পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর ‘অগ্নীশ্বররা স্মৃতিতে থাকবেন’(১২-১১) শীর্ষক প্রবন্ধটির প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার তাগিদ অনুভব করলাম। পারিবারিক অসুস্থতার কারণে বহু নামীদামি চিকিৎসকের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। প্রবন্ধটির শিরোনামে উল্লিখিত চিকিৎসক অগ্নীশ্বর মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। আমার মতে, ডাক্তার ‘অগ্নীশ্বর’-কে ঠিক পারিবারিক চিকিৎসকের পর্যায়ে ফেলা যায় না। বরং, এক ব্যতিক্রমী ডাক্তার বলাই শ্রেয়, যিনি স্টোরবাবুর স্ত্রীকে দেখে যেমন ফি রোগীর বিছানাতেই ফেলে আসেন, তেমনই শেঠ সুখরামকে সুচ দিতে দ্বিগুণ ভিজ়িট নেন। তাঁর রোগ নির্ণয় করার আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয়ও পাওয়া যায়।
তবে, পারিবারিক ডাক্তারদের যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থার ‘কর্পোরেটাইজ়েশন’-এর জন্য, এ যুক্তি সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। আসলে, ডাক্তার ও রোগী বা তাঁর পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতায় চিড় ধরেছে। এখন রোগ নির্ণয়ে ডাক্তারবাবুরা চোখের ব্যবহার কি তেমন ভাবে করেন? পরীক্ষানিরীক্ষার উপরই অতিরিক্ত নির্ভরশীল! অলীক সুখ (প্রয়াত সুচিত্রা ভট্টাচার্য প্রণীত) ছবিতে এক প্রাজ্ঞ ডাক্তার, অম্বরীশ রায় তাঁর একদা ছাত্রকে বলছেন, মানুষের শরীর যন্ত্র নয়, তার একটা ভাষা আছে, সেটা পড়তে হবে, তবেই না চিকিৎসক রোগ নিরাময়ে সফল হবেন! যে পারিবারিক চিকিৎসকদের কথা প্রবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে, তাঁদের সেই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সে কারণেই চরম বিপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা তাঁদের শরণাপন্ন হতাম।
কালে কালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, অনেক অত্যাধুনিক হাসপাতাল হয়েছে। আর, আমাদের ধৈর্যশক্তিও কমেছে, যত শীঘ্র সম্ভব বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের কাছে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। হাসপাতাল, চেম্বার সারতে গিয়ে ডাক্তারবাবুরা রোগীদের শরীরের ভাষা পড়ার সময় পান কি? অবশ্য, ব্যতিক্রম আছে। হিপোক্রেটিক শপথ যে সব ডাক্তারই অমান্য করেন, তা মনে করার কারণ নেই। তবে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য— দুই ক্ষেত্রেই এখন ‘কর্পোরেটাইজ়েশন’-এর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি
অবহেলিত গ্রাম
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর প্রবন্ধটি ছোটবেলার স্মৃতি উস্কে দিল। আমাদের এলাকায় এক জন এমবিবিএস চিকিৎসক ছিলেন, যাঁর চেম্বারে গেলে প্রথমেই বলতেন ‘শুয়ে পড়ো’। পেট টিপে, বুক, পিঠ স্টেথোস্কোপ দিয়ে সব ভাল করে দেখেশুনে একটা-দুটো ওষুধ দিয়ে বলতেন, কাল কেমন থাকো জানিয়ো। কিন্তু রোগী আর চেম্বারমুখো হতেন না। ডাক্তারবাবু সকালে আট-দশ জন, বিকেলে পাঁচ-ছ’জন রোগী দেখেই সম্মানের সঙ্গে বাঁচতেন। এলাকার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করতেন। গরিব কৃতী ছাত্রদের অর্থসাহায্য করতেন।
শুনেছি, ওঁর ছেলেও বড় ডাক্তার হয়েছেন, কিন্তু এ তল্লাটে তাঁকে দেখা যায়নি। তার পর দু’-তিন জন ডাক্তার চেম্বার খুলেছিলেন, কিন্তু তাঁরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। সাধারণ রোগী তাঁদের নাগাল পেতেন না। এই রোগীদের হয় অঞ্চলের কোনও কোয়াক ডাক্তার, অথবা কলকাতার হাসপাতালে ছুটতে হয়। হাজার ঝক্কি কাটিয়ে চিকিৎসা পান।
প্রবন্ধকার অর্থনীতির শিক্ষক বলে বিষয়টির সঠিক বিশ্লেষণ করেছেন। বর্তমানে অনেক ডাক্তারই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন, কিন্তু তাঁরা গ্রামে কোনও চেম্বার করেন না। শুধু দেশের বাড়ি বেড়াতে যান। এতেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা নেই। শহরে কোনও বেসরকারি হাসপাতালে মোটা টাকার চাকরি করেন। তাঁদের কাছে আন্তরিক আবেদন, গ্রামে সপ্তাহে তিন-চার দিন কোনও ওষুধের দোকানে অথবা নিজস্ব চেম্বার খুলে চিকিৎসা করলে গ্রামগঞ্জের মানুষ উপকৃত হবেন।
দিলীপ পাল, ভাঙড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
পণ্যসম চিকিৎসা
‘পাড়ার ডাক্তারবাবুদের বিকল্প নেই, আলোচনায় মত চিকিৎসকদের’ (১২-১১) সংবাদটি ছোটবেলার স্মৃতি উস্কে দেয়। তখন পাড়ার ডাক্তাররাই ভরসা ছিলেন। এমবিবিএস পাশ করা এক জন ডাক্তারবাবুর ফি ছিল পাঁচ টাকা। অধিকাংশ চিকিৎসকরাই রাতবিরেত হলেও সামান্য জ্বরেও বাড়িতে এসে রোগী দেখতেন। যে সময়ের কথা বলছি, সেটা ১৯৬০ সালের পূর্ববাংলার চট্টগ্রামের শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার সামাজিক পটভূমি। আজ সত্যি ভাবতে অবাক লাগে তখন কী করে রোগীর লক্ষণ দেখেই রোগ নির্ণয় করে প্রেসক্রিপশন লিখতেন ডাক্তারবাবুরা। ব্যাঙের ছাতার মতো এত ডায়াগনস্টিক সেন্টার সে সময় ছিল না। রোগীর নাড়ি টেপার পর চোখ, মুখ, জিহ্বা দেখে স্টেথো দিয়ে বুক পরীক্ষা করে এক বোতল মিক্সচার দিতেন। কাগজের দাগকাটা বোতলের তিতকুটে, ঝাঁঝালো সেই মিক্সচার গলাধঃকরণ করাটা যে কত কষ্টসাধ্য ছিল, তা আজও আমার মতো অনেকেই ভোলেননি। আর পথ্য হিসাবে দিতেন ভাতের পরিবর্তে সাবু, বার্লি মেশানো দুধ। পাঁচ দিন পর রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেতেন। এর পর রোগী দেখতে যাওয়ার পথে কদাচিৎ ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করতেন কেমন আছি। সঙ্গে, রোদে বেশি ঘোরাঘুরি না করার উপদেশও থাকত। সেই সময়ের ডাক্তার আর শিক্ষককুলের মধ্যে যে পেশাগত আর সামাজিক মূল্যবোধ দেখা যেত, আজ তা বিরল।
ওই দিনেই উত্তর সম্পাদকীয় বেরিয়েছে ‘অগ্নীশ্বররা স্মৃতিতে থাকবেন’। আজ আর সেই অগ্নীশ্বররা নেই। এখন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় তাঁর আগমনের অপেক্ষায়। বেশ কিছু পরীক্ষা-সহ তিনি প্রেসক্রিপশন দেন। এক বারের বেশি কিছু জানতে চাইলে বিরক্ত হন। কারণ এর পর অন্য চেম্বারেও রোগী দেখতে হবে। যত বেশি রোগী তত বেশি অর্থলাভ। অবশ্য, সব ডাক্তার যে এটা করেন, তা মনে করি না। তবে কালের অগ্রগতিতে চিকিৎসা যে এখন পণ্য হয়ে উঠেছে, এ কথা অস্বীকার করারও উপায় নেই।
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
শুধুই পেশাদার
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর সময়োপযোগী লেখাটি পড়ে আরও কিছু তথ্য সংযোজন করতে চাই। আগে পারিবারিক চিকিৎসকদের প্রতিটি রোগীর পরিবারের সঙ্গে থাকত আত্মিক বন্ধন। রোগীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তবেই প্রেসক্রিপশন লিখতেন তাঁরা। কারণ, তাঁরা জানতেন ডাক্তার দেখালেই রোগ সারবে না, ওষুধও কিনতে হবে। অনেক সময় তাঁরা গরিব রোগীকে ফিজ়িশিয়ান স্যাম্পল দিয়েও সাহায্য করতেন। সবচেয়ে বড় কথা, বিনা প্রয়োজনে একগাদা টেস্ট করতে দিতেন না। রোগীর জরুরি প্রয়োজনে ওই চিকিৎসকদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ করা যেত। তা ছাড়া, স্বেচ্ছায় নিয়মিত তাঁরা রোগীর খোঁজখবর নিতেন।
বর্তমানে যে সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মফস্সলে আসেন সপ্তাহে এক বা দু’দিন, কয়েক ঘণ্টার জন্য, তাঁদের সঙ্গে রোগীদের কোনও আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। এঁরা পেশাদার। যে সব ক্লিনিকে বসেন, সেখানকার স্বার্থরক্ষার জন্য অপ্রয়োজনীয় দামি ওষুধ এবং টেস্ট লেখেন। ওই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ৩০-৪০ জন কিংবা তারও বেশি রোগী দেখেন। তা ছাড়া, ওষুধে রোগীর কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে, তাঁদের সঙ্গে সব সময় তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করা যায় না। পারিবারিক চিকিৎসকদের রোগীর প্রতি যে দায়িত্ববোধ থাকত, এঁদের অনেকের মধ্যে সেই দায়িত্ববোধের দেখা পাই না। প্রায়শই সংবাদমাধ্যমে ভুয়ো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের খবর দেখতে পাই। তাতে মনে সংশয় জাগে, এঁরা সবাই সঠিক ডিগ্ৰিধারী তো?
রাসমোহন দত্ত, মছলন্দপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy