সেখান থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন পথে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা নিয়েছিল আমেরিকা-সহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। তারাই সৃষ্টি করেছিল তালিবান, অস্ত্র, অর্থের জোগান দিয়ে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল, তালিবানদের শাসন বর্বরতার চরমতম নিদর্শন হয়ে থাকবে। মানুষের ন্যূনতম অধিকার কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি হিন্দুকুশ পর্বতের বামিয়ান উপত্যকায় বুদ্ধমূর্তিকে কামানের গোলা দিয়ে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল তারা।
আমাদেরও ভয় হয়। ভারতে আজ যে দল ক্ষমতায় আসীন, তার সঙ্গে নাম জড়িয়েছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো ঘটনার। সেই দলের নেতা-মন্ত্রীদের মুখেও মহিলাদের ক্ষমতা খর্ব করার কথা শোনা যায়। ভারতও কি আফগানিস্তানের মতো গভীর সঙ্কটের দিকে এগিয়ে চলেছে?
সূর্যেন্দু বিকাশ পাত্র, প্রতাপদিঘি, পূর্ব মেদিনীপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy