Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bhagavad Gita

সম্পাদক সমীপেষু: ‘যুদ্ধ’ নয়, একটি ‘কর্ম’

গীতার সঙ্গে শুধু হিন্দু ধর্মেরই যোগ এমন নয়, যে কোনও ধর্মের মানুষ এই গ্রন্থ পড়ে তার মর্মোপলব্ধির প্রয়াসী হতে পারেন।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০৪:৫৪
Share: Save:

গৌতম চক্রবর্তীর ‘গীতা-ই যখন বহুস্বরা’ (১৭-১২) প্রবন্ধটি সুচিন্তিত ও সময়োচিত। গীতাকে জানতে হবে তার রাজনীতিকরণ বাদ দিয়ে। সাধারণ ভারতীয়রা কত জন জানেন, শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা-য় ১৮টি অধ্যায় ও ৭০০টি শ্লোক আছে? যুদ্ধলিপ্সা জাগানোর জন্য, মানুষকে যুদ্ধের জন্য উদ্দীপ্ত করার জন্য গীতা নয়। জীবনে কর্তব্য-অকর্তব্যের যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলে, তার উত্তর আছে গীতায়। গীতা ধর্ম নয়, বিশ্বাস নয়; জীবনশৈলীর পথপ্রদর্শক। জলকে যদি তার তরলতা থেকে আলাদা করা হয়, তা হলে সে আর জল রইল না। আগুন থেকে যদি তার উত্তাপ সরিয়ে ফেলা হয়, তা হলে আগুন তার পরিচয় হারাবে। তেমনই মানবজীবন থেকে যদি ভগবদ্‌গীতা-র দর্শন বাদ দেওয়া হয়, তা হলে আত্মা আর রইল না, থাকল শুধু অসার দেহটা। ঘরে ঘরে গীতা আছে, কিন্তু ক’জন পড়েছেন, ক’জনই বা তার সারমর্ম বুঝেছেন! বুঝলে দেশ ও সমাজের চেহারা অন্য রকম হত। পাশ্চাত্যে গীতা শুধু এক অধ্যাত্মগ্রন্থই নয়, জীবনের সব জটিল সমস্যা সমাধানেরও পথ। আজ নামী-দামি সংস্থা তাদের ব্যবসায়িক থেকে নৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজছে গীতার পাতায়, বহু অর্থব্যয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে গীতা ও তার ব্যাখ্যার আলোয়। গীতার বাণী শাশ্বত, যুদ্ধভূমিতে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ করিয়েছেন নীতি ও যুক্তির দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে। যুদ্ধ সেখানে ‘যুদ্ধ’ নয়, একটি ‘কর্ম’।

শ্রীময় ঘোষ, জামশেদপুর

গীতা উৎসব

‘গীতা-ই যখন বহুস্বরা’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই পত্র। গীতা নিয়ে নানা মুনির নানা মত আজও, তবু কিছু কথা বলা প্রয়োজন। শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা কি ধর্মীয় গ্রন্থ? এই প্রশ্নের উত্তর আগে খোঁজা প্রয়োজন। আসলে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা-কে ‘শাস্ত্র’রূপে মানুষ যতটা শ্রদ্ধা করেন, ততখানি কেউ খুঁটিয়ে পড়েন না। মনে রাখতে হবে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গীতার জন্ম। গীতা শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী। প্রিয় বন্ধু অর্জুনের উদ্দেশে, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণার্থে যে অমূল্য উপদেশ তিনি প্রদান করেছিলেন তা কোনও বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নিজস্ব নয়। এমনকি দেশ ও কালের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। গীতায় মোট সাতশো শ্লোক আছে। মোট ১৮টি অধ্যায় আছে। গীতা অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত, কিছু শ্লোক ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের নামে ‘যোগ’ শব্দটি আছে, দ্বিতীয় অধ্যায় তথা ‘সাংখ্যযোগ’ অংশটিকে অনেকে গীতার সারসংক্ষেপ মনে করেন। অধ্যাত্মবাদীরা গীতাকে ‘পঞ্চম বেদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার জ্ঞান প্রথম দিয়েছিলেন বিবস্বানকে (৪/১); বিবস্বান পরে এই পরম জ্ঞান দিয়েছিলেন মনুকে, মনু শিখিয়েছিলেন ইক্ষ্বাকুকে। এ ভাবেই পরম্পরাক্রমে এই জ্ঞান প্রবাহিত।

গীতার সঙ্গে শুধু হিন্দু ধর্মেরই যোগ এমন নয়, যে কোনও ধর্মের মানুষ এই গ্রন্থ পড়ে তার মর্মোপলব্ধির প্রয়াসী হতে পারেন। গীতা সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, “গীতার মতো ধর্মগ্রন্থ পৃথিবীতে বিরল। তার প্রধান কারণ, গীতা সর্বযুগের সর্ব মানুষকে সব সময়েই কিছু না কিছু দিতে পারে। অধ্যাত্মলোকে চরমসম্পদ পেতে হলে গীতাই অত্যুত্তম পথ প্রদর্শক, আর ঠিক তেমনি ইহলোকের পরম সম্পদ পেতে হলে গীতা যে রকম প্রয়োজনীয় চরিত্র গড়ে দিতে পারে, অন্য কম গ্রন্থেরই সে শক্তি আছে। ঘোর নাস্তিকও গীতা পাঠে উপকৃত হয়।” (‘গীতা-রহস্য’/ ময়ূরকণ্ঠী) বিশ্রুত জননেতা হো চি মিন গীতা সম্বন্ধে বলেছিলেন, “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আপনাদের একটি জিনিসকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি, সেটি হল গীতা।” গীতা হিন্দুর নয়, মুসলমানের নয়, খ্রিস্টানের নয়— সে মানুষের, মানবজাতির সম্পদ।

গীতা একটি দার্শনিক গ্রন্থ। দর্শন বলতে আমরা বুঝি জ্ঞান, মূল্যবোধ, অস্তিত্ব, জীবন সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্নগুলির অধ্যয়ন। স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধীর সাহস, কঠোর সংযম ও নৈতিক কর্তব্যপরায়ণতার জন্য সাধারণ মানুষের উপর তাঁর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে গান্ধীজি গীতার দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, যখন সন্দেহ ঘিরে ধরে, হতাশা সম্মুখে উপস্থিত হয় আর দূরে কোনও আশার আলো দেখা যায় না, তখন ভগবদ্‌গীতা আশ্রয়ে শান্তিপ্রদ কোনও শ্লোক খুঁজে পান তিনি। যাঁরা গীতার উপর ধ্যান করবেন, তাঁরা প্রতি দিন পরম আনন্দ ও নব নব অর্থ পাবেন, এ-ই ছিল তাঁর মত। রবীন্দ্রনাথের কথা, গীতা আজও পুরাতন হয়নি, কোনও কালেই পুরাতন হবে না।

কিছু সমালোচকের কাছে গীতা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে দুই বন্ধুর কথোপকথন; তাঁদের যুক্তি, এ ধরনের গ্রন্থ কখনও শাস্ত্র বলে বিবেচিত হতে পারে না। কেউ কেউ বলেন, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে উত্তেজিত করেছিলেন, যা নীতিবিরুদ্ধ। আসলে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, “ইতি তে জ্ঞানমাখ্যাতং গুহ্যাদ্গুহ্যতরং ময়া।/ বিমৃশ্যৈতদশেষেণ যথেচ্ছসি তথা কুরু।।”(১৮/৬৩) এখানে ‘যথেচ্ছসি তথা কুরু’ কথাটির অর্থ ‘যা ইচ্ছা হয় তা-ই করো’— তবে গভীর ভাবে ভেবে তার পর। প্রত্যুত্তরে অর্জুন বলেছেন, “নষ্টো মোহঃ স্মৃতির্লব্ধা ত্বৎ প্রসাদান্ময়াচ্যুত।/ স্থিতোঽস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।।” (১৮/৭৩) অর্থাৎ, কৃষ্ণের কৃপায় তাঁর মোহ বিনষ্ট হয়েছে, স্মৃতি ফিরে এসেছে এবং সব সন্দেহ দূর হয়েছে, এখন তিনি তাঁর আদেশ পালন করবেন। তাই বলতে পারি, গীতা হচ্ছে নীতি সম্বন্ধে পরম উপদেশ। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের গীতার প্রশংসা বা উল্লেখও লক্ষণীয়। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের রূপ দেখে রবার্ট ওপেনহাইমারের গীতার শ্লোকাংশ মনে পড়েছিল, যার অর্থ “এখন আমি বিশ্ববিধ্বংসী মৃত্যু হয়েছি।” (১১/৩২)

গীতার দার্শনিক মূল্য ও কাব্যমূল্য অস্বীকার করা যায় না। টি এস এলিয়ট-এর মতে পৃথিবীর দু’টি শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্যের একটি শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা। গীতাকে ধর্মের আঙ্গিকে না দেখে এই বৃহত্তর অঙ্গনে দেখলে তবেই বোঝা যাবে, এ হল সভ্যতার শ্রেষ্ঠ জীবনমুখী দর্শন। ওড়িশায় একটি প্রবাদ প্রচলিত, “রুচুক না রুচুক খাও তিতা, বোঝ না বোঝ পড় গীতা।” গীতা নিয়ে উৎসব ভাল কথা, কিন্তু তাকে ধর্মীয় মোড়কে মুড়ে ফেললে চলবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে, তার প্রয়োজন কতটা সে কথাই তুলে ধরতে হবে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে। সেটাই হবে সার্থক ‘গীতা উৎসব’।

বিপদতারণ ধীবর, বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া

হুজুগ-মেলা?

শীতকাল এমনিতেই উৎসবপ্রবণ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালির একটি প্রধান সাংস্কৃতিক পার্বণ— বইমেলা। রাজ্য জুড়ে এখন নানা ধরনের বইমেলা সংগঠিত হচ্ছে। ব্লক, মহকুমা, জেলা স্তরে রমরমিয়ে চলছে বইমেলা। এই মেলায় ভিড় নেহাত কম নয়। সারা বছর ধরে নানা সময়ে পাঠক ও লেখকদের একাংশ আক্ষেপ করেন যে, ছাপা বইয়ের কদর আর থাকছে না, পাঠকেরা অনেকেই ছাপা বই বাদ দিয়ে অনলাইনে, পিডিএফ-এ বই পড়ে ফেলছেন। কিন্তু বইমেলার এই ভিড় দেখে সে কথা মনে হচ্ছে না। শুধু ভিড় বাড়ছে তা নয়, ভিড়ে বই বিক্রিও নেহাত কম হচ্ছে না। তার মানে, মানুষ বই পড়ছেন। তা হলে তো চিন্তার কোনও অবকাশ থাকবে না। তবু পাঠক বাঙালির মন যে ভাবে তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তেমন বুদ্ধিদীপ্ত সাধারণ বাঙালিকে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

তা হলে বইমেলায় হচ্ছেটা কী? এখন অবশ্য মেলা মানেই ভিড়। মানুষ টানার প্রতিযোগিতায় এখন সমস্ত মেলা কমিটি উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু সেই ভিড়ের জাত থাকে না। উল্টো দিকে, বইমেলার ভিড় একটু ধ্রুপদী হবে, তেমনটাই আমরা আশা করি। বইমেলা যত ভিড়ে ঠাসা হবে, ততই সেই জাতির বুদ্ধিমত্তা প্রতিফলিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে কই? তাই বইমেলায় উপচে পড়া ভিড় দেখেও মন শান্ত হয় না।

শঙ্খ অধিকারী, সাবড়াকোন, বাঁকুড়া

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy